রবিবার, ৩১ মে, ২০১৫

শবে বরাত পালন বিদআত


যখন তাদের বলি শবে বরাত পালন করবেন না এটা ইসলামে নেই, তাই এটা বিদ’আত, তখন তারা বলে,
-‘কীভাবে এটা বিদআত হলো’?
-‘নফল নামায রোজা করা কীভাবে বিদ’আত হতে পারে’?
-‘দেশের এত, এত মানুষ এটা পালন করছে তারা কি সবাই ভুল’?
-‘এত আলেম, হুজুরেরা এটা পালন করছে তারা কি সবাই ভুল’?
-‘তারা কি কুরআন হাদিস পরে না? তারা কি জানে না? ইত্যাদি ইত্যাদি...’
দেখুন সংখ্যা বেশী হলেই যে কোন পক্ষ হক্ব তা কিন্তু প্রমান হয় না। নিচে এই সম্পর্কিত মহান আল্লাহ্‌র বানীটি একটু দেখুন-
وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۚ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ
-যদি আপনি দুনিয়ায় বসবাসকারী অধিকাংশ লোকের কথায় চলেন তাহলে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে৷ তারা তো চলে নিছক আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে এবং তারা কেবল আন্দাজ-অনুমানই করে থাকে৷ [সূরা আল-আনআম ৬/১১৬]

►অর্থাৎ দুনিয়ার অধিকাংশ লোক নির্ভুল জ্ঞানের পরিবর্তে কেবলমাত্র আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাদের আকীদা-বিশ্বাস,দর্শন, চিন্তাধারা, জীবন যাপনের মূলনীতি ও কর্মবিধান সবকিছুই ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে আল্লাহর পথ অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী দুনিয়ায় জীবন যাপন করার পথ মাত্র একটিই। সেটি হচ্ছে, আল্লাহ নিজে যে পথটি জানিয়ে দিয়েছেন-লোকেরা নিজেদের আন্দাজ-অনুমান ও ধারণা-কল্পনার ভিত্তিতে নিজেরাই যে পথটি তৈরী করেছে, সেটি নয়। কাজেই দুনিয়ার বেশীর ভাগ লোক কোন্ পথে যাচ্ছে, কোন সত্য সন্ধানীর এটা দেখা উচিত নয়, বরং আল্লাহ যে পথটি তৈরী করে দিয়েছেন তার ওপরই তার দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলা উচিত।
ইসলাম চলবে কোরআন ও হাদীস এর দলিল অনুযায়ী, কোন বাপদাদা বা হুজুরের দোহাই দিয়ে নয়! রাসুল ﷺ এর সময় বাপ দাদার দোহাই দিতো ইহুদী-খৃষ্টানেরা। আপনারাও যদি বাপ দাদার দোহাই দিয়ে সত্যকে অস্বীকার করেন, তাহলে ঐ ইহুদী-খৃষ্টানদের সাথে আপনার পার্থক্য থাকলো কোথায়? দেখুন মহান আল্লাহ কোরআনে আরও বলেন,
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا ۗ أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ
-তাদের যখন বলা হয়, আল্লাহ যে বিধান নাযিল করেছেন তা মেনে চলো, জবাবে তারা বলে, আমাদের বাপ-দাদাদের যে পথের অনুসারী পেয়েছি আমরা তো সে পথে চলবো৷ আচ্ছা, তাদের বাপ-দাদারা যদি একটুও বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ না করে থেকে থাকে এবং সত্য-সঠিক পথের সন্ধান না পেয়ে থাকে তাহলেও কি তারা তাদের অনুসরণ করে যেতে থাকবে? [সুরা আল-বাকারা ২/১৭০]
►অর্থাৎ বাপ-দাদাদের থেকে এভাবেই চলে আসছে এ ধরনের খোঁড়া যুক্তি পেশ করা ছাড়া তাদের কাছে এসব বিধি-নিষেধের পক্ষে পেশ করার মতো কোন সবল যুক্তি-প্রমাণ নেই। বোকারা মনে করে কোন পদ্ধতির অনুসরণ করার জন্য এই ধরনের যুক্তি যথেষ্ট।

হজ্জে সফরের আদব

হজ্জের সফরে যাত্রা করার পূর্বে হকদারদের হক ফেরত দিতে হবে, ফেরত দিতে না পারলে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে । কারো আমানত থাকলে তা প্রত্যারপন করতে হবে । ঋন থাকলে তা আদায় করতে হবে । কারো মনে আঘাত দিয়ে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে । দেনা পাওনা থাকলে তা স্পস্ট লিখে যেতে হবে এবং উত্তরাধিকারীদের জানিয়ে যেতে হবে যে, অমুকের কাছে ঋনী আছি তা আমার সম্পদ থেকে পরিশোধ করতে হবে । যাবতীয় খরচ বহন করতে হবে হালাল উপার্জন দিয়ে । যা খরচ হবে তা থেকেও একটু বেশী অর্থ সাথে নিতে হবে, কারন অন্যের প্রয়োজন পুরন করতে হতে পারে বা নিজের খরচও বেশী হতে পারে । হজ্জ আদায় করেছেন এমন অভিজ্ঞ আলেমে দ্ব্বনের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন । হজ্জের সফরে এমন একজন ভালো সাথী খুজে নিতে পারেন, যেন প্রয়োজনে কাজে আসে । কোণো অবস্থাতেই অন্যের অসুবিধা করা যাবে না । সব সময় অন্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে । মনে রাখতে হবে, হজ্জের সকলেই মহান আল্লাহর মেহমান । আল্লাহর মেহমানগন যেন কস্ট না পায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে ।
সকলের সাথে সুন্দর আচরন করা এবং অন্যের প্রয়োজনের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা । কারো আচরন পছন্দ না হলেও ধৈর্যয়ের সাথে সবকিছু গ্রহন করা এবং সব সময় পবিত্র থাকা । মনে রাখবেন, মহান আল্লাহ তা'য়ালা পবিত্রতা ভালোবাসেন । শয়তানের কুমন্ত্রনা থেকে মুক্ত থাকার জন্য মনে মনে সবসময় তাসবীহ, তাহলীল পড়তে থাকুন । নিজের কাছে যে জিনিস রয়েছে তা অন্যের প্রয়োজন হলে দিয়ে সাহায্য করা উত্তম । সফর সঙ্গীদের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার সেবাযত্ন করতে হবে । রোগীর সেবা যত্ন করা অনেক বড় সাওয়াবের কাজ । সফরের সময় প্রয়োজনীয় ঔষধ সাথে নিতে হবে এবং কোন কিছুই অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না, কারন সফরকালে বদহজম হলে নানা ধরনের অসুবিধা সৃষ্টি হবে । সফরের সময় পানি কম পান করাই ভালো, এতে করে ঘন ঘন প্রসাবের বেগ আসতে পারে । সফরে যত কম মাল সামান নেয়া যায় ততোই ভালো ।
সফর শুরুর পূর্বে দুই রাকায়াত নফল নামায আদায় করা মুস্তাহাব । নামায শেষে নিজের নিরাপত্তা, পরিবার পরিজনের নিরাপত্তার ব্যাপারে মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে হবে । সেই সাথে নিজের জীবিত ও মৃত আত্মীয় স্বজন এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া করতে হবে । সবশেষে বাড়ি থেকে বের হবার সময় ডান পা এগিয়ে দিয়ে সফরের দোয়া পড়তে হবে । যান বাহনে উঠলে, যান বাহনে উঠার দোয়া পড়তে হবে । এসব দোয়া এ পুস্তকের দোয়া দুরুদ অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে । ---(চলবে)
"শারঈ' মানদন্ডে
দোয়া-যিকির,হজ্জ ও উমরা"

কোটি মানুষের হৃদয়ে, আজও জিয়া বেচে আছে ।

২৯ শে মে,১৯৮১
রোজ শুক্রবার,
সময় সকাল ৯টা
বিমান বাহিনির একটা সাধারণ বিমান এসে ল্যাণ্ড করল পতেঙ্গায়, ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন ৪৫ বছর বয়েসের চির সবুজ এক সুপুরুষ, বীর মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, বিএনপির স্থানীয় নেতাদের অন্তর্কলহ মেটাবার জন্য ঢাকা থেকে এসেছেন তিনি ।
সারাদিন তিনি দলীয় নেতা কর্মীদের সাথে কাটালেন । সাধারন সুতির ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরে চন্দনপুরা জামে মসজিদে জুমার নামায আদায় করলেন । দুপুরে একটু বিশ্রামও নিলেন । বিকেলে আবার দলীয় নেতা কর্মীদের সাথে বসে সকল দন্দ কন্দলের সুরাহা করলেন । 

রাত ১১.১৫- রাতের (শেষ) খাবার খেলেন প্রেসিডেন্ট ।
রাত ১১.৪০- ঢাকায় স্ত্রী বেগম খালেদাকে টেলিফোন করেন, স্বামী স্ত্রীর শেষ কথপোকথন হয় প্রায় ১৫ মিনিট । অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে ১১.৫৮-সাদা পাজামা আর গেঞ্জি পরে লাইট অফ করে শুয়ে পড়েন ক্লান্ত প্রেসিডেন্ট ।
গভীর রাত, চরম বৈরি আবহাওয়া চট্রগ্রামে, একদল ঘাতক তৈরি হচ্ছিল অশুভ কাজের নিমিত্তে, রাত তখন আড়াইটার মত, ঘাতকের দল এসে মিলিত হল কালুরঘাটের ট্রান্সফর্মারের পাশে, পিচাশদলের নেতৃত্বে ছিল লে. কর্ণেল মতিউর, সাথে ছিল লে.ক. মাহবুব, মেজর খালেদ, ফজলে হাসান, মেজর মোজাফফর প্রমুখ ।
 চট্রগ্রামের আকাশে ঘনকালো মেঘ আর সার্কিট হাউসে তখন কুৎসিত শকুন হায়েনাদের আগমন । রাত প্রায় সাড়ে তিনটা প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি আর প্রতিকুল প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে যমের দল পৌছাল সার্কিট হাউসের গেটে, সম্পূর্ণ বিনা বাধায় ভিতরে প্রবেশ করে তান্ডব শুরু করল, বিশ্বস্ত প্রহরীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরপারে চলে গেল ।
গোলাগুলির শব্দে উশকুখুশকু চুলে ঘুমন্ত প্রেসিডেন্ট দুই হাত উচু করে বেরিয়ে জানতে চাইলেন কি চাও তোমরা ?
লে.কর্ণেল ভয়ে কাঁপছিলেন, মোসলেউদ্দিন কি যেন একটা বলতে চাইলেন, মুখের কথা মুখেই রইল অর্ধেক লে.ক. মতি এসে গুলিতে ঝাঝরা করে ফেলল রাস্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে । মাটিতে লুটিয়ে পরলেন আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার । একজন  সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্তে রঞ্জিত হলো চট্রগ্রাম সার্কিট হাউসের ফ্লোর । ওই রাতে তারা মরদেহটি নিয়ে রওনা হলো রাঙ্গুনিয়া,  রাউজান । 
৩০শে মে, ১৯৮১
মাঠে গরু বাধছেন এক বৃদ্ধ । ফজরের ওয়াক্ত, সূর্য ওঠেনি । হালকা আলোর বিকিরন মাত্র । সাদা চুল দাড়ির বৃদ্ধটির অনেক তাড়া । তাকে গরু বাধতে হবে । ফজরের জামায়াত ধরতে হবে । বাজারে যেতে হবে । গরুটা ইদানিং ঘাস খায় কিন্তু দুধ দেয় কম । ডাক্তারকে বলে ঔষধ নিতে হবে, এদিকে শাঁ শাঁ শব্দে রাস্তা দিয়ে বেশ কয়েকটা আর্মি লরী গেলো ।  একটু দূরে গিয়ে সব গুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে গেলো । অনেক আর্মি জাওয়ান নামলেন । বড়ো ভয় পেলো । গুটিসুটি মেরে আইলের ধারে বসে পড়লো । যেন কেউ না দেখতে পায় ।

বুড়ো চোখে ভালো মতো দেখতে পাচ্ছে না । ২ থেকে ৩ জন আর্মি মাটি খুড়লো, তারপর লরী থেকে কি একটা বড় জিনিস নামিয়ে মাটি চাপা দিলো এবং দ্রুত গাড়ি গুলো যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকেই চলে গেলো । এমন বর্ণনা দিলেন বয়স্ক ওই বুড়ো থানায় এসে । আমি ব্যারাকে আছি, তখন ডিউটিতে যাবো, তৎক্ষণাৎ ওয়ার্ডার আসলো বেরিয়ে পরতে । লুঙ্গি পরা ছিলাম, ওই অবস্থায় রওনা দিলাম । বুড়োর বর্ণনা করা স্থানে ।

সেখানে পৌঁছে দেখলাম, নিশ্চিত এখানে কিছু একটা মাটি চাপা দেয়া হয়েছে । কিন্তু কী ? আমরা জানি না । মাটি খুড়তে বলছে অফিসার । কেউ সাহস পাচ্ছে না । আমি একটা শাবল দিয়ে খোড়া শুরু করলাম । অল্প কিছু খোড়ার পরেই বেড়িয়ে এলো জিয়ার রক্তমাখা লাশ । আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো স্যারের দেহখানি তুলবার । 


ততক্ষনে হাবিলদার ইউনুসের চোখ ছলছল করছে । অনেক আগের কথা সব মনে নেই । ভাঙ্গা ভাঙ্গা যা মনে ছিলো বললাম । ------হাবিলদার ইউনুস (সাতক্ষিরা)

শনিবার, ৩০ মে, ২০১৫

ইহরাম অবস্থায় নিসিদ্ধ কাজ সমুহ

ইহরাম বাধার পূর্বে ভালোভাবে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে । প্রয়োজন হলে মাথার চুল, দাড়ি, গোঁফ, হাতের নখ ও দেহের গোপন স্থানের পশম পরিস্কার করে তারপর গোসল করে ইহরামের কাপড় পরতে হবে । তারপর দুই রাকায়াত নফল নামায [নামাযে প্রথম রাকায়াতে সুরা ক্বাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকায়াতে সুরা ইখলাস পড়া উত্তম ।]   আদায় করে তালবিয়া পাঠ করতে হবে । ইহরাম বাধার পরে এমন অনেক কাজ আছে যা হালাল, কিন্তু ইহরাম অবস্থায় এসব কাজ নিসিদ্ধ হয়ে যায় ।
পুরুষগণ কোন সেলাই যুক্ত কাপড় পরিধান করতে পারবেন ন আ। মাথা ও মুখমন্ডল পুরুষগণ আবৃত করতে পারবেন না । পায়ের উপরিভাগ আবৃত হয়ে যায় এমন পাদুকা ব্যবহার করতে পারবেন না । চুল, দাড়ি, গোঁফ, হাতের নখ ও দেহের গোপন স্থানের পশম কাটতে পারবেন না । আতর, সেন্ট, স্প্রে,  সুগন্ধি বা ঘ্রানযুক্ত তেল্ব্যবহার করতে পারবেন না ।  যৌনাচার থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে । যৌন উত্তেজনা মুলক সকল কথা ও আচরন থেকে বিরত থাকতে হবে । আজেবাজে কোন আলোচনা  করা যাবে না । হাস্য কৌতুক থেকে বিরত থেকে, সময়ের প্রত্যেক মুহূর্ত মহান আল্লাহর স্মরণে অতিবাহিত করা উচিত । কুরআন তেলাওয়াত, তাসবীহ, তাহলীলের মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করা উচিত । যাদের ধুমপানের অভ্যাস রয়েছে এ সময়ে ধুমপান পরিহার করাই উত্তম ।
কোনো ধরনের শিকার করা যাবে না বা কোনো প্রানীও হত্যা করা যাবে না । এমনকি মশা, মাছি, পিপড়া, ছাড়পোকা বা অন্য কোন ক্ষুদ্র প্রানীও হত্যা করা যাবে না । কারো সাথে ঝগড়া, বিবাদ বা মারামারিতে লিপ্ত হওয়া যাবে না । কারো মনে আঘাত দিয়ে কথা বলাও অনুচিত । চুল দাড়িতে চিরুনী ব্যবহার বা হাতের আঙ্গুল দিয়ে খেলাল করাও যাবে না । কারন এতে চুল দাড়ি ছিড়ে যাবার আশংকা থাকে । দেহের কোথাও চুলকালে এমন সতর্কভাবে হাতের তালু দিয়ে নাড়াতে হবে যে, দেহের পশম যেনো ছিড়ে না যায় । সাবান ব্যবহার করা যাবে না । সকল ধরনের গুনাহের কাজ ও কথা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে । কারো দোষ ত্রুটি বর্ণনা করা যাবে না । কারো গীবত করা যাবে না । কারো নিন্দা বা বদনাম করাও যাবে না । কোনো খাদ্য মুখে ভালো না লাগলে, খাওয়া থেকে বিরত থাকা ভালো কিন্তু উক্ত খাদ্যের বদনাম করা যাবে না । তবে দেশ জাতি, নিজের সংসার, সন্তানাদি ও ব্যবসা সংক্রান্ত কথাবার্তা বলা যাবে ।  ---(চলবে)
"শারঈ' মানদন্ডে
দোয়া-যিকির, হজ্জ ও উমরা
"
Shameem Sayedee- শামীম সাঈদী

শুক্রবার, ২৯ মে, ২০১৫

৬২ বছর আগে হজ যেমন ছিল

হজ্জ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । হাজার বছর ধরে বিশ্বের সামর্থ্যবান মুসলমানরা হজ্জ পালন করে আসছেন । তবে সব সময়ই সবকিছু একই রকম থাকেনি । দিনে দিনে হজ্জ পালনের স্থানগুলোতে পরিবর্তন এসেছে । পরিবর্তন এসেছে স্থাপনাগুলোতেও ।
দেখে নিন ১৯৫৩ সালে হজ্জ পালন কীভাবে হতো । যদিও মাত্র ৬২ বছরের ব্যাপার, তবু পরিবর্তন কিন্তু কম হয়নি । বছর বছর হজ্জ করতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলায় অনেক কিছুতেই আনতে হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন । ছবিগুলো ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের একটি পুরনো সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল
 অনেক হজ্জযাত্রী মক্কা যেতেন ফেরিতে বা জাহাজে করে । ওই সময় বাণিজ্যিক বিমান পরিবহন ছিল শুরুর পর্যায়ে, আজকের দিনের মতো সব জায়গায় তা সহজলভ্য ছিল না ।
 যাঁদের সামর্থ্য ছিল, তাঁরা আশপাশের দেশ থেকে ছোট ছোট বিমানে করে যেতেন মক্কায় ।
 আজকের দিনের মতোই কোচে বা বাসে চড়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতেন হজ্জে যাওয়া লোকজন । 
 হজ্জ পালনের স্থানগুলোতে শুধু মুসলিমরাই প্রবেশ করতে পারে । 
 পবিত্র মসজিদের চারপাশে দেখা যাচ্ছে বাড়িঘর ও হোটেল । মসজিদটির সম্প্রসারণের জন্য এসব ঐতিহাসিক ভবনের অধিকাংশই ধ্বংস করতে হয়েছে ।
 মসজিদুল হারামের একটি প্রবেশপথ ।
 মসজিদুল হারামের প্রবেশপথের বাইরে নামাজরত মুসল্লি ।
 ওই সময়কার পবিত্র কাবাঘরের একটি ছবি ।
 পবিত্র কাবা ও মাতাফ এলাকা । তখন বাড়তি কোনো ফ্লোর (তলা) ছিল না ।
 হাজি, মুসল্লিরা তখন কাবাঘরে প্রবেশ করতে পারতেন ।
 এখনকার মতো ভিড় থাকত না, তাই তাওয়াফ ছিল সহজ ।
 মসজিদুল হারামের কাছে বাজার ও দোকান ।
 মসজিদুল হারামের কাছে বাজার ও দোকান ।
মসজিদুল হারামের কাছে বাজার ও দোকান ।
 পরিবহনের ক্ষেত্রে ব্যবহার হতো ঘোড়া আর ঘোড়ার গাড়ি ।
 কোরবানির জন্য পশু পছন্দ করে কিনতে পারতেন সব হাজী ।
 হজের সময় কেনা পশু নিজেদের কাছে রাখা যেত ।
 কেনা উটের পাশে নামাজরত হাজী ।


মিনায় আগুন কিংবা স্টোভ ব্যবহার করে নিজেরাই রান্না করতে পারতেন হজে যাওয়া মুসলিমরা ।
 আরাফাত পর্বতের পাশে আরাফাতের ময়দানে টাঙানো কিছু তাঁবু ।
জামারাত হিসেবে ছিল ছোট ছোট স্তম্ভ; শয়তানের প্রতীক হিসেবে যেখানে ঢিল ছোড়া হতো ।


মাথা মুড়াচ্ছেন এক হাজী ।

বদলী হজ্জ ও তার শর্তাবলীঃ

শারীরিক দিক দিয়ে অপারগ হলে হজ্জ আদায়ে ইচ্ছুক নারী বা পুরুষ আরেকজনকে প্রতিনিধি নিয়োগ করে হজ্জ আদায় করতে পারেন, এ প্রক্রিয়াকেই বদলী হজ্জ  বলে । কেউ কাউকে প্রতিনিধি করে পাঠালে যার পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করা হচ্ছে, ইহরামের সম তার পক্ষে হজ্জের নিয়ত করতে হবে । ইসলামী চিন্তাবিদগণ বদলী হজ্জ করার বেশ কিছু শর্তের  কথা উল্লেখ করেছেন । এসব শর্তের সাথে কোন কোন চিন্তাবিদ ঐক্যমত পোষণ করেছেন কেউ কেউ আবার দ্বিমতও পোষণ করেছেন ।

কেউ বলেছেন, হজ্জ ফরজ হয়েছিলো এমন ব্যক্তি যদি ইন্তেকাল করে, তাহলে তার পক্ষ থেকে তার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে ব্যয় করে বদলী হজ্জ করা যাবে । কেউ বলেছেন, মৃত ব্যক্তি যদি তার পক্ষ থেকে হজ্জ আদায়ের অসিয়ত করে যায় তাহলেই কেবল বদলী হজ্জ করা যাবে ।
বদলী হজ্জ যিনি করতে যাচ্ছেন, তাকে অবশ্যই নিয়ত করতে হবে যে, আমি অমুকের পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করতে যাচ্ছি । যার পক্ষ থেকে বদলী হজ্জ করা হচ্ছে, হজ্জের সমুদয় ব্যায়ভার তাকেই বহন করতে হবে । ---(চলবে)
"শারঈ' মানদন্ডে
দোয়া-যিকির,হজ্জ ও উমরা"
Shameem Sayedee - শামীম সাঈদী

বৃহস্পতিবার, ২৮ মে, ২০১৫

আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সম্পর্কে না জানা কিছু কথা এবং তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের অসঙ্গতিসমূহ ।

আসুন প্রথমেই তার সম্পর্কে কিছু জেনে নেই ।
জনাব আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ এর বিষয়ে যে তথ্যটি আপনার জানা উচিৎ: মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তার জেরায় পরিস্কারভাবে স্বীকার করেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত জনাব মুজাহিদের বিরুদ্ধে ফরিদপুর জেলাধীন কোনো থানায় বা বাংলাদেশের ৬৫টি জেলার অন্য কোন থানায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সংঘটিত কোনো অপরাধের জন্য কোনো মামলা হয়েছে, এমন তথ্য তিনি তার তদন্তে পাননি।
শুধু আপনার নয়, জাতির বিবেকের কাছে উত্থাপন

তদন্তকারী কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, 
জনাব আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ আলবদর, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আশ শামস বা এই ধরনের কোনো সহযোগী বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, এমন কোনো তথ্য তিনি তার তদন্তকালে পাননি। তারপরও মাননীয় ট্রাইব্যুনাল তাকে আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন !
প্রমান কই ?

আলী আহসান মো: মুজাহিদ মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। সরকারের কোনো দায়িত্বশীল পদে তিনি ছিলেন না। তার সাথে সামরিক-বেসামরিক কোনো ব্যক্তির কোন বৈঠক হয়েছে, বা কোনো কমিটিতে তার নাম আছে, এমন একটি তথ্যও রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করতে পারেনি ।

জনাব আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ এর উপর আনিত অভিযোগ নং ১- সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন অপহরণ ও হত্যা এর অসঙ্গতিঃ 

মৃত সিরাজুদ্দিন হোসেনের ছেলে জেরায় নিজেই স্বীকার করেছেন, তার পিতাকে অপহরণের পরপর তিনি ১৯৭২ সালে রমনা থানায় দালাল আইনে একটি মামলা করেছিলেন । ওই মামলায় তিনি সাক্ষ্যও দিয়েছিলেন । এই মামলায় আসামি জনৈক খলিল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছিল এবং বিচারে তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় । 

মৃত সিরাজুদ্দিন হোসেনের পরিবারের পক্ষ থেকে সিরাজুদ্দিন হোসেনের হত্যাকাণ্ডের ব্যপারে যে সব স্মৃতিচারণমূলক লেখা হয়েছে তার কোথাও আলী আহসান মুজাহিদকে জড়িয়ে কোনো কথা লেখা হয়নি ।
আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ এর উপর আনিত অভিযোগ নং ৩- ফরিদপুরের জনৈক মুক্তিযোদ্ধা রঞ্জিত কুমার নাথকে আটক ও নির্যাতন এর অসঙ্গতিঃ 

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন যে রঞ্জিত নাথকে নিগৃহীত করার ঘটনা তার জব্দকৃত কোনো বইয়ে উল্লেখ ছিল না । ফরিদপুর জেলা প্রশাসন থেকে তদন্তকারী কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং বধ্যভূমির তালিকাসহ নিহত ব্যক্তিদের যে তালিকাটি সংগ্রহ করেছিলেন সেই তালিকায়ও রঞ্জিত নাথের নাম নেই ।
আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ এর উপর আনিত অভিযোগ নং ৫ - নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলে বেশ কয়েকজন বন্দীকে নির্যাতন করে হত্যা এর অসঙ্গতিঃ
এই অভিযোগের প্রসিকিউশন সাক্ষী তার জেরায় বলেছেন, ২৯ আগষ্ট সকালে পত্রিকায় কিছু ব্যক্তির আটকের খবর পেয়ে ওই দিনই বিকেলে তিনি তার চাচার সাথে রমনা থানায় গিয়েছিলেন এবং সেখানে গিয়ে বদি, রুমি (জাহানার ইমামের ছেলে), জুয়েল, আজাদ, আলতাফ মাহমুদসহ আরো ২০/২৫ জনকে দেখেছিলেন ।  অথচ প্রসিকিউশন কর্তৃক সরবরাহকৃত জাহানারা ইমামের নিজের লেখা বই ‘একাত্তরের দিনগুলি’ থেকে জানা যায় উপরোক্তদের কেউই ৩০ আগষ্ট মধ্যরাতের আগে গ্রেফতার হয়নি ।


 আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ এর উপর আনিত অভিযোগ নং ৬- ঢাকার মোহাম্মাদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে বুদ্ধিজীবী হত্যা এর অসঙ্গতিঃ 

রাষ্ট্রপক্ষ জনাব মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট
কোন অভিযোগ আনতে ব্যর্থ হয়েছে । যেমনঃ  তিনি কতজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছেন তাদের কোনো সংখ্যা নেই ।
 সেই সব বুদ্ধিজীবীর নামও নেই ।
কোনোদিন, কোথায় তারা নিহত হয়েছে তারও কোনো বিবরণ নেই ।
এমনকি বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের কোন লোক সাক্ষী দিতে আসেননি ।

আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ এর উপর আনিত অভিযোগ ও রায়ের অসঙ্গতিঃ 

প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরালিয়েনসহ অন্যান্য ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে যত বিচার হয়েছে সেখানে বেশির ভাগ সাক্ষী ছিলেন নিহতদের পরিবারবর্গের সদস্যবৃন্দ । অন্যদিকে বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালে জনাব মুজাহিদকে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো অথচ সেই বুদ্ধিজীবী একজনেরও নাম প্রকাশ করা হলো না এবং তাদের পরিবারের কাউকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা হলো না !

আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ এর উপর আনিত অভিযোগ নং ৭-  বাকচরে হত্যাযজ্ঞ এর অসঙ্গতিঃ 

এই মামলার একজন সাক্ষী শোনা সাক্ষী । 
আর আরেকজন বর্তমানে ভারতে থাকলেও ট্রাইবুনালে এসে বাংলাদেশে থাকার দাবি করেন । 
সাক্ষী শক্তি সাহা তার পিতার হত্যার বিচার চেয়ে ট্রাইবুনালে সাক্ষী দিলেও জেরার একপর্যায়ে তিনি স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশে তার সুদীর্ঘকাল অবস্থান কালে তিনি তার বাবার হত্যার ব্যাপারে কোনো থানায় বা আদালতে কোনো অভিযোগ দায়ের করেনি। তার বড়ভাই ফরিদপুরেই আছেন । সেই ভাই তার বাবার মৃত্যুসংক্রান্ত কোনো মামলা করেছেন কি না তার জানা নেই ।
ওই সাক্ষী গাব গাছের উপরে বসে তার পিতার হত্যাকাণ্ড দেখার বর্ননা করেছেন যা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয় ।
আসুন এ পর্যায়ে একটা আয়াত ও হাদীস সম্পর্কে অবগত হইঃ

সবশেষে একটু মাথা খাটানোর অনুরোধ করবো । একটু ভাবে দেখুন বিষয়টাঃ

সব অবস্থায় ধৈর্য্য ধারন করার বিষয়েই ইসলাম শিক্ষা দেয় । আর বিরুদ্ধবাদী, ইসলাম বিরোধীদের এটা অবশ্যই মনে রাখা উচিৎঃ আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ।  
আরো জানতে লাইক করুনঃ Free Jamaat Leaders BD

বুধবার, ২৭ মে, ২০১৫

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত


জিয়াউর রহমান (জন্ম: ১৯ জানুয়ারি, ১৯৩৬ - মৃত্যু: ৩০ মে, ১৯৮১) বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি এবং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এই  সাবেক সেনাপ্রধান । ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন । মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করে । মুক্তিযুদ্ধের পর জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি চার বছর বাংলাদেশ শাসন করার পর ১৯৮১ সালের ৩০শে মে এক  সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন ।

জন্ম ও শৈশব
জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯শে জানুয়ারি বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম ছিল মনসুর রহমান এবং মাতার নাম ছিল জাহানারা খাতুন ওরফে রানী । পাঁচ ভাইদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয় । তাঁর পিতা কলকাতা শহরে এক সরকারি দপ্তরে রসায়নবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন । তাঁর শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতা শহরে অতিবাহিত হয় । ভারতবর্ষ বিভাগের পর তাঁর পিতা পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি শহরে চলে যান । তখন জিয়া কলকাতার হেয়ার স্কুল ত্যাগ করেন এবং করাচি একাডেমী স্কুলে ভর্তি হন । ঐ স্কুল থেকে তিনি ১৯৫২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং তারপর ১৯৫৩ সালে করাচিতে ডি.জে. কলেজে ভর্তি হন । একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে জিয়ার সামরিক জীবন
১৯৫৩ সালে তিনি কাকুল পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন । ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন । সামরিক বাহিনীতে তিনি একজন সুদক্ষ প্যারাট্রুপার ও কমান্ডো হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন এবং স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন । করাচীতে দুই বছর চাকুরি করার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আসেন । ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন ।  ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরে  খালেদা খানমের সঙ্গে জিয়াউর রহমান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন । ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন । যুদ্ধে দুর্ধর্ষ সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য যেসব কোম্পানি সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করে, জিয়াউর রহমানের কোম্পানি ছিল এদের অন্যতম । 

এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার জিয়াউর রহমানকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভূষিত করে । এছাড়াও জিয়াউর রহমানের ইউনিট এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য দুটি সিতারা-ই-জুরাত এবং নয়টি তামঘা-ই-জুরাত মেডাল লাভ করে । ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে পেশাদার ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন । সে বছরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন । ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হয়ে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন । এডভান্সড মিলিটারি এন্ড কমান্ড ট্রেনিং কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানিতে যান  এবং কয়েক মাস বৃটিশ আর্মির সাথেও কাজ করেন । ১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গভীর রাতে অতরকিত পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায় । সে রাতে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় বাঙালি নেতা শেখ মুজিবর রহমান বন্দী হন । পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে । জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে । এই সঙ্কটময় মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদ্রোহ করেন এবং ২৭শে মার্চ তিনি  শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন । 

“ অনুবাদঃ আমি,মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমাণ্ডার-ইন-চিফ, শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি । আমি আরো ঘোষণা করছি যে, আমরা শেখ মুজিবর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর । এ রাষ্ট্র সকল জাতীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং বিশ্বশান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে । আমি সকল দেশের সরকারকে তাদের নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি । শেখ মুজিবর রহমানের সরকার একটি সার্বভৌম ও আইনসম্মত সরকার এৰং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবার দাবিদার ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদান

মেজর জিয়া এবং তাঁর বাহিনী সামনের সারি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং বেশ কয়েকদিন তাঁরা চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে সক্ষম হন । পরবর্তীতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অভিযানের মুখে কৌশলগতভাবে তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করেন । ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে প্রথমে তিনি ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন  এবং চট্রগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রাম, নোয়াখালী,রাঙ্গামাটি, মিরসরাই, রামগড়, ফেণী প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন । তিনি সেনা-ছাত্র-যুব সদস্যদের সংগঠিত করে পরবর্তীতে ১ম,৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই তিনটি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রথম নিয়মিত সশস্ত্র ব্রিগেড জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন । স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান, যুদ্ধ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন । ১৯৭১ সালের এপ্রিল হতে জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এবং তারপর জুন হতে অক্টোবর পর্যন্ত যুগপৎ ১১ নম্বর সেক্টরের ও জেড-ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয় ।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে জিয়ার সামরিক জীবন

স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার নিয়োগ করা হয় এবং ১৯৭২ সালের জুন মাসে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ-অফ-স্টাফ নিযুক্ত হন । ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে,ঐ বছরের শেষের দিকে মেজর জেনারেল পদে এবং ১৯৭৫ সালের ২৫ শে আগস্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন । ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি বাংলাদেশ সেনা বাহিনী হতে অবসর গ্রহণ করেন ।
৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লব 
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকান্ডের পর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন । তারপরে ঐ বছরের ২৫শে আগষ্ট জিয়াউর রহমান চীফ অফ আর্মী স্টাফ নিযুক্ত হন ।  ঐ বছরের ৩রা নভেম্বর বীর বিক্রম কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় বীর উত্তম মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এক ব্যার্থ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান । 

এর ফলে ৬ই নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হন । 
এর পর জিয়াউর রহমানকে চীফ-অফ-আর্মি স্টাফ হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং তাঁর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয় যা সেনাবাহিনীর মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তার কারনে অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় । সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুদ্ধ সেনাসদস্যরা বীর উত্তম কর্নেল (অবঃ) আবু তাহেরের নেতৃত্বে ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতার আরেক পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায় এবং ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সেনাসদস্যরা লেঃ কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) নেতৃত্বে, জিয়াউর রহমানকে তাঁর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত করে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সদরদপ্তরে নিয়ে আসে । ঐ দিন সকালেই পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় কর্নেল (অবঃ) আবু তাহেরের অধীনস্থ সৈন্যরা ক্যাপ্টেন জলিল ও ক্যাপ্টেন আসাদের নেতৃত্বে শেরে বাংলা নগরে ১০ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদরদপ্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম,কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম এবং লেঃ কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তম কে হত্যা করে ।
২০১৩ সালের ২০ই মে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, ১৯৭৬ সালে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে করা তাহেরের বিচার এবং মৃত্যুদন্ডকে 'অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষনা করে এবং এটিকে হত্যাকান্ড হিসেবে অভিহিত করে ।
রাষ্ট্রপতি জিয়া
১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহি জনতা বিপ্লবের পর তিনি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন । ১৯শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তাঁকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চীফ অফ আর্মী স্টাফ পদে দায়িত্বে প্রত্যাবর্তন করা হয় এবং উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয় ।  ১৯৭৬ সালের ২৯শে নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন । জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ৮ই মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন করেন, ১৯৭৬ সালে কলম্বোতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ ৭ জাতি গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি লাভ করেন । ১৯৭৬ সালেই তিনি উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন উদ্বোধন করেন । ১৯৭৬ সালে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন, ১৯৭৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি একুশের পদক প্রবর্তন করেন এবং রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েমকে কৌশলে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ফেলার পর 

২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন । রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়া দেশে আবার গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ নেন । তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন । দেশের রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে দেন । ১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন । এই নির্বাচনে মোট ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, এ নির্বাচনে ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেন । ২ জনের মনোনয়নপত্র বাছাই –এ বাদ পড়ায় বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা ৯ জন । ১ জন আপীল দাখিল করায় ও তাঁর আপীল গৃহীত হওয়ায় এবং কোন প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা ১০ জন ছিল । এরপর জিয়াউর রহমান মে মাসে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০শে মে গণভোট অনুষ্ঠান হয় এবং হাঁ-সূচক ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন ।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদন
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব প্রদান করে তা জনপ্রিয় করে তোলেন । বাংলাদেশে বহু সংখ্যক বিভিন্ন ধরনের মতের ও ধর্মের নানা জাতিগোষ্ঠী বাস করে । তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মাত্রা ও ধরন একে অপরের থেকে ভিন্ন । তাই জিয়া মনে করেন যে, ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, ভূখণ্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত । তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্ত্ব আরোপ করেন এবং এই ধারণা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে শক্তিশালী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালান ।

আইন শৃঙ্খলা
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জিয়াউর রহমান দেশে শান্তি শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেন । এতদুদ্দেশ্যে তিনি পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করেন । পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করে তিনি তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা গ্রহণ করেন । ‍সশস্ত্র বাহিনীতেও তিনি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন । এতদুদ্দেশ্যে তিনি কঠোর প্রশিক্ষণ ব্যাবস্থার মাধ্যমে ‍সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলা উন্নয়নের কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তাদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করেন । ‍সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট সফল হলেও জিয়াউর রহমানকে বেশ কয়েকটি সেনা-বিদ্রোহ ও সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মোকাবেলা করতে হয় । এসব বিদ্রোহ দমনে বাধ্য হয়ে তাঁকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় ।
বহুদলীয় গণতন্ত্র
নির্বাচন ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং অবাধ রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সুযোগ প্রদানের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান যত দ্রুত সম্ভব রাজনীতির গণতন্ত্রায়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন । এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের আমলে নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । এইভাবে, তিনি সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন, সংবাদপত্রের মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন । বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান করেন । ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রধান করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করেন । ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন । এই নির্বাচনে তিনি ৭৬.৬৭% ভোট পেয়ে বিজয়ী হন এবং রাষ্ট্রপতির পদে  অধিস্ট হন ।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)

১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন । বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়া এই দলের চেয়ারপারসন (Chairperson)। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন এবং এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন । অধ্যাপক ডাঃ এ. কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এর প্রথম মহাসচিব ছিলেন । জিয়ার এই দলে বাম, ডান ও মধ্যপন্থীসহ সকল স্তরের লোক ছিলেন । বিএনপির সব থেকে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর নিয়োগ পদ্ধতি । প্রায় ৪৫% সদস্য শুধুমাত্র রাজনীতিতে নতুন ছিলেন তাই নয়, তারা ছিলেন তরুণ । ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু করেন । জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ ছাড়াও প্রায় দুই ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন । সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের আহবায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যদের নাম এবং ১৯শে সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন । এখানে উল্লেখ্য যে, বিএনপি গঠন করার আগে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছিল । ২৮শে আগস্ট ১৯৭৮ সালে নতুন দল গঠন করার লক্ষ্যে জাগদলের বর্ধিত সভায় ওই দলটি বিলুপ্ত ঘোষণার মাধ্যমে দলের এবং এর অঙ্গ সংগঠনের সকল সদস্য জিয়াউর রহমান ঘোষিত নতুন দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । তিনি রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । এ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে । নির্বাচনে অংশ নিয়ে আব্দুল মালেক উকিল এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জয়লাভ করে । এছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৮টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১টি ও মুসলিম ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি আসনে জয়লাভ করে ।
জিয়া প্রবর্তিত উন্নয়নের রাজনীতির কতিপয় সাফল্য:
সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান ।
জাতীয় সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ।
বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া ।
দেশে কৃষি বিপ্লব, গণশিক্ষা বিপ্লব ও শিল্প উৎপাদনে বিপ্লব ।
সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাশ্রম ও সরকারী সহায়তার সমন্বয় ঘটিয়ে ১৪০০ খাল খনন ও পুনর্খনন ।
গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে অতি অল্প সময়ে ৪০ লক্ষ মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দান ।
গ্রামাঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা প্রদান ও গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) গঠন ।
গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ করা ।
হাজার হাজার মাইল রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ।
২৭৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিয়োগ করে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ ।
নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা স্থাপনের ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ ।
কলকারখানায় তিন শিফট চালু করে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি ।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশকে খাদ্য রপ্তানীর পর্যায়ে উন্নীতকরণ ।
যুব উন্নয়ন মন্ত্রাণালয় ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুব ও নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণ ।
ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্টা করে সকল মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালনের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিকরণ ।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন ।
তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করণ এবং সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন ।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আসনলাভ ।
তিন সদস্যবিশিষ্ট আল-কুদস কমিটিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি ।
দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে 'সার্ক' প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ ।
বেসরকারিখাত ও উদ্যোগকে উৎসাহিতকরণ ।
জনশক্তি রপ্তানি, তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পসহ সকল অপ্রচলিত পণ্যোর রপ্তানীর দ্বার উন্মোচন ।
শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ ।
জিয়াউর রহমানের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, বিএনপি প্রতিষ্ঠার পরপরই জিয়াউর রহমান দলের কর্মীদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে কর্মশালা আয়োজনের উদ্যোগ নেন, যার মাধ্যমে দলের কর্মীদের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, দলের আদর্শ, সাংগঠনিক নিয়ম-কানুন ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হত ।
১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে এরকম একটি কর্মশালা উদ্বোধনকালে তিনি দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেনঃ “ কোন রাজনৈতিক আদর্শ ধর্মকে ভিত্তি করে হতে পারে না । একটা অবদান থাকতে পারে । কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে কখনওই রাজনীতি করা যেতে পারে না । অতীতে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে ধর্মকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সময়ে যখনই রাজনীতি করা হয়েছিল সেটা বিফল হয়েছে । কারণ ধর্ম ধর্মই । আমাদের অনেকে আছে যারা আমাদের দেশে যে বিভিন্ন ধর্ম রয়েছে, সেগুলোকে কেন্দ্র করে রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেন । রাজনীতির রূপরেখা বানাতে চেষ্টা করেন, আমরা বারবার দেখেছি তারা বিফল হয়েছে । ধর্মের অবদান থাকতে পারে রাজনীতিতে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ধর্মকে কেন্দ্র করে হতে পারে না" । 
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর জিয়া বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতিমালায় বিশেষ পরিবর্তন আনেন । মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে বিশেষ একটি কূটনৈতিক অবস্থানের সৃষ্টি হয়, যার ফলে বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী ভারত সহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুতা অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক নৈকট্য গড়ে তুলেছিল । রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক স্নায়ু যুদ্ধের তৎকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেন যার দুটি মূল দিক ছিল সোভিয়েত ব্লক থেকে বাংলাদেশের সরে আসা ও মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্থাপন করা । জিয়াউর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যাতীত প্রাচ্যের আরেক পারমাণবিক শক্তি চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন । তাঁর পররাষ্ট্রনীতি সংস্কার প্রক্রিয়ার আওতায় আরও ছিল বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ, যে সম্পর্কে স্বাধীনতার পর থেকেই শৈতল্য বিরাজ করছিল । 





মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সুবিধা ও উপকারিতা বাংলাদেশ আজও পুরোমাত্রায় উপভোগ করছে, কেননা বর্তমানে সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মস্থলে পরিণত হয়েছে তার রূপরেখা জিয়াই রচনা করে গিয়েছিলেন  । এক্ষেত্রে সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সাথে স্থাপিত সম্পর্ক অনেকটা অর্থনৈতিক হলেও যুক্তরাষ্ট্র  ও চীনের সাথে স্থাপিত সম্পর্কে সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুগুলোও প্রাসঙ্গিক ছিল । বিশেষ করে চীনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পূণর্গঠনের কাজ অনেকটা তরান্বিত করেছিলেন । বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অস্ত্রাগারের দিকে তাকালে সেই সত্যই প্রতিফলিত হয় । সামরিক পূণর্গঠনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সাথে উন্নত কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে জিয়া রাষ্ট্রীয় বিমান পরিবহন সংস্থা বিমানের আধুনিকীকরণও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন  । এছাড়াও প্রেসিডেন্ট জিয়ার পররাষ্ট্র নীতির সাফল্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালে শক্তিশালী জাপানকে হারিয়ে প্রথমবারের মত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ লাভ ।