ভেবেছিলাম জুম্মা পড়েই কবর জিয়ারত করবো কিন্তু শেরপুর শহরে এক শুভাকাঙ্ক্ষী দুপুরের খানা না খাইয়ে ছাড়লেন না । আমাদের পৌঁছাতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছিল । ঢাকা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ২৪ এপ্রিল-শুক্রবার দুপুর ৩টায় পৌছাই শহীদের বড় ভাই কফিল সাহেবের বাড়ীতে । আমি পৌছা মাত্র মুহুর্তেই চতুর্দিক থেকে গ্রামবাসী নারী-পুরুষের অভাবনীয় ভীড় । বাড়িতে কিছুক্ষন বসলাম । ইতোমধ্যে বহু মানুষ আমাদের চারপাশে এসে অবস্থান নিয়েছে । একজন একপাশে একটি টেবিলের উপর একটি শোকবই দেখিয়ে বললো, আসুন এখানে কিছু লিখুন । কি লিখবো আমি ? আমার তো ভাষা জ্ঞান তেমন নেই । কামারুজ্জামান চাচাকে নিয়ে লিখবো ভাবতেই আমার দুচোখ জলে ঝাপসা হয়ে এলো । কলম চলছে না । তবুও, শোকবইতে দুকথা লিখে (বিহ্বল আমি, কি লিখলাম মনে নেই) রওনা দিলাম সবুজ ধানক্ষেত লাগোয়া একটি সতেজ কবর দিকে । উপস্থিত হলাম নীল পলিথিনে ঢাকা সেই কবরে । শেরপুর সদরের কুমরি বাজিতখিলা গ্রামের এতিমখানা সংলগ্ন রাস্তা, যার পাশে শুয়ে আছেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় দায়িত্বশীল শহীদ কামারুজ্জামান । আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর ।
নানা আশংকার কারণে এ যাত্রার খবর আগাম কাউকে জানানো হয়নি । শুনেছি, প্রতিদিন দুর-দুরান্ত থেকে মানুষের আনা-গোনা লেগেই থাকে, কিন্তু আজ যেন বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার ! সকলের চোখে কান্নার ঢেউ আছড়ে পড়ে আমিও কান্না চেপে রাখতে পারিনি । কে কাকে সান্তনা দেবে ? নারীদের বিলাপ ধ্বনিতে ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ । চারিদিক থেকে মানুষের স্রোত ক্রমেই বাড়ছে দেখে শংকিত হলাম । হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ এসে সৃষ্টি করবে ত্রাস । এতো সাহস কোথা থেকে এলো কে জানে ! কবরের পাশে থাকলাম অনেকক্ষণ ।
সুরা ফাতিহা, এখলাস, দুরুদ পড়ে মোনাযাতের জন্য দুহাত তুললাম আর বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো দুচোখ বেয়ে পানি আসলো । উপস্থিত সকলে কাদলেন । শহীদ কামারুজ্জামান, তিনি তো আমার কোন আত্মীয় নন । তবে কেন যে এতো কান্নায় বুক ভাসালাম ? কেন এতো মানুষের ভিড় ? কেন গ্রামের সহজ সরল মানুষ তাকে ভালোবাসে ? কেন তার জন্য এখনও কাদে ?
মোনাযাত শেষে চলে আসার জন্য উদ্যত হলে স্থানীয় এক মুরুব্বি আমার হাতটি চেপে ধরেন, যার অর্থ, না-এখনই নয়, আমাকে জনতার ভীড় ঠেলতে ঠেলতে সামনে এগুতে থাকে আর আস্তে আস্তে বলতে থাকেন- আপনার আব্বার রায়ের পর এইযে লোকগুলি দেখছেন তাদের প্রত্যেকেরই নামে বিভিন্ন মামলা দেয়া হয়েছে । এরা রাতের পর রাত নিজ বাসায় ঘুমুতে পারে না । এদের মধ্যে অনেকেই পুলিশের নির্যাতনে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকেছেন । এদের ভিতর যেমন যুবক আছে তেমনি বৃদ্ধ এবং তরুন কিশোরও আছে । আমাকে শহীদ কামারুজ্জামানের প্রতিষ্ঠিত এতিমখানা প্রাঙ্গনে গিয়ে দাঁড়া করায় । এতীমখানার সামনে বেশ খানিকটা জায়গা খোলা মাঠ । সে রাতে কেমন করে তাঁর কফিন আনা হয়েছিল, কিভাবে তার জানাজা এবং দাফন সম্পন্ন হয়েছিল, সবিস্তারে জানালেন সেই মুরুব্বি । তার কাছে পুলিশ ও প্রশাসনের নির্দয় আচরনের বয়ান শুনে অবাক হলাম । একজন মৃত মানুষ ও তার নিরীহ গ্রামবাসীর প্রতি এত অমানবিক আচরণ হতে পারে তা অবিশ্বাস্য ! শত শত পুলিশের কড়া বেরিকেডের বাইরে হাজার হাজার গ্রামবাসী সাধারণ নারী-পুরুষ রাত জেগে বিভিন্ন দিকে অবস্থান নেয় । তাদের কান্না, আহাজারী, কাকুতি-মিনতি কোন কিছুই পুলিশের মন গলাতে পারেনি । পুলিশ কাউকেই জানাজা স্থলের কাছে ঘেষতে দেয়নি । বার বার লাঠিচার্জ করে সরিয়ে দিয়েছে । বৃষ্টিস্নাত রাতের আধারে সে এক হৃদয়-বিদারক দৃশ্য । বলতে বলতে ভদ্রলোকের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে । চোখ ছল ছল করে ওঠে আমাদেরও ।
এরই মাঝে এক যুবক (ভিড়ের মধ্যে নামটা শোনা হয়নি ) আমার সামনে তার দুখানা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো এই হাত দিয়ে শহীদকে কবরে নামানোর সৌভাগ্য হয়েছে । কফিনটা দেখিয়ে বললো এখনো শহীদের রক্তের দাগ মুছে যায়নি । ছোপ কালো দাগ পরে আছে । আমার দুহাত রক্তে ভরে গেছিলো তখন তার গর্বিত চোখ দুটি চকচক করছিলো । এতিমখানার তিনটা পিলারে রক্তাক্ত হাতের ছাপ দেখলাম । জানলাম, শহীদ কামারুজ্জামানের কফিনের বাক্স খোলার পর দেখা গেছে - তার ডান নাক এবং কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে গলা ও বুকের উপর তরতাজা রক্ত ছড়িয়ে ছিল । তখন এক ছাত্র আবেগ প্রবণ হয়ে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে কাঁদতে কাঁদতে রক্তাক্ত কফিন জড়িয়ে ধরে । তার হাতে শহীদের যে তপ্ত খুন লেগেছিল এগুলো তারই স্মৃতিচিহ্ন ।
সেই মুরুব্বি কানে কানে বললেন, আপনার আব্বার কথা কিছু বলেন, অনেকে অনুরোধ করছেন তারা হুজুরের কথা শুনতে চাচ্ছেন । এরই মধ্যে লক্ষ করলাম এয়াতীম খানার দোতলা তিনতলায় মহিলারা শিশু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন । উপস্থিত জনতার আবেগের কাছে হার মানতে বাধ্য হলাম একটি লম্বা বেঞ্চের উপর দাড়িয়ে উপস্থিত গ্রামবাসীকে সালাম দিলাম । তাদের চোখের দিকে চেয়ে কথা বলতে পারছিলাম না । কান্না ভেজা কন্ঠে কথা বলা কঠিন । বললাম, মহান আল্লাহর রহমতে আপনাদের দোয়ায় আব্বা সুস্থ আছেন, ভালো আছেন । দয়াময় আল্লাহ করুনা করে তাকে যে হায়াত টুকুন দান করেছেন সেই জীবনটা যেন জেলের ভিতর পচে গলে নষ্ট না হয় বরং কুরআনের ময়দানে তাফসীর করছেন এমন সময় বুলেটের আঘাতে বুকটা ঝাঁঝরা করে দিলো । শাহাদাতের সিড়ি বেয়ে জান্নাতে কামারুজ্জামান চাচার কাছে চলে গেলেন । ব্যাক্তি কামারুজ্জামানের বিচার তারা করছে না । তারা ইসলামী নেত্রীবৃন্দের মিথ্যা মামলা সাজানো সাক্ষির বিচার করছে । আমরা ন্যায় বিচার পাইনি । এই বিচার এখানেই শেষ নয় । কাল কেয়ামতের ময়দানে এ বিচার আবার হবে । সেদিন কামারুজ্জামান সহ আমরা হবো বাদী, আসামি হবে এই জুলুমবাজেরা আর সেই দিন সাক্ষি আপনারা দিবেন । বিচার করবেন সকল বিচারকদের বিচারপতি মহাপরাক্রমশীল আল্লাহ । সেদিন আপনারা সাক্ষি দেবেন ? উপস্থিত জনতা গলা ছেড়ে গগন বিদারী চিৎকার করে বলে "দেবো" সাক্ষি দেবো" । কামারুজ্জামান চাচার রক্তের বিনিময়ে আল্লাহ এদেশে কালেমার পতাকা উড্ডীন করবেন । এদেশে ইসলাম বিজয়ী হবেই হবে, ইনশাআল্লাহ ।
ক্রমে যেভাবে মানুষের চাপ বাড়ছে । এবার আমাদের ফেরা উচিত । সাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ীতে উঠালাম । আবারও দুচোখ জলে ভরে গেলো । কবরের সাথে লাগানো সবুজ ধানক্ষেতের পাতাগুলো বাতাসে দুলছে । নীল পলিথিনে ঢাকা বালিমাটির কবরটি ছেড়ে যেতে মন চাইছে না । অবনত মস্তকে মহান রাব্বুল আ’লামীনের শাহী দরবারে বিড় বিড় করে বললাম, ইয়া দয়াময় মায়াময় আল্রাহ !আমার আব্বার প্রিয় ভাইটিকে রেখে যাচ্ছি, আবার কখন আসবো জানিনা । জান্নাতি পোষাকে তাকে ঘুম পরিয়ে রেখো, যেমনটি নতুন বর ঘুমায় । জান্নাতে তার সাথে আমার দেখা করিয়ে দিও, যেমনটি দেখা করিয়েছিলে জেলখানায় । কবরটিকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দাও । জান্নাতে, তোমার কাছে একটা ঘর তাকে দিও । প্রিয় রাসুলের প্রতিবেশী করে দিও ।