উদিত হলো সেই সৌভাগ্য শশী
আল্লামা সাঈদীঃ হাজার কোটি প্রদীপ জ্বালায় -নিজে অমর অক্ষয় ।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সৃষ্টি এই বিশাল বিস্তীর্ণ পৃথিবী একটি সুবাসিত পুস্প কানন বিশেষ । পুস্পের এই কাননে কতো না হাজার ফুল প্রতিদিন ফোটে । সব ফুলই দৃষ্টি নন্দন হয়না, দিগন্ত মাঝে ছড়িয়ে দেবার মতো সৌরভ মহান আল্লাহ সব ফুলের ভিতরে দান করেন না । সমস্ত ফুলের ঘ্রানে সব মানুষ মাতোয়ারা হয় না । কোন ফুল অবহেলা অনাদরে ঝরে যায় । অনাদরে অবহেলায় ঝরে যাওয়া ফুলের সংখ্যা এ পৃথিবীতে বেশী । কিন্তু এমন কতকগুলো বিরল ফুল এ পৃথিবীতে ফুটেছে যার ফোটার অপেক্ষায় এ আকাশ এ পৃথিবী, পৃথিবীর প্রতিটি অনু-পরমানু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অপেক্ষা করেছে । অবশেষে প্রতিক্ষার প্রহর অতিবাহিত হয়েছে, কাংক্ষিত ফুল ফুটেছে, পৃথিবী নামক পুস্প কানন সুবাসিত হয়েছে । এই কাংক্ষিত-প্রতিক্ষীত জান্নাতী ফুল গূলো ছিলেন মহান আল্লাহর প্রেরিত নবী রাসুলগন ।
নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সেই জান্নাতী ফুলগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ । তিনি এমন এক প্রদীপ, তার জান্নাতী আলো থেকে শতকোটি প্রদীপ জ্বলে উঠেছে কিন্তু তার আলো কখনো শেষ হবার নয় । কবির ভাষায়ঃ সে যে হাজার কোটি প্রদীপ জ্বালায় -নিজে অমর অক্ষয় ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আদর্শ প্রচার প্রসার ও প্রতিষ্ঠিত করে গেলেন, তা কোন কালের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয় । তার আদর্শের সৌরভে পৃথিবীকে আমোদিত করার মহান আল্লাহর অদৃশ্য ব্যবস্থাপনায় মুসলিম মিল্লাতের এই বাগানে কিছু বিরল ফুল প্রতিটি যুগেই ফুটেছে । আগামীতেও ফুটতে থাকবে ।
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সেই বিরল ফুলগুলোর একটি । এই সাঈদী নামক ফুলের সৌরভ দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছে । সে ফুলের মন মাতানো সৌরভে মহাসত্যের ওপরে শতাব্দী সঞ্চিত আবর্জনা দুরিভুত হয় । মহাসত্যের দিকে ধেয়ে আসা বাতিল তার ঘৃণ্য কুৎসিত হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয় । আল্লামা সাঈদী সেই দুর্লভ ফুল, যার প্রচেস্টায় দুরভিত হচ্ছিলো মুসলিম জাতির ওপরে পুঞ্জিভুত আবর্জনার স্তুপ । যার ব্জ্র হুংকারে অভিশপ্ত বাতিল শক্তি তার ঘৃণ্য কালো থাবা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছিলো ।
মহাসত্যের শত্রুদের হৃদকম্পন জাগবে যার বলিষ্ঠ কন্ঠে-সেই মনিষী মায়ের কোল আলো করে পৃথিবীতে এলেন পবিত্র রমযান মাসে । মহাসত্যের দ্যুতি বিকিরনের পবিত্র মাস । রমযান-রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস । অশুভ শক্তির শেষ ঠিকানা জাহান্নামের দুয়ার বন্ধ করার এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করার মাস । রমযান মাস সেই মহা সউভাগ্যবান মাস- যে মাসে সত্য আর মিথ্যার পার্থক্যকারী -গোটা মানব জাতির জীবন বিধান মহাগ্রন্থ আল কোরআন হেরার রাজ তোরনে শোষিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত মানবতার মুক্তির দিশারী বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিলো । আল-কোরআন এসেছিলো রমযান মাসে আর কোরআনের অকুতভয় সৈনিক আল্লামা সাঈদীকেও পৃথিবী নামক পুস্প কাননের ফুল হিসেবে ফোটানোর জন্য এই পবিত্র মাসকেই আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা নির্বাচিত করলেন ।
সেদিন ছিলো ১৯৪০ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের ২ তারিখ । বরকতে পরিপূর্ণ সেই পবিত্র রমযান মাসের ৭ তারিখ বৃহস্পতি বার । ক্ষণপূর্বে আকাশের পূর্ব প্রান্তে পূর্বাশার ইশারা দেখা দিয়েছিলো । প্রকৃতি জুড়ে বিরাজ করছিলো শীতের আমেজ । শত সহস্র কন্ঠে তাওহিদের বলিষ্ঠ ঘোষণা- ফগরের আযান ধ্বনিত হলো । ফজরের নামায শেষে শুরু হলো সেই কাংখিত দিনের । তরুণ তপন উদিত হলো । শীতের পরিবেশে ছড়িয়ে দিলো মিস্টি মধুর আবেশ । ক্রমশ আলোকিত হয়ে উঠলো অন্ধকার এই পৃথিবী । সদ্য উদিত সূর্য তার সোনালী আভায় পৃথিবীকে সজীব করে তুললো যেই মুহূর্তে- আল কোরআনের জান্নাতী আলোয় যিনি পথহারা মানুষকে আলোকিত করবেন, পৃথিবী নামক পুস্প কাননে ঠিক সেই মুহূর্তে ফুটলো সেই বিরল ফুল । রত্নগর্ভা জননীর কোল আলোকিত করে এলেন অপরুপ সেই শিশু । তার দুকানে শুনিয়ে দেয়া হলো তাওহিদের ঘোষণা । এই ঘোষণার মধ্যদিয়ে অলক্ষে শিশুকে যেন জানিয়ে দেয়া হলো, তাওহীদের এই ঘোষণা তোমাকেই বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে হবে ।
ইসলামী সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ মুসলিম শিশুর অর্থবহ নামকরন । বড় হয়ে ওই সুন্দর নামেই পরিচিতি পাবে । আল্লাহর ওলী ভারতের ফুরফুরা শরীফের মরহুম পীর হযরত মাওলানা আবু জাফর সিদ্দিকী আল কোরাইশী (রাহঃ) দাওয়াতী সফরে এদেশে আগমন করলেন । শিশুর পিত্রালয়ে দাওয়াত দেয়া হলে, তিনি সে দাওয়াত কবুল করে আগমন করলেন । তাকে নাম রাখার অনুরোধ করলে, অপরুপ শিশুকে গভীর মমতায় তিনি কোলে তুলে নিলেন । তিনি শিশুর নাম রাখলেন "দেলাওয়ার" । "দেলাওয়ার" শব্দটি ফার্সি ভাষার, এর শব্দার্থ "যুদ্ধে বিজয়ী বীর" । কালের বিবর্তনে বর্তমানের "দেলাওয়ার" আল্লাহর কোরআনের লড়াকু সৈনিক-ইসলামের বীর যোদ্ধা । সাঈদী হলো তার পূর্ব পুরুষের উপাধি । বংশ পরম্পরায় তার নামের সাথেও যুক্ত হলো এই উপাধি ।
পরিপূর্ণ নাম দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, যে নাম শুনলে কোরআন প্রেমিকদের হৃদয়ে এক জান্নাতি আবেশের সৃষ্টি হয় । গভীর শ্রদ্ধায় পরম মমতায় কন্ঠ হতে নির্গত হয় সে নামটি । তার পিতা হযরত মাওলানা ইউসুফ সাঈদী (রাহঃ) ছিলেন তার যুগের সুবক্তা ও কামেলে পীর । শিশু সাঈদীর পিতা মাতা উভয়ের জীবন-যাপন প্রনালী ছিলো পূর্ণ ইসলামী আদর্শ ভিত্তিক । সুতরাং সেই শৈশব থেকেই সাঈদীর কোমল কচি হৃদয়ে ইসলামী ভাবধারার পূর্ণ চিত্র অঙ্কিত হয়েছিলো । শিশু সাঈদী যখন শিক্ষা ধারন করার ক্ষমতা অর্জন করলো, পিতা তাকে জ্ঞানার্জনের জন্য ভর্তি করে দিলেন পিরোজপুরে নিজ প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় ।
জ্ঞানার্জনের জগতে শিশু সাঈদী প্রবেশ করলেন । জ্ঞানার্জনের অদম্য স্পৃহা তাকে জ্ঞানের গভীর জগতের দিকে টেনে নিয়ে গেলো । তিনি ভর্তি হলেন উপমাহাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শরসিনা মাদরাসায় । সেখান থেকে খুলনা আলীয়া মাদরাসায় লেখা পড়া করলেন । ছাত্র জীবনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, প্রবন্ধ রচনা প্রতিযোগিতায় কোরআনের এই নির্ভীক সৈনিক অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন । তার বক্তৃতা প্রদানের কৌশল, স্পষ্ট উচ্চারন, সাবলীল ভাষা, শব্দ চয়নে নৈপুণ্যতা ও বাচন ভঙ্গি শ্রোতাদেরকে বিমোহিত করতো । ১৯৬২ সনে তিনি মাদরাসার স্রবচ্চো ডিগ্রী অর্জন করেন । তিনি অনুভব করলেন পাশ্চত্যের বস্তুবাদ আর জড়বাদী জীবন দর্শন বর্তমানে মুসলিম জাতিকে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে । কাল মার্কসের নাস্তিক্যবাদী দর্শন সমাজতন্ত্র মুসলমানদেরকে নাস্তিকে পরিনত করছে । সুতরাং বর্তমান পৃথিবীতে প্রচলিত মতবাদ-মতাদর্শের মোকাবেলায় ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে তুলে ধরতে হলে এসব মতবাদের নিগুঢ় তত্ব জেনে এর দুর্বলতা সমুহ মানব জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে ।
বিশাল কর্মময় জীবনে নিজ গ্রামের বাইরে তিনি সর্বপ্রথম বক্তৃতা করেন পিরোজপুর জেলার স্বরুপকাঠি স্কুলের ময়দানে । তার কর্মের ময়দান কুসুমাস্তীর্ণ নয়- কণ্টকাকীর্ণ এই ময়দান । এ ময়দানে পা রাখার অর্থই হলো শাহাদাতের উত্তপ্ত ময়দানে পা রাখা ।
"ইয়ে শাহাদাত গাহে উলফত মে কদম রাখনা
লোগ সমাঝতা হ্যায়, আছান হ্যাঁয় মুসলমান হোনা " (চলবে)