লে. কর্নেল তাহের যেহেতু সরাসরি জাসদ সৃষ্টির গোপন প্রক্রিয়ার সাথে ছিলেন না, কিন্তু ‘র’ এর প্রেসক্রিপশনে বানানো জাসদের নেতাদের সাথে সরাসরি চাকুরীকালিন সময় থেকেই জড়িত থাকার কারনে একটি ঘোরের মধ্যে ছিলেন । সেনাবাহিনীতে চাকুরীরত অবস্থায় একসময় বিপ্লবী সিরাজ সিকদারের সাথে জড়িত এই তাহের ও তার ভাইদের বুর্জোয়া অবস্থানের কারনে বিপ্লবী সিরাজ সিকদার বিপ্লবের কোন দায়িত্ব দিতে অস্বীকার করলে তারা বের হয়ে যান । ‘র’ এর আর্থিক, লজিস্টিক সাপোর্টে গড়ে তোলা জাসদ ‘রুশ-ভারতের’ দালালেরা হুশিয়ার সাবধান শ্লোগান দিয়ে উঠতি বিপ্লবী যুব শক্তিকে বিভ্রান্ত করে দেয় । লে কর্নেল তাহের নিজেও সেইভাবে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন কিনা তা গবেষণার দাবী রাখে। তবে সেনাবাহিনীকে সৈনিকদের নেতৃত্ব নির্ভর করতে গিয়ে অফিসারদের হত্যাকাণ্ডের মত ধ্বংসযজ্ঞের কাজটির জন্য তার শাস্তি অবধারিত ছিল ।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের সেনা অভ্যুত্থানে তৎকালীন বাকশালি শাসক শেখ মুজিবর রহমানের সরকার পতনের পরে একটি জাতীয় সরকার না হয়ে খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে আওয়ামী সরকার পুনর্বহাল হলে আগস্ট পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে অনেকেই সন্দিহান হয়ে পড়েন । সেই সন্দেহ সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র গোলযোগ ও অনৈক্যকে উস্কে দেয় বাংলাদেশে অবস্থারত ভারতের স্লিপার সেলগুলো । সাথে বিভিন্ন খেলায় জড়িয়ে পরে অন্যান্য দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যারা ১৫ আগস্টের আগে থেকেই নানানভাবে তাদের খেলা চালিয়ে যাচ্ছিল ।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশারফ নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা দিয়ে একটু ক্যু দেতা ঘটালে সেই সুযোগটি গ্রহন করে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা । তারা সেনা অফিসার হত্যার কাজটি শুরু করে । ইতিমধ্যেই ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী সেনা অফিসার, সৈনিক ও জনতা পাল্টা রুখে দাড়ায় । তাহের গং খালেদ মোশারফের হাতে বন্দী থাকা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করে নিজেদের পক্ষে নিতে চাইলেও ইতিমধ্যেই দেশপ্রেমিক পক্ষ জেনারেল জিয়াকে নিজেদের কাছে নিয়ে নেয় । জেনারেল জিয়াউর রহমান এদেশের মাটি ও মানুষকে চিনতেন, বুঝতেন বলেই তিনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের দালালদের পক্ষে না গিয়ে দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে চলে যান । জাতীয়তাবাদ একটি চেতনা । এই চেতনা আবহমানকাল থেকেই প্রতিটি জাতির মধ্যেই থাকে । জাতীয়তাবাদী বললেই অনেকে মনে করেন বিএনপি । এটি মূর্খদের স্বল্প জ্ঞানের পরিচায়ক । যাক ৭ নভেম্বরের এই ঘটনার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ও চূড়ান্তভাবে জেনারেল জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান ঘটে । এরপর ইতিহাস তাকে ধীরে ধীরে তার আসন নিশ্চিত করে দেয় আর সেই আসনে বসে তিনি সংগঠিত করেন ভারতীয় আদিপত্যবাদ বিরোধী দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদীদের । নেতৃত্ব দেন এই শক্তির ।
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা তথা গণবাহিনী ও জাসদের ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লবে ব্যর্থতার পরে স্বাভাবিকভাবেই শত শত হত্যাকাণ্ডের জন্য সামরিক আদালতে বিচারের আয়োজন করা হয় । এই হত্যাকাণ্ড গুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন পথ স্বাভাবিকভাবেই ছিল না । তারপরেও জেনারেল আব্দুর রহমানের মাধ্যমে কেউ কেউ ছাড়া পেয়ে যান । জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম । ধারনা করা হয় লো প্রফাইলে থাকার কারনে ভারতীয় পক্ষ থেকে তাকে মুক্ত করে নেয়া হয় ভিন্ন প্রক্রিয়ায় । জেনারেল মঞ্জুর সর্বদাই তাহেরের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। কিন্তু জেনারেল শফিউল্লাহ ১৫ আগস্ট ঘটনার পরেই তাকে দেশের বাইরে পোস্টিং দিয়ে দেন । যে কারনে সেই যাত্রা বেঁচে যান তিনি । তবে পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান হত্যার সাথে তার সম্পৃক্ততা অনেক আগে থেকেই তার সংযুক্তিকে প্রমানিত করে ।
মূলত ৭ নভেম্বরের মাধ্যমেই ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী জাতির নব উন্মেষ ঘটে। ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ । এরই ধারাবাহিকতায় জাতি পায় ‘বাংলাদেশী’ নামের একটি আইডেনটিটি । জেনারেল জিয়াউর রহমানের উত্থান ও সাফল্য বাংলাদেশে ধীরে ধীরে বিপ্লবীদেরও গতিকে শ্লথ করিয়ে দেয় । ভারতীয় প্রেসক্রিপশনের কথিত বিপ্লবীদের বিদায় ঘটে । তাদের সাথে সত্যিকারের বিপ্লবের জন্য যারা জড়িয়ে গিয়েছিলেন তারা ফিরে এসে নিজেদের নিয়োগ করেন দেশ, জাতি ও পরিবার গড়ার কাজে । এইভাবেই ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লব ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি’ দিবসে পরিনত হয় । ভারতের সাথে ২৫ শালা দাসখতের বিপরীতে বাংলাদেশ নিজের পায়ে ঘুরে দাঁড়ায় । (শেষ)
লেখকঃ শেখ মহিউদ্দিন আহমেদ (রাজনীতিবিদ এবং স্ট্র্যাটেজিক এনালিস্ট)