বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৬

৭ নভেম্বরঃ ইতিহাসের ইতিহাস -(২)

লে. কর্নেল তাহের যেহেতু সরাসরি জাসদ সৃষ্টির  গোপন প্রক্রিয়ার সাথে ছিলেন না, কিন্তু ‘র’ এর প্রেসক্রিপশনে বানানো জাসদের নেতাদের সাথে সরাসরি চাকুরীকালিন সময় থেকেই জড়িত থাকার কারনে একটি ঘোরের মধ্যে ছিলেন । সেনাবাহিনীতে চাকুরীরত অবস্থায় একসময় বিপ্লবী সিরাজ সিকদারের সাথে জড়িত এই তাহের ও তার ভাইদের বুর্জোয়া অবস্থানের কারনে বিপ্লবী সিরাজ সিকদার বিপ্লবের কোন দায়িত্ব দিতে অস্বীকার করলে তারা বের হয়ে যান । ‘র’ এর আর্থিক, লজিস্টিক সাপোর্টে গড়ে তোলা জাসদ ‘রুশ-ভারতের’ দালালেরা হুশিয়ার সাবধান শ্লোগান দিয়ে উঠতি বিপ্লবী যুব শক্তিকে বিভ্রান্ত করে দেয় । লে কর্নেল তাহের নিজেও সেইভাবে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন কিনা তা গবেষণার দাবী রাখে। তবে সেনাবাহিনীকে সৈনিকদের নেতৃত্ব নির্ভর করতে গিয়ে অফিসারদের হত্যাকাণ্ডের মত ধ্বংসযজ্ঞের কাজটির জন্য তার শাস্তি  অবধারিত ছিল ।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের সেনা অভ্যুত্থানে তৎকালীন বাকশালি শাসক শেখ মুজিবর রহমানের সরকার পতনের পরে একটি জাতীয় সরকার না হয়ে খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে আওয়ামী সরকার পুনর্বহাল হলে আগস্ট পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে অনেকেই সন্দিহান হয়ে পড়েন । সেই সন্দেহ সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র গোলযোগ ও অনৈক্যকে উস্কে দেয় বাংলাদেশে অবস্থারত ভারতের স্লিপার সেলগুলো । সাথে বিভিন্ন খেলায় জড়িয়ে পরে অন্যান্য দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যারা ১৫ আগস্টের আগে থেকেই নানানভাবে তাদের খেলা চালিয়ে যাচ্ছিল ।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশারফ নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা দিয়ে একটু ক্যু দেতা ঘটালে সেই সুযোগটি গ্রহন করে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা । তারা  সেনা অফিসার হত্যার কাজটি শুরু করে । ইতিমধ্যেই ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী সেনা অফিসার, সৈনিক ও জনতা পাল্টা রুখে দাড়ায় । তাহের গং খালেদ মোশারফের হাতে বন্দী থাকা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করে নিজেদের পক্ষে নিতে চাইলেও ইতিমধ্যেই দেশপ্রেমিক পক্ষ জেনারেল জিয়াকে নিজেদের কাছে নিয়ে নেয় । জেনারেল জিয়াউর রহমান এদেশের মাটি ও মানুষকে চিনতেন, বুঝতেন বলেই তিনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের দালালদের পক্ষে না গিয়ে দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে চলে যান । জাতীয়তাবাদ একটি চেতনা । এই চেতনা আবহমানকাল থেকেই প্রতিটি জাতির মধ্যেই থাকে । জাতীয়তাবাদী বললেই অনেকে মনে করেন বিএনপি । এটি মূর্খদের স্বল্প জ্ঞানের পরিচায়ক । যাক ৭ নভেম্বরের এই ঘটনার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ও চূড়ান্তভাবে জেনারেল জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান ঘটে । এরপর ইতিহাস তাকে ধীরে ধীরে তার আসন নিশ্চিত করে দেয় আর সেই আসনে বসে তিনি সংগঠিত করেন ভারতীয় আদিপত্যবাদ বিরোধী দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদীদের । নেতৃত্ব দেন এই শক্তির ।

বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা তথা গণবাহিনী ও জাসদের ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লবে ব্যর্থতার পরে স্বাভাবিকভাবেই শত শত হত্যাকাণ্ডের জন্য সামরিক আদালতে বিচারের আয়োজন করা হয় । এই হত্যাকাণ্ড গুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন পথ স্বাভাবিকভাবেই ছিল না । তারপরেও জেনারেল আব্দুর রহমানের মাধ্যমে কেউ কেউ ছাড়া পেয়ে যান । জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম । ধারনা করা হয় লো প্রফাইলে থাকার কারনে ভারতীয় পক্ষ থেকে তাকে মুক্ত করে নেয়া হয় ভিন্ন প্রক্রিয়ায় । জেনারেল মঞ্জুর সর্বদাই তাহেরের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। কিন্তু জেনারেল শফিউল্লাহ ১৫ আগস্ট ঘটনার পরেই তাকে দেশের বাইরে পোস্টিং দিয়ে দেন । যে কারনে সেই যাত্রা বেঁচে যান তিনি । তবে পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান হত্যার সাথে তার সম্পৃক্ততা অনেক আগে থেকেই তার সংযুক্তিকে প্রমানিত করে ।
মূলত ৭ নভেম্বরের মাধ্যমেই ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী জাতির নব উন্মেষ ঘটে। ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ । এরই ধারাবাহিকতায় জাতি পায় ‘বাংলাদেশী’ নামের একটি আইডেনটিটি । জেনারেল জিয়াউর রহমানের উত্থান ও সাফল্য বাংলাদেশে ধীরে ধীরে বিপ্লবীদেরও গতিকে শ্লথ করিয়ে দেয় । ভারতীয় প্রেসক্রিপশনের কথিত বিপ্লবীদের বিদায় ঘটে । তাদের সাথে সত্যিকারের বিপ্লবের জন্য যারা জড়িয়ে গিয়েছিলেন তারা ফিরে এসে নিজেদের নিয়োগ করেন দেশ, জাতি ও পরিবার গড়ার কাজে । এইভাবেই ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লব ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি’ দিবসে পরিনত হয় ।  ভারতের সাথে ২৫ শালা দাসখতের বিপরীতে বাংলাদেশ নিজের পায়ে ঘুরে দাঁড়ায় । (শেষ)
লেখকঃ শেখ মহিউদ্দিন আহমেদ (রাজনীতিবিদ এবং স্ট্র্যাটেজিক এনালিস্ট)

সোমবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৬

৭ নভেম্বরঃ ইতিহাসের ইতিহাস -(১)

বাংলাদেশে ৭ নভেম্বর জাতীয়তাবাদীদের সৃষ্ট কোন দিন না হলেও এই দিবসটি নিয়ে জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে এক ধরনের চেতনা বিরাজ করছে দীর্ঘদিন ধরেই । এই দিনটিকে জাতীয়তাবাদীরা স্মরণ করে সিপাহী জনতার বিপ্লবের দিন হিসেবে । জাতীয়তাবাদীদের মত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরাও এই দিনটিকে পালন করছেন । ইতিহাসের খেলায় জেনারেল জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বরের নায়ক হলেন । অথচ তিনি ৭ নভেম্বরের উদ্যোক্তা ছিলেন না । মূলতঃ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের দীর্ঘ পরিকল্পনার ফসল ৭ নভেম্বর । কিন্তু এটি তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় । কিন্তু কেনো ? কেনইবা ৭ নভেম্বর আজ জাতীয়তাবাদী তথা ভারত বিরোধী জনগোষ্ঠীর এক বিজয়ের দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে ?
ইতিহাস সবসময়েই বিজয়ীর পক্ষে এবং বিজয়ীর গুনগাথা ছাড়া কিছুই নয় । এটাই সত্য যে ৭ নভেম্বর জাতীয়তাবাদীদের সৃষ্ট কোন দিন নয় । ৭ নভেম্বরে জাতীয়তাবাদীদের অবদান কোথায় ?  সেই তথ্য নতুন প্রজন্মের সামনে কেউ তুলে ধরছেন না । স্রোতে গা ভাসানোর মত করেই সবাই এই দিবসটিকে পালন করে যাচ্ছেন । আমি এই দিবসটি নিয়ে বিশাল কোন ব্যাখ্যায় যাবো না । দিবসটির প্রকৃত তথ্য তুলে ধরবো । এক পক্ষকে আমি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী বলছি এই কারনে যে এই আদর্শের দল ‘জাসদ’ আজ বহুধা বিভক্ত একটি দল । এক সময়ে বিপ্লবের চেতনার নামে লাখো দেশপ্রেমিক তরুনের স্বপ্নকে ঐক্যবদ্ধ করে কয়েকটি জেনারেশনকে ধ্বংস করে দেয়া এই জাসদের সৃষ্ট ৭ নভেম্বরের চেতনাও আজ অন্যের দখলে । কিন্তু কেন এটি জানতে হলে জানতে হবে জাসদের জন্ম ইতিহাস । সেই সাথে বাংলাদেশের সৃষ্টির চেপে যাওয়া ইতিহাস; যা ইতিহাসের ইতিহাস ।
জাসদ জন্মের প্রক্রিয়ার সাথে বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রক্রিয়া জড়িত । আর এর মূল নায়ক হলেন জাসদের প্রতিষ্ঠাতা ‘সিরাজুল আলম খান’; যিনি ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদকে নিয়ে ছাত্রলীগের ভেতরেই ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর সহায়তায় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে ছোট একটা সেল বা চক্র তৈরি করেন । পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে গড়তে বুর্জোয়া সংগঠনের ভেতরে বিপ্লবী চেতনা প্রদানে ‘র’ চিত্তরঞ্জন সূতার ও কালিদাস বৈদ্যের মাধ্যমে পুর্ব-পাকিস্তানে সিরাজুল আলম খানকে দিয়ে এই চক্রটি তৈরি করে ।
ইতিহাসের পরিক্রমায় ভারতীয় এই চক্রান্ত টের পেয়ে চীন বিপ্লবী সিরাজ সিকদারকে সহায়তা দিলে তিনি প্রথম ”পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার’ দলিল প্রণয়ন করেন যাতে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হলে তা হবে ভারতীয় আধিপত্যে নিষ্পেষিত স্বাধীনতাকামী জাতি সমুহের স্বাধীনতার ভুল ভিত্তি ভূমি । এই দলিলের পরেই ভারতীয়রা তাদের পরিকল্পনা ভিন্ন ধারায় এগিয়ে নেয় । বিপ্লবী চেতনার পরিবর্তে বুর্জোয়া নেতৃত্বকে মূল শক্তিতে পরিনত করে। পরিকল্পনায় যুক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার একটি ডেস্ক । তাদের লক্ষ্য ছিল চীনের বিপক্ষে ভারতকে শক্তিশালী করতে ভারতের একটি সীমান্তকে নিরাপদ করা ।
যাই হোক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো । বুর্জোয়া নেতৃত্বরা গা ঢাকা দিলেন, শেখ মুজিবর রহমান নিজেই পাকিস্তানীদের হাতে ধরা দিলেন । ঠিক তখনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাংলাভাষী সেনারা  বিদ্রোহ করে এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান (তৎকালীন মেজর) স্বাধীনতা যুদ্ধের অফিসিয়াল ঘোষণা প্রদান করেন । তাকে এই যুদ্ধ ঘোষণা দেয়ার মত চ্যালেঞ্জিং কাজটি করতে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সহায়তা দেয়া হয়েছিল বলেও অনেক তথ্য পাওয়া যায় । তবে যাই হোক না কেন জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা তাকে ইতিহাসে অমর করে দিয়েছে । জেনারেল জিয়া সেদিন এই যুদ্ধ ঘোষণার কাজটি না করলে বুর্জোয়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনোই স্বাধীনতা যুদ্ধকে বাস্তব রুপ দিতে পারতো না এবং ধীরে ধীরে স্বাধীনতা যুদ্ধটি কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের হস্তগত হয়ে এক দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধে পরিনত হতো আর তার সকল প্রাপ্তি ও ফসল যেতো চীন ও তার বন্ধুদের পক্ষে; যা ভারতের অখণ্ডতাকে অনেক আগেই ধ্বংস করে দিতো ।
রাজনীতিতে এই খেলাগুলো এমন জটিল যে সকলের পক্ষে এটি বোঝা সম্ভব নয়; জানাও সম্ভব না । কোন ঘটনার সাথে কোন দেশ কিভাবে যুক্ত হয় তা সবার পক্ষে জানাও সম্ভব নয় । তাই অনেকের কাছে সত্য ইতিহাস, ইতিহাসের ইতিহাসকে গাঁজাখুরি মনে হয় । এমনকি অনেক বিদ্বান পিএইচডি ডিগ্রিধারীরাও এসব বিষয়ে অজ্ঞতাকেই জাহির করেন ।
যুক্তরাষ্ট্র- ভারত বনাম চীনের এই দ্বন্দ্বের ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সহায়তায় ভারত বাংলাদেশকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয় ঘটিয়ে দিতে সক্ষম হলেও পাকিস্তান সৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখা সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের এই জনগোষ্ঠীকে ভারত বিরোধিতার ক্ষেত্রে বিশ্বাস করতে না পারার কারনেই বাংলাদেশ সৃষ্টির ৩ মাসের মধ্যেই ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি ১৯৭২’ নামে একটি ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তি করিয়ে নেয় ১৯৭২ এর ১৯শে মার্চ তারিখে ঢাকায় । এই চুক্তির অনুচ্ছেদ ৮-এ বলা হয়, “কোন দেশ অপর দেশের বিরুদ্ধে কোনরূপ সামরিক জোটে যোগ দিতে পারবে না এবং অপর দেশের বিরুদ্ধে কোন রকম সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে পারবে না এবং তার সীমানাধীন স্থল, জল এবং আকাশ অপর রাষ্ট্রের সামরিক ক্ষতি অথবা অপর রাষ্ট্রের সংহতির প্রতি হুমকিস্বরূপ কোন কাজে ব্যবহার করতে দিতে পারবে না ।” অনুচ্ছেদ ৯-এ বর্ণিত রয়েছে, “একপক্ষ অন্য পক্ষের বিপক্ষে কোন তৃতীয় পক্ষকে যে কোন সামরিক সংঘর্ষে কোন প্রকার সাহায্য দিতে পারবে না । যদি কোন পক্ষ আক্রমণের শিকার হয় কিংবা আগ্রাসনের হুমকির মুখাপেক্ষি হয়, তবে অনতিবিলম্বে দুই পক্ষই পারষ্পরিক আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সেই আক্রমণ কিংবা আগ্রাসনের হুমকির মোকাবেলা করার জন্য । এভাবেই দুই দেশের শান্তি ও সংহতি বজিয়ে রাখা হবে ।” অনুচ্ছেদ ১০-এ বর্ণিত আছে, “এই চুক্তির পরিপন্থী কোন প্রকার অঙ্গীকার কোন পক্ষই অন্য কোন দেশ বা একাধিক দেশের সাথে খোলাভাবে কিংবা গোপনে করতে পারবে না ।”
এমন একটি চুক্তি করেও ভারত নিজেকে নিরাপদ ভাবতে ব্যর্থ হয় । কারন তাদের সমর্থিত আওয়ামী লীগ ও তার রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারে ভারত বিরোধী জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে । মুসলিম এই জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম এমনিতেই পাকিস্তান আমল থেকে বিপ্লবী চেতনায় সমৃদ্ধ হতে শুরু করেছে । ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে চীনপন্থি বিপ্লবী দলগুলোর পক্ষে নতুন প্রজন্মের ব্যপক আকাঙ্ক্ষাকে ধ্বংস করতে ভারতের ‘র’ দুটো উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নিজেরাই একটি বিপ্লবী গোপন সংগঠন দাড় করিয়ে দেয়। গণবাহিনী নামের ঐ সশস্ত্র সংগঠনের গণ সংগঠন হিসেবে থাকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। চীনপন্থি বিপ্লবীদের প্রকাশ্য সংগঠন না থাকার কারনে জাসদের ও গণবাহিনীর পক্ষে গণজাগরণ বাড়তে থাকে। বুর্জোয়া ও সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার জনগোষ্ঠী জাসদকে নির্বাচনী সংগঠন ধরেই আগাতে থাকে। এর মধ্য দিয়ে ভারত বাংলাদেশের ভারত বিরোধী জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করতে সমর্থ হয়। বিপ্লবের নামে ভারত বিরোধী জনগোষ্ঠীর কয়েকটি জেনারেশন ধ্বংস করে দেয় জাসদ রাজনীতির নামে। আর এই ধ্বংসটি করায় আওয়ামী লীগকে দিয়ে।
এরপরেও যখন বিপ্লবের তাণ্ডব কমাতে ব্যর্থতা দেখা যায় কৌশলে তখন ভারত বুর্জোয়া সংগঠন আওয়ামী লীগকে সমাজতান্ত্রিক সংগঠনে পরিনত করার ব্যবস্থা হাতে নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নকে সাথে নিয়ে কৌশলে সোভিয়েত পন্থীদের সাথে সংযোগ ঘটিয়ে ‘বাকশাল’ নামের সমাজতান্ত্রিক দল ও রাষ্ট্র গঠন করে দেয়। এতে করে তারা বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে চীনপন্থি শিক্ষিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে। আর মাঠে থাকে জাসদ ও সশস্ত্র গণবাহিনী। এরই মাঝে গড়ে তোলা হয় ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’; লক্ষ্য বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়া। কারন ইতিমধ্যেই পাকিস্তান ফেরত হাজার হাজার সেনা অফিসার ও সদস্য বাংলাদেশে ফিরে ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে’ যোগ দেন। এই বাহিনীর সবাই এমন এক প্রশিক্ষনের আওতায় গড়ে ওঠা যাদের কাছে ভারত হলো একমাত্র শত্রু রাষ্ট্র। তাই সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে দায়িত্ব আসে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লে কর্নেল তাহেরে কাছে। বিপ্লবের মন্ত্রে তিনি এগিয়ে যান একটি ৭ নভেম্বর গড়তে ।
লেখকঃ শেখ মহিউদ্দিন আহমেদ (রাজনীতিবিদ এবং স্ট্র্যাটেজিক এনালিস্ট) 

রবিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৬

শেখ হাচিনা -ওবায়দুলকাদেরকে অভিনন্দন

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুই দিনব্যাপী ২০ তম জাতীয় সম্মেলন থেকে ঘোষণাঃ
বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হবে নাঃ প্রধানমন্ত্রী ।
🌷🌹
অষ্টমবারের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভানেত্রী হলেন শেখ হাচিনা এবং সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি ওবায়দুল কাদের আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক হলেন ।
🌻🌺 🌷
আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি ঘোষণা করা হয়েছে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের নাম । দলের গুরুত্বপূর্ণ এ কমিটিতে ঘোষণা করা হয়েছে ১৪ জনের নাম।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফরুল্লাহ, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সাহারা খাতুন, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, নুরুল ইসলাম নাহিদ, আব্দুর রাজ্জাক, কর্নেল (অব.) ফারুক খান, আব্দুল মান্নান খান, রমেশ চন্দ্র সেন ও পীযূষ কান্তি চক্রবর্তী।
এ ছাড়া যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলেন, মাহবুব-উল-আলম হানিফ, দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান ।
কোষাধ্যক্ষ পদে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন এইচ এন আশিকুর রহমান ।
কাউন্সিল অধিবেশনে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার জন্য দলীয় সভাপতি শেখ হাচিনার ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেন কাউন্সিলররা ।
🌻🌺 🌷🌹
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাচিনা অষ্টমবারের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ওবায়দুল কাদের দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় এবং নতুন ও পুরনো সকল সভাপতিমন্ডলীর সদস্যদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন ও ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছি ।
আশা করি নবগঠিত কমিটি গুম, খুনহীন, সন্ত্রাসমুক্ত দেশ গঠন, বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করবেন ।
সকলের জন্য শুভ কামনা ।

মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৬

ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালা কি বাদ

কারবালার ইতিহাস আর আমাদের শিক্ষা

বলাবাহুল্য যে, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয় এবং মহররম মাস ও আশুরার (১০ই মুহররম) দিনটা মুসলিম জাহানের উপর চেপে বসা রাজা-বাদশাহ শেখ ও আমির শাসিত রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্যে একটা চরম বিব্রতকর দিন । রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারনে স্বৈরাচারী শাসক ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে ৬১ হিজরীতে এদিন মহানবীর দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু শাহাদাত বরন করেছিলেন । ইসলামের ইতিহাসে অনেক নবী রসুলসহ খলিফা হযরত উসমান, হযরত আলীসহ হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর চাইতেও বেশী মর্যাদাপূর্ণ আরো অনেক বড় বড় মহান ব্যক্তির হত্যাকান্ডের ঘটনা থাকলেও ৬১ হিজরীর কারবালার ঘটনা এতোটাই পৈচাশিক ও নির্মমতম ছিল যে এটা যুগে যুগে কঠিন হৃদয়কেও নাড়া দিয়েছে, এখনো দেয় এবং নিঃসন্দেহ তা কেয়ামত পর্যন্ত জালিমদের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাতে ও ইসলামী শক্তির পক্ষে মুমীনদের উদ্ভূদ্ধ করায় নিয়ামক ভূমিকা পালন করবে ।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকাল পূর্বে কাউকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাননি । তিনি জনগনের উপর তার উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ভার ছেড়ে দিয়ে যান । সেইমতে প্রথম চারজন উত্তরাধিকারী তথা খোলাফায়ে রাশেদীন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগন কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন । কিন্তু উমাইয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুয়াবিয়া খিলাফত লাভের সাথে সাথে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন । ৬৭৬ খ্রীষ্টাব্দে বসরার শাসনকর্তা হযরত মুগিরার প্ররোচনায় তিনি তার জ্যৈষ্ট পুত্র ইয়াজিদকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার মর্মমুলে চরম কুঠারাঘাত করেন । হযরত মুয়াবিয়া এবং হযরত মুগীরা উভয়েই সম্মানিত সাহাবী ছিলেন । যেহেতু তারা কোন নবী বা রসুল ছিলেন না, স্বাভাবিক কারনেই তারা ভুলের উর্ধ্বে ছিলেন না । কিন্তু তাদের এই ভুল ইসলামের ইতিহাসকে ক্ষত বিক্ষত, রক্তাক্ত ও কলঙ্কিত করে । ইসলামের শাসন পদ্ধতির মুলে চরম কুঠারাঘাত করে । ঐতিহাসিক আল-ফাখরী, ফন ক্রেমার এবং ইবনুত তিকতাকার মতে ইয়াজিদের রাজত্বকাল তিনটি দুষ্কর্মের জন্য বিখ্যাত-প্রথম বছরে সে মহানবীর আদরের দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে হত্যা করে, দ্বিতীয় বছরে মদীনাকে লুন্ঠন করে এবং তৃতীয় বছরে সে কাবার উপর হামলা করে । এই ইয়াজিদ-এর খলিফা হিসাবে মনোনয়ন অন্যরা মেনে নিলেও, ইসলামের ব্যত্যয় মহানবীর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু মেনে নিলেন না । হুসাইনের এই ন্যায্য দাবীকে আবদুল্লাহ-ইবনে যুবাইর, আবদুল্লাহ-ইবনে ওমর, আবদুর রহমান-ইবনে আবু বকর সমর্থন করেন । 

ইয়াজিদ ইসলামী শাসন ব্যবস্থার ব্যত্যয় ঘটানোয় ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর মত মুমীন ব্যক্তির পক্ষে সেটা মেনে নেয়া কোনভাবেই সম্ভব ছিল না । খিলাফত ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনই ছিল ইমাম হোসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর সংগ্রামের মূল লক্ষ্য । মুসলিম জাহানের বিপুল মানুষের সমর্থনও ছিল তার পক্ষে ।

ইরাকের লোকেরা তার কাছে চিঠি/দূত পাঠিয়ে জানাল তারা তাকে খলিফা হিসেবে চায়, ইয়াজিদকে নয় । সমর্থকদের চিঠি পেয়ে হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকীলকে কুফায় পাঠালেন অবস্থা দেখার জন্য । মুসলিম দেখলেন যে আসলেই অনেক মানুষ হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে খলিফা হিসেবে চাচ্ছে । তিনি হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে সেটা জানিয়েও দিলেন । ইতমধ্যে কিছু অত্যুৎসাহী লোকেরা হানী বিন উরওয়ার ঘরে মুসলিমের হাতে হুসাইনের পক্ষে বায়াত নেওয়া শুরু করল । সিরিয়াতে ইয়াজিদের কাছে এ খবর পৌছালে সে বসরার গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে পাঠাল কুফাবাসীর বিদ্রোহ দমন করতে ।

উবাইদুল্লাহ কুফায় গিয়ে দেখে ঘটনা সত্যি । মুসলিম বিন আকীল চার হাজার সমর্থক নিয়ে উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের প্রাসাদ ঘেরাও করলেন । এ সময় উবাইদুল্লাহ দাঁড়িয়ে এক ভাষণ দিয়ে মানুষকে ইয়াজিদের সেনা বাহিনীর ভয় দেখাল । কুফাবাসীরা ইয়াজিদের শাস্তির ভয়ে আস্তে আস্তে সরে পড়তে লাগল । সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মুসলিম বিন আকীল দেখলেন, তথাকথিত হুসাইন  রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু সমর্থকদের কেউই অবশিষ্ট নেই । তাকে গ্রেপ্তার করে হত্যার আদেশ দিল উবাইদুল্লাহ । মুসলিম মৃত্যুর আগে হুসাইনের কাছে একটি চিঠি পাঠান –
 “হুসাইন ! পরিবার-পরিজন নিয়ে ফেরত যাও । কুফা বাসীদের ধোঁকায় পড়ো না । কেননা তারা তোমার সাথে মিথ্যা বলেছে । আমার সাথেও তারা সত্য বলেনি ।”



এদিকে মুসলিম বিন আকীলের মৃত্যু হলেও তার প্রথম চিঠির উপর ভিত্তি করে যিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখে হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা দেন । অনেক সাহাবী তাকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন । তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর, আব্দুল্লাহ বিন আমর এবং তাঁর ভাই মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফীয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

সুফীয়ান আস সাওরী ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবনে আব্বাস (রা:) হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে বলেছিলেনঃ মানুষের দোষারোপের ভয় না থাকলে আমি তোমার ঘাড়ে ধরে বিরত রাখতাম । আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা:) হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে বলেনঃ  হুসাইন ! কোথায় যাও ? এমন লোকদের কাছে, যারা তোমার পিতাকে হত্যা করেছে এবং তোমার ভাইকে আঘাত করেছে ?

যাত্রা পথে হুসাইনের কাছে মুসলিমের সেই চিঠি এসে পৌঁছুলো । চিঠি পড়ে তিনি কুফার পথ পরিহার করে ইয়াজিদের কাছে যাওয়ার জন্য সিরিয়ার পথে অগ্রসর হতে থাকলেন । পথিমধ্যে ইয়াজিদের সৈন্যরা আমর বিন সাদ, সীমার বিন যুল জাওশান এবং হুসাইন বিন তামীমের নেতৃত্বে কারবালার প্রান্তরে হুসাইনের রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর গতিরোধ করল । তিনি আগত সৈন্যদলকে আল্লাহর দোহাই এবং নিজের মর্যাদার কথা উল্লেখ করে তিনটি প্রস্তাব দেন –

১. তাকে ইয়াজিদের দরবারে যেতে দেয়া হোক । 

২. অথবা তাঁকে মদিনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক ।

৩. অথবা তাঁকে কোন ইসলামী অঞ্চলের সীমান্তের দিকে চলে যেতে দেয়া হোক । সেখানে তিনি জিহাদ করবেন এবং ইসলামী রাজ্যের সীমানা পাহারা দেবেন ।

ইয়াজিদের সৈন্যরা উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের ফয়সালা ছাড়া কোন প্রস্তাবই মানতে রাজী হল না । এ কথা শুনে উবাইদুল্লাহর এক সেনাপতি হুর বিন ইয়াজিদ বললেনঃ  এরা তোমাদের কাছে যেই প্রস্তাব পেশ করছে তা কি তোমরা মানবে না ? আল্লাহর কসম ! তুর্কী এবং দায়লামের লোকেরাও যদি তোমাদের কাছে এই প্রার্থনাটি করত, তাহলে তা ফেরত দেয়া তোমাদের জন্য বৈধ হত না । এরপরও তারা খুব যৌক্তিক এই প্রস্তাবগুলো মেনে নেয়নি। 

অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইবেন যিয়াদের ৪ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হোসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে  অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয় । মাত্র ২০০ মানুষের বিপক্ষে ৪০০০ সৈন্য । পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয়ায় ইমামের কচি সন্তানেরা প্রচণ্ড তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লে হযরত আব্বাস ফোরাতে যান পানি আনতে । নিজেও তিনি ভীষণ তৃষ্ণার্ত ছিলেন । আঁজলা ভরে পানি তুলে খেতে যাবেন এমন সময় তাঁর মনে পড়ে যায় ইমাম হোসেন এর তৃষ্ণার্ত শিশু সন্তানের কথা । পানি ফেলে দিয়ে মশক ভর্তি করে তাঁবুর উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই শত্রুপক্ষের তীরে তাঁর এক হাত কেটে যায় । মশকটাকে তিনি অপর হাতে নিয়ে ইমামের তাঁবুর দিকে ছুটলেন । এবার অপর হাতটিও কাটা পড়ে । মশকটাকে এবার তিনি মুখে নিয়ে তাঁবুর দিকে যেতে চাইলেন । শত্রুর তীর এবার সরাসরি তার দেহে আঘাত হানে । এভাবে শহীদ হয়ে যান তিনি ।  এরপর অসম এই যুদ্ধে আলী আকবর শহীদ হয়ে যান । কারবালায় ৭২ জন সঙ্গী শাহাদৎ বরণ করেন, তাদেঁর মধ্যে রাসূলের প্রিয় সাহাবা হাবিব ইবনে মাজাহের, তাঁর প্রাচীন বন্ধু মুসলিম ইবনে আওসাজা, নওমুসলিম ওহাবসহ আরো অনেকেই ।

নিরুপায় হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু শেষবারের মত অনুরোধ করলেও, পাষান্ডদের মন গলেনি । ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর কারবালার প্রান্তরে এক অসম যুদ্ধ শুরু হলো । হুসাইনের ভ্রাতুষ্পুত্র কাশিম সর্বপ্রথম শত্রুর আঘাতে শাহাদাত বরন করলেন । তৃষ্ণার্ত হুসাইন শিশুপুত্র আসগরকে কোলে নিয়ে ফোরাত নদীর দিকে অগ্রসর হলেন কিন্তু ইয়াজিদ বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তীর শিশুপুত্রের শরীরে বিদ্ধ হয়ে শিশুপুত্রটি শাহাদাত বরন করলে একাকী অবসন্ন হুসাইন  রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু তাবুর সামনে বসে পড়লেন । এমন সময় এক মহিলা তাকে এক পেয়ালা পানি এনে দিলো । কিন্তু শত্রুর তীর তার মুখ বিদীর্ণ করে দিলো ।



শিমার বিন যুল জাওশান নামের এক নরপশু বর্শা দিয়ে হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর শরীরে আঘাত করে ধরাশায়ী করে ফেললো ।  শেষে ইয়াজিদ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে নির্ভীক এই বীর আল্লাহর লিখে রাখা ভাগ্যানুযায়ী শহীদ হলেন । শিমার বিন যুল জাওশান মুরাদি নিজে কণ্ঠদেশে ছুরি চালিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে অত্যান্ত নির্মমভাবে হত্যা করে । ওইদিন ছিল হিজরী ৬১ সনের ১০ মুহররম । হযরর ঈমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু অন্যায় কিছু বলেন নি, অন্যায় কিছু করেন নি । তার হত্যাকারী ও হত্যায় সাহায্যকারীদের আল্লাহর ক্রোধ ঘেরাও করুক, এরা ধ্বংস হোক ! আল্লাহ্‌ তায়ালা শহীদ হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু এবং তাঁর সাথীদেরকে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রহমত ও সন্তুষ্টি দ্বারা আচ্ছাদিত করুন ।

ইতিহাসের পরবর্তী বিশ্লেষণঃ

ইয়াজিদ বেঁচে নেই । কিন্তু ইয়াজিদের প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র এখনো শীর্ষ মুসলিম দেশগুলো কব্জা করে রেখেছে । স্বৈরাচাররা মুসলমানদের বুকে চেপে বসে আছে । মুসলমানদের বোকা বানাবার জন্যে তাদেরও কিছু গৃহপালিত আলেম ইমাম পীর জাতীয় লোক আছেন । এরা চেষ্টা করছে কারবালার ইতিহাসকে ম্লান করে এর গুরুত্বকে খাটো করার । তারা ইনিয়ে বিনিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কায়দা করে বলতে চায়, ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু ক্ষমতার লোভেই নাকি কুফায় গমন করেছিলেন । তার এই যাওয়াতে নাকি ইসলামের কোন কল্যাণ ছিল না । এটা নাকি হক আর বাতিলের যুদ্ধ ছিল না । (নাউজুবিল্লাহ)। আল্লাহর লানত এইসব দরবারীর উপর । তারা ইয়াজিদের নৃশংসতাকে এবং ফোরাত নদীর পানি সরবরাহ বন্ধকে সহি নয় মর্মে প্রতিপন্ন করতে তৎপর । কেউ কেউ কারবালার এ ঘটনাকে কেচ্ছা কাহিনী বলতেও দ্বিধা করেনি । ইনিয়ে বিনিয়ে তারা দলীল পেশ করে কেবল দরবারী আলেমদের । তারা বুঝাতে চান, কারবালার ঘটনা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় । এ নিয়ে মাতামাতি করে লাভ নেই । ইয়াজিদ হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর হত্যাকারী নয় । ইমাম হুসাইন  রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু মুসলিম জাতির নির্বাচিত আমীর বা খলীফা ছিলেন না । তাকে হত্যা করা জায়েজ ছিল বলেও তারা কৌশলে মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেন । কোন কোন আলেম তো ইয়াজিদের প্রতি অতিরিক্ত লিখতে গিয়ে তাকে ‘রাহমতুল্লাহ’বলতেও কুন্ঠিত হননি । তবে এইসব দরবারী আলেমরা বড়ই ধূর্ত । তারা প্রথমেই হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু-এর পক্ষে এমনভাবে বন্দনা করেন যে পড়ে মনে হবে তারা হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু-এর খুবই ভক্ত এবং পক্ষের লোক । প্রথমেই বোঝাতে চেষ্টা করেন ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর মহব্বতে তাদের কলিজা ভরপুর । কিন্তু ধূর্তামীর আশ্রয়ে 'প্রকৃত ইতিহাস' শেখাবার নামে এবং বড়ই চাতুর্য্যপূর্ণভাবে তারা ইয়াজিদের সাফাই গায় । তারা হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে হত্যার জন্য হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকেই দায়ী করেন । কেউ কেউ শীয়াদের দায়ী করেন । অথচ ঐসময় শীয়া মতবাদের সৃষ্টিই হয়নি । মোট কথা, যে কোনভাবেই যেন ইয়াজিদকে দায়ী করা না হয় । ইমাম হুসাইনের হত্যার দায় কুফাবাসীর উপরও চাপাতে চান । তারা বোঝাতে চান, ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু  কুফাবাসীর ফাঁদে পড়ে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন । অথচ কুফাবাসীদের প্ররোচনায় হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু ইয়াজিদের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন-এমনটা কোন মুসলমান মনে করতে পারে না । বরং ইমাম হুসাইন  রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু ইসলামী খেলাফতের পক্ষে এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন । এটা ঠিক কুফাবাসীরা কথা দিয়ে কথা রাখেনি । তারা ইমাম পরিবারের সাথে চরম গাদ্দারী করেছে । দরবারী আলেমরা চরম ধূর্ততার আশ্রয়ে ইয়াজিদকে ভাল শাসক, ইসলামের খেদমতগার বলেও প্রতিপন্ন করতে চান । তাদের মতে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো নাকি সহি নয় । তারা মানুষকে বোঝাতে চান, ইয়াজিদ হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দিলেও হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে হত্যার নির্দেশ দেয়নি । পাঠক খেয়াল করুন ফাঁকিবাজিটা কোথায় । ইয়াজিদ যখন হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে হত্যার ঘটনা শুনলো তখন ইয়াজিদ ব্যথিত হয়েছিল বা হত্যাকারীকে শাস্তি দিয়েছিল এমন কোন দলীল তো পাওয়া যায় না । দরবারীরা বলে বেড়ান যে, হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর ছিন্ন মস্তক ইয়াজিদের দরবারে এলে সেখানে নাকি কান্নার রোল পড়ে যায় । কিন্তু হত্যাকারীকে তো ক্ষমতা থেকে সরিয়েও দেয়নি এবং কোন শাস্তিও দেয়নি । গর্ভনর ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ তো তার স্বপদে বহাল তবিয়তেই ছিল । তাহলে কি বোঝা গেলো ? দরবারীরা আরো বুঝাতে চান রাজতন্ত্র তেমন খারাপ কিছু নয় । যুগে যুগে এইসব দরবারীরা নানাভাবে মুসলমানদের সত্য ইতিহাস শেখাবার নামে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করেছে । 


সম্মানীত সাহাবীরা কেন ইমামকে কুফা যা্ওয়া রুখতে চেয়েছিলেন ?

ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু যখন কুফাবাসীর পত্র পেয়ে কুফায় যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন অনেক সম্মানীত সাহাবী তাকে যেতে নিষেধ করেছিলেন । তারা কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি আগে থেকেই অনুমান করেছিলেন বলেই হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে যেতে নিষেধ করেছিলেন । কোনভাবেই ইয়াজিদকে সমর্থণ করে নয় । 

হুসাইন (রাঃ)-কে কেন ইমাম বলা হয় ?

পুরো মুসলিম বিশ্ব এক কথায় তাকে ইমাম বা নেতা মেনে নিয়েছেন । ইয়াজিদ জনতার উপর চেপে বসেছিল । ইয়াজিদ মুসলিম বিশ্বের নির্বাচিত নেতা ছিল না । সেই সময় থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানেরা ইয়াজিদকে ইমাম বা নেতা হিসাবে মেনে নেয়নি নেবেও না । হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে ইমাম বলার অর্থ ইয়াজিদকে স্বীকার না করা । ইমাম বা নেতা হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুই । সেকারনে তখন থেকেই যুগে যুগে হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নাম নেয়ার আগে 'ইমাম' বলা হয় । ইমাম হাসান রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকেও বিষ প্রয়োগে অত্যন্ত কৌশলে হত্যা করা হয়েছিল । তিনিও মুসলিম জাতির ইমাম । ইয়াজিদের বংশধরদের যতই গা জ্বলুক, কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানেরা হাসান রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে ‘ইমাম’ হিসাবেই ঘোষনা দেবেন । 

আশুরার দিন যা বর্জনীয়

সুন্নি নামধারী কিছু লোক এদিন নানা জাতের খানাপিনা করেন, মহরম-এর বাদ্য বাজান, এদিনটাকে খুশীর আমেজে পালন করেন । আবার শীয়া নামধারী কিছু কুলাঙ্গার এদিন নানা জাতের মাতম করেন, বুকে পিঠে ছুরি মারেন, তাজিয়া মিছিল করেন । এসব কাজ অবশ্যই বর্জনীয় । এসব কখনোই ইসলাম অনুমোদন করেনি । কাজেই এগুলো বিদআত । এদের কিছু কিছু কর্মকান্ড শির্কের পর্যায়ভূক্ত । মুসলমানদেরকে অবশ্যই এসব বর্জণ করতে হবে । 

যা করনীয়

১। রোজা রাখুন । কেননা কারবালার এই মর্মান্তিক ঘটনা ছাড়াও এদিনটি ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ । হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘রমযানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা হল সর্বশ্রেষ্ঠ ।’
أفضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم
-সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮; জামে তিরমিযী ১/১৫৭ 
ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই আশুরার দিনের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে এত গুরুত্বসহকারে অন্য কোন দিন রোযা পালন করতে দেখিনি । (অর্থাৎ রামাযান মাস ছাড়া) (বুখারী)।

২। কারবালার এ বিয়োগান্ত ঘটনা স্মরন করে ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু ও তার পরিবার বর্গের জন্যে দোয়া করুন । আল্লাহপাক বলেছেন, ‘যাঁরা আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় শহীদ হন তাঁদেরকে কখনও মৃত মনে করো না । বরং তাঁরা নিজেদের রব তায়ালার নিকট জীবিত ও রিযিকপ্রাপ্ত।’ (সূরা আলে ইমরান-১৬৯)

৩। কারবালার ঘটনার চেতনায় উদ্ভূদ্ধ হয়ে রাজতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, পীরবাদ, জালিম শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে মনেপ্রাণে ঘৃণা প্রকাশ করুন, 'ইসলাম' প্রতিষ্ঠায় নিজ করনীয় ঠিক করুন এবং তা পালনের দৃঢ় শপথ নিন । 

বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬

জুম‘আর ছালাত

 (صلاة الجمعة)
প্রথম হিজরীতে জুম‘আ ফরয হয় এবং হিজরতকালে ক্বোবা ও মদীনার মধ্যবর্তী বনু সালেম বিন ‘আওফ গোত্রের ‘রানূনা’ (رانوناء) উপত্যকায় সর্বপ্রথম প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুম‘আর ছালাত আদায় করেন । যাতে একশত মুসল্লী শরীক ছিলেন । তবে হিজরতের পূর্বে মদীনার আনছারগণ পরামর্শক্রমে ইহুদী ও নাছারাদের সাপ্তাহিক ইবাদতের দিনের বিপরীতে নিজেদের জন্য একটি ইবাদতের দিন ধার্য করেন ও সে মতে আস‘আদ বিন যুরারাহ রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর নেতৃত্বে মদীনার বনু বায়াযাহ গোত্রের নাক্বী‘উল খাযেমাত (نَقِيعُ الْخَضِمَاتِ) নামক স্থানের ‘নাবীত’ (هَزْمُ النَّبِيْتِ) সমতল ভূমিতে সর্বপ্রথম জুম‘আর ছালাত চালু হয় । 
সেখানে চল্লিশ জন মুসল্লী যোগদান করেন । অতঃপর হিজরতের পর জুম‘আ ফরয করা হয় । 
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ জুম‘আর এই দিনটি প্রথমে ইয়াহূদ-নাছারাদের উপরে ফরয করা হয়েছিল । কিন্তু তারা এ বিষয়ে মতভেদ করে । তখন আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এই দিনের প্রতি হেদায়াত দান করেন । এক্ষণে সকল মানুষ আমাদের পশ্চাদানুসারী । ইহুদীরা পরের দিন (শনিবার) এবং নাছারারা তার পরের দিন (রবিবার) । 
যেহেতু আল্লাহ শনিবারে কিছু সৃষ্টি করেননি এবং আরশে স্বীয় আসনে সমাসীন হন, সেহেতু ইহুদীরা এদিনকে তাদের সাপ্তাহিক ইবাদতের দিন হিসাবে বেছে নেয় । 
যেহেতু আল্লাহ রবিবারে সৃষ্টির সূচনা করেন, সেহেতু নাছারাগণ এ দিনটিকে পছন্দ করে । এভাবে তারা আল্লাহর নির্দেশের উপর নিজেদের যুক্তিকে অগ্রাধিকার দেয় । 
পক্ষান্তরে জুম‘আর দিনে সকল সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন হয় এবং সর্বশেষ সৃষ্টি হিসাবে আদমকে পয়দা করা হয় । তাই এ দিনটি হ’ল সকল দিনের সেরা । 
এই দিনটি মুসলিম উম্মাহর সাপ্তাহিক ইবাদতের দিন হিসাবে নির্ধারিত হওয়ায় বিগত সকল উম্মতের উপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় । কা‘ব বিন মালেক রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আযানের আওয়ায শুনে বিগলিত হৃদয়ে বলতেনঃ ‘আল্লাহ রহম করুন, আস‘আদ বিন যুরারাহর উপর, সেই-ই প্রথম আমাদের নিয়ে জুম‘আর ছালাত কায়েম করে নবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা থেকে আগমনের পূর্বেই ।
শহর হোক বা গ্রামে হোক জুম‘আর ছালাত প্রত্যেক বয়স্ক পুরুষ ও জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমানের উপরে জামা‘আত সহ আদায় করা ‘ফরযে আয়েন’ । 
তবে রোগী, মুসাফির, শিশু ও মহিলাদের উপরে জুম‘আ ফরয নয় । 
বাহরায়েনবাসীর প্রতি এক লিখিত ফরমানে খলীফা ওমর রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু বলেনঃ جَمِّعُوْا حَيْثُمَا كُنْتُمْ ‘তোমরা যেখানেই থাক, জুম‘আ আদায় কর’। কারাবন্ধী অবস্থায় অনুমতি পেলে করবে, নইলে করবে না ।

মুহাররম ও আশুরা

আরবী বছর শুরুর প্রথম মাস মহররম । 
মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও হাদীস শরীফে এ মাস সম্পর্কে যা এসেছে তা হল, এটা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ মাস । কুরআনের ভাষায় এটি ‘আরবাআতুন হুরুম’-অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম ।
এ মাসে রোযা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘রমযানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা হল সর্বশ্রেষ্ঠ ।’
أفضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم
-সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮; জামে তিরমিযী ১/১৫৭
এর মধ্যে আশুরার রোযার ফযীলত আরও বেশি ।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেনঃ ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি ।’
ما رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يتحرى صيام يوم فضله على غيره إلا هذا اليوم يوم عاشوراء وهذا الشهر يعني رمضان
-সহীহ বুখারী ১/২১৮
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমযানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন ? তিনি বললেনঃ এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম । উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ‘রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ । কারণ, এটি আল্লাহর মাস । এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তা'আলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন ।’-জামে তিরমিযী ১/১৫৭
অন্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোযার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন ।’
صيام يوم عاشوراء أحتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله  -সহীহ মুসলিম ১/৩৬৭; জামে তিরমিযী ১/১৫৮
আশুরার রোযা সম্পর্কে এক হাদীসে আছে যে, ‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ ।’
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোযা রাখব ।’-সহীহ মুসলিম ১/৩৫৯
মহররম ও আশুরা কেন্দ্রিক নানা কুসংস্কার যেমন আছে তেমনি এ মাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ।
আশুরাকে কেন্দ্র করে এ মাসে যেসব অনৈসলামিক কাজকর্ম ঘটতে দেখা যায় তার মধ্যে শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র‌্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত । এসব রসম-রেওয়াজের কারণে এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করার একটা প্রবণতা অনেক মুসলমানের মধ্যেও লক্ষ করা যায় । এজন্য আবার অনেকে এ মাসে বিয়ে-শাদী থেকেও বিরত থাকে । বলাবাহুল্য এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার । মোটকথা, এ মাসের করণীয় বিষয়গুলো যখা, তওবা- ইস্তেগফার, নফল রোযা এবং অন্যান্য নেক আমল । এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়া এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক চলাই মুসলমানের একান্ত কর্তব্য । আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন ।
এ মাসের একটি ঘটনা শাহাদাতে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু । বলাবাহুল্য যে, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয় । কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই তো শিক্ষা-‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করিনা যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয় ।’ অতএব শাহাদাতে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলী রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য ।
পবিত্র আশুরা
আশুরা হলো মুহররম মাসের দশম দিবস । আরবীতে "আশারা" মানে ১০ আর সে কারণে দিনটিকে "আশুরা" বলে অভিহিত করা হয় । ইসলামের ইতিহাসে এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত কারণ বহু ঐতিহাসিক ঘটনা এই তারিখে সংঘটিত হয়েছিল । এই দিনে আখেরী নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৌহিত্র ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইসলামের তৎকালীন শাসনকর্তা এজিদের সৈন্য বাহিনীর হাতে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেছেন । 
হিজরী ৬০ সনে এজিদ বিন মুয়াবিয়া পিতার মৃত্যুর পর নিজেকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসাবে ঘোষণা করে । সে প্রকৃত মুসলমান ছিল না, সে ছিল মোনাফেক । সে এমনই পথভ্রষ্ট ছিল যে সে মদ্যপানকে বৈধ ঘোষণা করেছিল । অধিকন্তু সে একই সঙ্গে দুই সহোদরাকে বিয়ে করাকেও বৈধ ঘোষণা করেছিল । শাসক হিসাবে সে ছিল স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী । হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এজিদের আনুগত্য করতে অস্বীকৃত হন এবং ইসলামের সংস্কারের লক্ষ্যে মদীনা ছেড়ে মক্কা চলে আসেন । উল্লেখযোগ্য যে, উমাইয়া শাসনামলে ইসলাম পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিল । মক্কা থেকে তিনি কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন । শেষ পর্যন্ত তিনি কারবালার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন । এ সময় উমর ইবনে সাদ আবি ওক্কাসের নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্য কারবালায় প্রবেশ করে । কয়েক ঘণ্টা পর শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদির নেতৃত্বে আরো বহু নতুন সৈন্য এসে তার সাথে যোগ দেয় ৷ কারবালায় দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয় । নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় । এই অসম যুদ্ধে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং তাঁর ৭২ জন সঙ্গী শাহাদৎ বরণ করেন । শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদি নিজে কণ্ঠদেশে ছুরি চালিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে অত্যান্ত নির্মমভাবে হত্যা করে । ওইদিন ছিল হিজরী ৬১ সনের ১০ মুহররম ।
এদিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের জন্য কুদরত প্রকাশ করেছেন । 

এইদিন নবী মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমুদ্রে রাস্তা বের  নিরাপদে পার করে দিয়েছেন অপরদিকে শত্রু ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে নীল নদে  ডুবিয়ে মেরেছেন।-সহীহ বুখারী ১/৪৮১ ডুবিয়ে দেয়া হয় ।   
صوموا عاشوراء وخالفوا فيه اليهود، صوموا قبله يوما أو بعده يوما -মুসনাদে আহমদ ১/২৪১
ইসলামের ইতিহাস অনুসারে এই দিনটি আরো অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ । জনশ্রুত রয়েছে ১০ মুহররম তারিখে আসমান ও যমিন সৃষ্টি করা হয়েছে । এই দিনে পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদিপিতা হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করা হয়েছিল ।  এই দিন  নূহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিস্তি ঝড়ের কবল হতে রক্ষা পেয়েছিলো এবং তিনি জুডি পর্বতশৃংগে নোঙ্গর ফেলেছিলেন । এই দিনে দাউদ আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাওবা কবুল হয়েছিলো । নমরূদের অগ্নিকুণ্ড থেকে হযরত খলিলুল্লাহ ইব্রাহীম আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্ধার পেয়েছিলেন । হযরত আইয়ুব আলাইহি ওয়াসাল্লাম দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত ও সুস্থতা লাভ করেছিলেন । এদিনে আল্লাহ তা'আলা হযরত ঈসা ইবনে মারিয়ম আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উর্দ্ধাকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন । এই তারিখেই কেয়ামত সংঘটিত হবে ।


মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

অন্তিম সফর – আয়েশা খন্দকার।

অন্তিম সফর – আয়েশা খন্দকার।


তারিখ টা ছিল ৩রা সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১লা জিলহজ্ব ১৪৩৭( সূর্য অস্ত গেলেই আরবি তারিখ অনুযায়ী নতুন দিন শুরু হয়)। রাতের কালো আধাঁর ভেদ করে ৬ টা সাদা মাইক্রো এগিয়ে যাচ্ছে একটা মহান কাজ সম্পন্ন করতে। কাজ টা হলো, মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের এক অনুগত গোলাম তাঁর মহান রবের আদেশ ক্রমে তাঁর দরবারে হাজির হতে যাচ্ছেন। এই মাইক্রোর যাত্রীরা সেই বান্দা কে তাঁর মহান রবের দরবারে পৌঁছে দেয়ার দুনিয়াবি শেষ কাজ গুলো সম্পন্ন করতে যাচ্ছেন। পথেই খবর আসলো, তিনটা মাইক্রোর বেশি যেতে দেয়া হবে না। আইনের শাসন বাস্তবান বলে কথা। মানিকগঞ্জ এর হরিরামপুর থানা চালা ইউনিয়ন পৌঁছানোর আগেই পরে কৌড়ি ইউনিয়ন। সেই খানকার কলতা বাজার এ আটকে দেয়া হলো গাড়ীর বহর। বলে রাখা ভাল প্রথম সংবাদ পাওয়ার পরই ৬ মাইক্রোর যাত্রীদের মধ্যে কাটছাট করে গাড়ীর সংখ্যা করা হলো ৫। তাতেও মন ভরছে আইন রক্ষাকারী সদস্যদের। তিন মানেই তিন। কোন নড়চড় নাই। উপরের আদেশ বলে কথা। বকুল আপা, ওসমান আর জামান ভাই ( মামার PS) এর অনেক অনুরোধে তারা ৪ মাইক্রো যেতে দিতে রাজি হলো। এবার পালা ৫ গাড়ীর লোকদের ৪ টা গাড়ীতে ঠেসে পুরে রওনা দেয়ার পালা। তখনই খবর এলো, সবার হৃদয়ের স্পন্দন, অসহায় মানুষের পরম অভিভাবক, এদেশ ইসলামী অর্থনীতির সফলতার রুপকার, ইসলামি মিডিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা মীর কাসেম আলী মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দরবারে হাজির হয়ে গেছে এই দুনিয়ার সকল মায়া ছেড়ে। যদিও সংবাদটা জন্য অধির অপেক্ষায় ছিলাম ঘড়ির কাটা রাত ১০ টা ছোঁয়ার পর থেকেই। যাহোক, আইন কর্তাদের অশেষ দয়ায় ও তাদের কড়া পাহাড়ায় রাত ১১ টার একটু আগেই পৌঁছেলাম চালায়, যেখানে চির নিদ্রয়া শায়িত হবেন আমাদের মুকুট মনি। কলতা বাজার থেকেই পুলিশ আমাদের তাদের পাহারায় আমাদের নিয়ে গিয়েছিল। নিজেদের চোর ভাববো না ভি আই পি ভাববো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের নামিয়ে দেয়া হলো প্রায় আধ কিঃমিঃ দূরে। বলা হলো গাড়ী আর সামনে যাবে না। আমরাও নিরুপায় হয়ে আধার ও ভাঙ্গা রাস্তায় মোবাইলের টর্চ লাইট ধরে এগিয়ে চললাম মীর বাড়ী মসজিদ সংলঘ্ন লেবু বাগানের দিকে। সেই বাগানে পৌঁছানোর একটু কিছু দূর আগেই আবার আইন কর্তারা হাজির আরেক রুপ মহিমায়। এবার কি ? মোবাইল জমা দিতে হবে। ডিজিটাল সরকার তো প্রযুক্তির পক্ষে, তো মোবাইলের উপর এত ক্ষেপ্যা কেন ঠিক বুঝা গেল না। পরে জানতে পারলাম, দাফন হওয়ার ছবি বা খবর যেন পৃথিবী জুড়ে না প্রচার হয় তার চেষ্টা। হায় রে, আর কত রং দেখা বাকি ? দিয়ে দিলাম মোবাইল। কিছু করার নাই। কারন, মোবাইলে সংবাদ দেয়ার চেয়ে জান্নাত গামী আল্লাহর বান্দার দাফন টা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে। শেষ সময় আর কোন ঝামেলা হোক তা আমাদের কাম্য ছিল না। আমরা পৌঁছেই কবরের জন্য জায়গা নির্ধারণ করতে গেলাম। দেখি আইন কর্তারা আমরা যাওয়ার আগেই পাশাপাশি দুইটা জায়গা ঠিক করে রেখেছে। তাও আবার ঘুপচি, গাছ পালায় জংগলের ভিতর যা মসজিদের টয়লেট এর একটু পাশে। যেখান থেকে দূর্গন্ধ পেতে কোন কষ্ট করার দরকার নাই। দূর্গন্ধ নিজেই এসে ধরা দিবে। ওই জায়গাটা দেখেই মনে হলো, এমন জায়গা ঠিক করা ওদের মত লোকদের দিয়েই সম্ভব। নিম্ন রুচি আর বিকৃত মানুষিকতা তাদের উপরই সাওয়ার হয় যাদের উপর্জনে হালালের চেয়ে হারামের অংশই বেশি। আর এমন মানুষদের চক্ষুশূল হবে আল্লাহর প্রিয় বান্দা শহীদ মীর কাশেম আলী, এমন টাই কি স্বাভাবিক না ? আমরা পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম আমরা কোথায় কবর দিতে চাই। কর্তারা এই প্রথম সদয় হলেন আমাদের উপর। শুরু হলো শহীদ মীর কাশেম আলীর চিরস্থায়ী নিবাস তৈরির কাজ। আর চলে সেই প্রবাদসম মহান নেতার আগমনে অপেক্ষা। রাত দেড়টার দিকে খবর পেলাম, তিনি রওনা হয়ে গেছেন তাঁর অনন্ত নিবাসে শায়িত হবার জন্য। রাত তিনটার কিছু আগে বা পরে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে পদ্মার পাড়ের সেই নিবর অন্ধকার অজপাড়া গাঁয়ে বেজে উঠলো নির্মম নিষ্ঠুর নির্দয় সেই আম্বুলেন্সের তীব্র আওয়াজ। সবাইকে জানান দিল, নেতা চলে এসেছেন। এখনই যাবেন তাঁর মহান রবের দরবারে হাজির হতে। তাঁকে বহন কারী আম্বুলেন্স যতই এগিয়ে আসছে আলোর তীব্রতা ছড়িয়ে, তার আগেই চোখে পড়লো এক দল অস্ত্রধারী পুলিশ সেই এম্বুলেন্স কে পাহারা দিয়ে এগিয়ে আসছে। যিনি সারাটা জীবন শান্তির জন্য কাজ করে গেছেন, এই তাঁর প্রতিদান। হায় রে মানুষ জানলিও না কার সাথে কি আচরন করলি। জমা রইলো, হাশরের মাঠে সব হিসেব পরিষ্কার করে নেয়া হবে, ইনশা আল্লাহ ! নেতা হাজির হলেন, এবার তাঁকে হস্তান্তরের পালা! মানিকগঞ্জ পুলিশ সুপার মেঝ মামী কে অনুরোধ করলেন একটা ফর্মে সাইন করে মামার লাশ বুঝে নিতে। মামী বললেন, আগে লাশ দেখে তারপর সাইন। পুলিশ সুপার বললেন, আগেই সাইন করুন, তারপর দেখতে দেখা হবে। এবারও আইন বলে কথা। মামী মুকুল আপাকে সাথে নিয়ে এগিয়ে গেলেন কাগজে স্বাক্ষর করতে। তারপাশে আরো ৫ জন কে স্বাক্ষর দিতে হবে। এগিয়ে গেলেন জামান ভাই, ইমরান ভাই, কামরান ভাই, ওসমান ও আমি। স্বাক্ষর শেষে নামানো হলো মামার কফিন। ডালা খুললাম আমি জামান ভাই ওসমান আর ইমরান ভাই।আরমান জান একে তো গ্রাম রাতের শেষ প্রহর। জিলহজ্বের প্রথম দিনের চাঁদ সন্ধায় দেখা দিয়েই পালিয়েছে। তারপর আবার কারফিউ দিয়ে আশে পাশে বাড়ি-ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়েছে। তার টেনে এনে বাল্ব জালিয়ে দিলে ও সে আলো গাছ ঝোপ ঝার ঘেরা আসমান-জমীনেরমহাশুন্যতার সেই ঘন অন্ধকার দুর করতে যথেস্ট হয়নি । তার মাঝে তুমি বিহীন আমরা। আমি কোন জান্নাতি মানুষ দেখি নি – তোমার আব্বুকে দেখেছি। দেখেছি সেই ঘন আঁধারে জান্নাতি নূর। রুম্মান লিখেছে……
“পলিথিন এ মুড়ে দেয়া হয়েছে আমার মামাকে। কাঁপা কাঁপা হাতে আমি, জামান ওসমান আর বড় ভাই খুললাম সেই পলিথিন। সাথে সাথে গন্ধ পেলাম চা পাতার। সাদা ধবধবে কাফনের কাপড়ে মুড়ে রাখা।
সারা গায়ে চা পাতা ছড়িয়ে দেয়া। হাত টা কাঁপছে। তারপরও মাথার গিট টা খুলে নেয়া হলো। একে একে তিন টা কাপড় সরাতেই আমাদের শেষ দেখা দিলেন আল্লাহর গোলাম শহীদ মীর কাসেম আলী। অপার্থিব এক সুঘ্রান নাকে এসে লাগল। মানুষ মৃত্যুর পর সুন্দর হয়ে যায় শুনেছি -এটা জীবনের প্রথম দেখা। ফাঁসিতে মুখ বিকৃত হয়। আমার মামা তো দেখি অনেক সুন্দর হয়ে গেছেন। প্রশান্ত এক চিরনিদ্রা। জীবদ্দশায় অনেক ব্যস্ততা আর ছুটাছুটি ছিল। মানুষের কষ্ট দূর করার কি নিরন্তর চেষ্টা। তাই বিশ্রাম সেই ভাবে নেয়ার সুযোগটা হয়ে উঠেনি। এই তো এখনই বিশ্রাম আর প্রশান্তির জীবনটা বুঝি শুরু হয়ে গেল।
শেষ দেখার অভিমানী পর্বটা শুরু হলো মামী কে দিয়ে। প্রথম নজর দেখেই একটু চুপ করে রইলেন। মনে মনে হয় তাঁর জীবন সঙ্গীকে কিছু বললেন। বললেন অনন্ত বিরহের কিছু কথা।তারপর কি পরম যত্ন নিয়ে মামার মুখখানি তে ছোঁয়া আর পরশ দিয়ে হাত বুলিয়ে দিলেন, আর সূরা আল ফজরের এই আয়াত গুলো বাংলায় বললেন ” হে প্রশান্ত আত্মা! চলো তোমার রবের দিকে । শামিল হয়ে যাও আমার নেক বান্দাদের মধ্যে এবং প্রবেশ করো আমার জান্নাতে।এ অবস্থায় যে তোমার রব তোমার প্রতি সন্তষ্ট আর তুমি তোমার রবের প্রতি সন্তুস্ট । ” শুরা আল ফজর (২৭-৩০)।
এর পর একে মহিলারা এগিয়ে এলেন শেষ দেখা দেখার জন্য। সুমাইয়া কফিনের কাছে এসে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। কান্না শুরু করেও মামার সামনে এসে মামাকে দেখে চুপ হয়ে গেল। এত সুন্দর মুখখানি দেখে আর কান্না না আসাটাই স্বাভাবিক। সবার বেলায় তাইই হলো। জামান বলছিলেন, যদি রাসুলুল্লাহ (দঃ) এর জামানায় এই মৃত্যু হতো তাহলে হয় তো আল্লাহর রাসুল (দঃ) এই কথাই বলতেন, তোমরা যদি কোন জান্নাতি কে দেখতে চাও তো মীর কাসেম আলী কে দেখে যাও”। একে একে শেষ হলো দেখার পালা। শুরু হলো জানাযার নামাজ। ভাতিজি জামাই পরিচিয়ে বহু কষ্টে হাজির হয়েছিলেন, এই শহীদী কাফেলার আরেক সঙ্গী জনাব আব্দুল হালীম। জানাযায় কেউ কেউ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলেন না। কেউ ডুকরে ডুকরে কেউ বা চিৎকার করে কেঁদেছ উঠছিলেন। শেষ হলো জানাযা। কর্তাদের তীব্র ঘৃনা নিয়ে চিৎকার দিয়ে বললাম, এই বার কি করতে হবে বলুন? বললেন, এবার দাফন করে দিন। ওসমান গেল একটু দূরে বসে থাকা মামীর অনুমতি নিতে। মামী অনুমতি দিলেন, চিরনিদ্রায় শায়িত করতে কবরে নামলাম আমি, ওসমান, মিনার ভাই সালমান আর বড় ভাইয়া। সবার শেষে মামার মুখখানি কেবলা মুখি করে উঠে এলাম মামাকে অন্ধকার ঘরে একলা শুয়ায়ে রেখে।মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো এদেশের ইসলামী আন্দোলন এর ডাইনামিক সিপাহসালার শহীদ মীর কাশেম আলীর কবর। শেষ হলো শহীদ মীর কাশেম আলীর হিরক খচিত অধ্যায়। রয়ে গেলেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। মাটি দেয়া শেষ হবার পর মুনাজাত করলেন আব্দুল হালিম ভাই। মুনাজাতের সময় হঠাৎ শুনি অন্ধকার বাগান থেকে আল্লাহ আল্লাহ বলে চিৎকার করে কান্নার রোল। যে সব মজলুম মানুষের অভিভাবক ছিলেন শহীদ মীর কাশেম আলী, তাদেরই অনেকে অথবা গ্রাম বাসী যাদের পুলিশ আসতে দেয় নাই জানাযা পরতে তারাই কান্নার সাথে চিৎকার করে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছিলেন।”
– চলবে

বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

অন্তরে বিচ্ছেদের হাহাকার

অন্তরে বিচ্ছেদের হাহাকার নিয়ে একে একে ১৪টি ঈদ আব্বাকে ছাড়া অতিবাহিত করলাম । মনের মাঝে অব্যক্ত অনেক দুঃখ, বেদনা, কষ্ট । তাই গতকাল আব্বার সাথে দেখা করে ফিরে এসেও কিছু লিখতে মন চায়নি । বিষণ্ণতা মনকে আকড়ে ধরেছিলো । 

আমাদের এই দুঃখ বেদনা অনেকেই বুঝবেন না । 
ঈদ ছোট-বড়, ধনী-গরীব সকল মানুষের মাঝে আনন্দের এক বার্তা নিয়ে হাজির হয় প্রতিটি বছর । আমাদের "ঈদ" যেন ঐ উচু লাল দালানের মধ্যে বন্ধি আর এবারের ঈদে বাংলার আকাশ, সন্তান হারা মায়ের আহাজারি, স্বামী হারা স্ত্রীর আর্তনাত, ভাই হারা বোনের মর্মস্পর্শী মায়াকান্না ভারী করে তুলেছে । আপনজনের বিয়োগের বেদনা নাড়া দিচ্ছে ! হৃদয়ের অজানা কোন স্থানে প্রচন্ড আঘাত এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে । আমাদের মতোন তাদের ঘরেও নেই কোন আনন্দ । 
নির্বিচারে গ্রেফতার, খুন আর গুমের কারনে হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য মায়ের সন্তানের অনুপস্থিতি তাদের পরিবারে ঈদের আনন্দ এনে দিতে পারেনি । সে সংখ্যা এখন অনেকের-ই অজানা । সমবেদনা জানায় অনেকে তবুও হারানো ব্যথা বা বিচ্ছেদের যন্ত্রনা কি সকলে বুঝাতে/বুঝতে পারে ? 
অনেকেই মোবাইলে এবং ফেইসবুকের ইনবক্সে ম্যাসেজ করে জানতে চেয়েছেন প্রিয় আল্লামা সাঈদী হুজুর কেমন আছেন ? সকলকে আলাদাভাবে উত্তর জানাতে পারিনি তাই একসাথে সবার উদ্দেশ্যে এই লেখা । 
ঈদ উপলক্ষে গতকাল দুপুর ২টার সময় আব্বার সাথে দেখা করেছি । অনেকেই তাঁকে একনজর দেখতে চান । জেল/কারাগার আইন অনুযায়ী আমরা তো সেই সুযোগ করে দিতে পারিনা তবে আপনাদের সালাম পৌঁছে দেই । আপনারা যে তাঁকে এখনো মন প্রান দিয়ে ভালোবাসেন-স্বরন করেন সেকথা জানাই এবং তিনিও উপলব্ধি করেন । গভীর রাতে আপনাদের চোখের পানি, আপনাদের নফল রোজা এবং সম্মানিত হাজী ভাই বোনদের পবিত্র মক্কা-মদীনা-মিনা-মুজদালিয়া-আরাফার ময়দানে কান্না জড়িত কন্ঠে দোয়ার বদৌলতে তিনি শারীরিক ভাবে সুস্থ ও মানসিক দিক থেকে দৃঢ় আছেন । আলহামদুলিল্লাহ ! আল্লাহর শাহী দরবারে লক্ষকোটি শুকরিয়া । কারাগার থেকে আপনাদেরকে সালাম এবং ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন । সেই সাথে হতাশ না হয়ে বেশী করে আল্লাহর দরবারে ধর্না দিতে বলেছেন । গভীর রাত অর্থাৎ সূর্যদোয়ের পূর্বে এবং আসর নামাজের পর সূর্যাস্তের পূর্বে দোয়া কবুল হয় । ওই সময় গুলোতে চোখের পানি ফেলে দোয়া করা ।
যুগে-যুগে ইসলামী আন্দোলনের উপর অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন হয়েছে নানা ভাবে, নানা কৌশলে । বার বার থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে । কিন্তু কোন দলন নিপীড়নই ইসলামী আন্দোলনের পথচলা থামিয়ে দিতে পারেনি, এখনও পারবে না । আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এই সমস্ত ত্যাগের বিনিময়ে এই জমিনে আল্লাহর দ্বীনের পতাকা উড়বেই, ইনশাআল্লাহ ।
ইয়া আল্লাহ ! আপনার সকল গুনবাচক নামের উছিলা দিয়ে, আপনার কাছে
আবেদন করি-করুনা ভিক্ষা চাই, কুরআনের পাখি আল্লামা সাঈদীকে সুস্থ্ শরীরে, নেকহায়াত দিয়ে- জালিমের কারাগার থেকে মুক্ত করে, আমাদের মাঝে তাফসীরুল কুরআনের ময়দানে, মসজিদের আঙ্গিনায় ফিরিয়ে দেন ।
হে আল্লাহ ! প্রয়োজনে আমার জীবনের বিনিময়ে কুরআনের পাখি সহ সকল
ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদেরকে, জালিমের জুলুম নির্যাতন থেকে
মুক্তির ব্যবস্থা দিন । আমিন -ইয়া রব্বাল আলামীন ।

রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মৃত্যু মানেই শেষ নয়, অনন্ত জীবনের শুরু ...

وَسَلَامٌ عَلَيْهِ يَوْمَ وُلِدَ وَيَوْمَ يَمُوتُ وَيَوْمَ يُبْعَثُ حَيًّا
তার প্রতি সালাম আর শান্তি-যেদিন সে জন্মগ্রহণ করে এবং যেদিন মৃত্যুবরণ করবে এবং যেদিন জীবিতাবস্থায় পুনরুত্থিত হবে । মরিয়ামঃ ১৫
সফল উদ্যোক্তা, সমাজ সেবক, উদ্যমী  সংগঠক,  মানব দরদী মীর কাশেম আলী জন্মে ছিলেন ১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর । পিতাঃ মীর তৈয়েব আলী মাতাঃ রাবেয়া আখতার । তিনি ২ পুত্র এবং ৩ কন্যার পিতা । ১৯৬৭ সালে SSCতে মেধা তালিকায় ১৫তম স্থান অধিকার করেন । ১৯৬৯ সালে HSC এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন । 
১৯৭৭এর ৬ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের যাত্রা শুরু হয় । মীর কাশেম আলী শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা কেন্দ্রীয় সভাপতি । ১৯৭৯তে তিনি জামায়াত ইসলামিতে যোগদান করেন এবং জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা, কর্ম পরিষদ ও নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন । 
সফল উদ্যোক্তা মীর কাশেম একে একে গড়ে তোলেন ইসলামি ব্যাংক, ইসলামি ব্যাংক হাসপাতাল, ইসলামি ব্যাংক স্কুল এন্ড কলেজ, ইবনে সিনা হসপিটাল, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল, ইবনে সিনা মেডিক্যাল কলেজ, ফুয়াদ আল খতীব হসপিটাল, দিগন্ত টিভি, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকা এবং কেয়ারী গ্রুপ । এই প্রতিষ্ঠান গুলোর মুনাফার তুলনায় তিনি বেশী মনযোগী ছিলেন মানব সেবায় ।
মহান এই ব্যাক্তিটিকে ২০১২ সালের ১৭জুন  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক জঘন্য মিথ্যা মামলায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয় । গ্রফতারের পূর্বে তাঁর নামে কোথাও কোন মামলা ছিলো না । নানান ভাবে বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেন । গত ৩০ আগস্ট আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতির এস কে সিনহার নেতৃত্বে ৫ সদস্যের বিচারপতিগন মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন । রায়ের ৫দিনের মাথায় গতকাল ৩ সেপ্টেম্বর রাত ১০:৩৫ মিনিটে কাশিমপুর কারাগার-২এ  ফাসি কার্যকর করা হয় । إِنَّا للهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعونَ
জন্মস্থান মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানার সুতালরি গ্রামের বাড়িতে নিজের প্রতিষ্ঠিত মসজিদের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়ীত হয়েছেন শহীদ মীর কাসেম আলী ।


وَلَا تَقُولُوا لِمَن يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَٰكِن لَّا تَشْعُرُونَ
আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না ৷ এই ধরনের লোকেরা আসলে জীবিত ৷ কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমাদের কোন চেতনা থাকে না"৷ 
And do not say  about those who are killed  in the way of Allah, "They are dead" Rather, they are alive, but you perceive(it) not. Baqarah: 154

আজ পৃথিবীর সমস্ত লাল গোলাপ আপনার জন্যই ফুটেছে ! আমি বিশ্বাস করি ফেরেশতাগণ আজ আপনাকে অভিবাদন জানাতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যাবেন । আপনার অন্যান্য সম্মানীত সাথীগনও আপনাকে অভিবাদন জানোর জন্য অপেক্ষা করছে নিশ্চয়ই । ওমর আল মুখতার, সাইয়্যেদ কুতুব, কাদের মোল্লা, নিজামী থেকে শুরু করে আপনি ।
যে হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের মানুষের জন্য হৃদয়ে আকাশসম স্বপ্ন আজ সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো । আপনি হাসপাতাল গড়েছেন, ব্যাংক গড়েছেন, টিভি গড়েছেন, স্কুল, কলেজ, মসজিদ গড়েছেন আরও কত কিছু ইতিহাস অবশ্যই স্বাক্ষ্য দেবে ।
সময়টা এখন সৃষ্টিশীল মানুষদের নয় । ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ব্যাংক ডাকাত, শেয়ার মার্কেটর লুটেরারা আজ আমাদের নৈতিকতার জ্ঞান দিতে আসছে ! আসলে ক্ষমতা জিনিসটাই বুঝি এমন ।
যে জাতি যেমন তাদের নেতাও তেমন এটাই চুড়ান্ত সত্য । আপনি আসলে এই জাতির নেতা হওয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি । চেয়ে দেখুন, এই জাতির নেতৃত্বের চেয়ারগুলোতে কারা বসে আছে ?
আপনি দেশের বাইরে গেলেন আর এদেশের মিডিয়া পাড়ার শিয়ালগুলো হুক্কাহুয়া আওয়াজ তুললো, ‘মীর কাসিম পালিয়েছেন!”। আপনি আসলেন’ জানান দিলেন, মীর কাশেমরা পালাতে জানে না’। ইতিহাসের সকল সময়েই মীর কাশেমরা জীবন দিয়েছে কিন্তু তাদের দ্বায়িত্ব ছেড়ে পালায়নি । আপনার শুভাকাংখিরা বারবার আপনাকে দেশে ফিরতে বারণ করেছেন, তারা বলেছেন আপনি ন্যায় বিচার পাবেন না ! কিন্তু আপনি বললেন, ইসলামী আন্দোলনে হাজার হাজার কর্মী প্রাণ দিচ্ছে, নেতারা প্রাণ দেবে না তা কি করে হয় ?
আপনি জানতেন আপনার সাথে কি করা হবে । আপনি জয় করেছেন জীবনকে । মৃত্যুও আপনাকে হারাতে পারেনি । হে মহান কারিগর, আপনি জেনে রাখুন নিস্তব্ধতার এই গহীন রজনীতে পথ হারা মানুষ মীর কাশেমদের দেখানো আলোতেই পথ খুঁজে পাবে ইনশাঅাল্লাহ । ভানুমতির গল্প দিয়ে যারা তাদের বিজয় কেতন উড়াতে চায় সেই বেকুব আত্ম-অহংকারীদের জন্য আফসোস ! সেই দিন তাদের অবশ্যই আসবে যারা আজকের কৃতকর্মের জন্য সবচেয়ে বেশি আফসোস করবে !  সকলকে একদিন আল্লাহ তায়ালার নিকটে হাজিরা দিতে হবে এবং সেদিন তিনি প্রতিটা কাজের হিসেব নেবেন ।
আমাদের বিনাশ নেই । মেঘ দেখে তুই করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে ! 
প্রতিটি গভীর রাত্রি শেষে সুবহে সাদিকের আলোর মত আমরা জেগে উঠবোই । 
 
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ وَارْحَمْهُ، وَعَافِهِ، وَاعْفُ عَنْهُ، وَأَكْرِمْ نُزُلَهُ، وَوَسِّعْ مُدْخَلَهُ، وَاغْسِلْهُ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ، وَنَقِّهِ مِنَ الْخَطَايَا كَمَا نَقَّيْتَ الثَّوْبَ الأَبْيَضَ مِنَ الدَّنَسِ، وَأَبْدِلْهُ دَاراً خَيْراً مِنْ دَارِهِ، وَأَهْلاً خَيْراً مِنْ أَهْلِهِ، وَزَوْجَاً خَيْراً مِنْ زَوْجِهِ، وَأَدْخِلْهُ الْجَنَّةَ، وَأَعِذْهُ مِنْ عَذَابِ القَبْرِ [وَعَذَابِ النَّارِ]

ইয়া আল্লাহ ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন, তাকে দয়া করুন, তাকে পূর্ণ নিরাপত্তায় রাখুন, তাকে মাফ করে দিন, তার মেহমানদারীকে মর্যাদাপূর্ণ করুন, তার প্রবেশস্থান কবরকে প্রশস্ত করে দিন । আর আপনি তাকে ধৌত করুন পানি, বরফ ও শিলা দিয়ে, আপনি তাকে গুনাহ থেকে এমনভাবে পরিষ্কার করুন যেমন সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে পরিষ্কার করেছেন । আর তাকে তার ঘরের পরিবর্তে উত্তম ঘর, তার পরিবারের বদলে উত্তম পরিবার ও তার জোড়ের (স্ত্রী/স্বামীর) চেয়ে উত্তম জোড় প্রদান করুন । আর আপনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান এবং তাকে কবরের আযাব [ও জাহান্নামের আযাব] থেকে রক্ষা করুন । আমিন ইয়া রব্বাল আলামীন ।
মুসলিম ২/৬৬৩, নং ৯৬৩।

বুধবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৬

ভুমিকম্প কেন হয় ?


আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কতৃক বর্ণিত, আল্লাহর নবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে, কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখা হবে কিন্তু তার খিয়ানত করা হবে (অর্থাৎ যার সম্পদ সে আর ফেরত পাবে না),যাকাতকে দেখা হবে জরিমানা হিসেবে, ধর্মীয় শিক্ষা ব্যতীত বিদ্যা অর্জন করা হবে, একজন পুরুষ তার স্ত্রীর আনুগত্য করবে কিন্তু তার মায়ের সাথে বিরূপ আচরণ করবে, বন্ধুকে কাছে টেনে নিবে আর পিতাকে দূরে সরিয়ে দিবে, মসজিদে উচ্চস্বরে শোরগোল (কথাবার্ত) হবে, জাতির সবচেয়ে দূর্বল ব্যক্তিটি সমাজের শাসক রুপে আবির্ভূত হবে, সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি জনগণের নেতা হবে, একজন মানুষ যে খারাপ কাজ করে খ্যাতি অর্জন করবে তাকে তার খারাপ কাজের ভয়ে সম্মান প্রদর্শন করা হবে, বাদ্যযন্ত্র এবং নারী শিল্পীর ব্যাপক প্রচলন হয়ে যাবে, মদ পান করা হবে (বিভিন্ন নামে মদ ছড়িয়ে পড়বে), শেষ বংশের লোকজন তাদের পূর্ববর্তী মানুষগুলোকে অভিশাপ দিবে, এমন সময় আসবে যখন তীব্র বাতাস প্রবাহিত হবে তখন একটি ভূমিকম্প সেই ভূমিকে তলিয়ে দিবে (ধ্বংস স্তুপে পরিণত হবে বা পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাবে) । [তিরমিযি কতৃক বর্ণিত, হাদিস নং – ১৪৪৭] এই হাদিসের মাঝে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে যে আল্লাহ মহানের পক্ষ থেকে জমিনে কখন ভুমিকম্পের আজাব প্রদান করা হয় এবং কেন প্রদান করা হয় ।
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে উঠার অনুমতি দেন, যার ফলে তখন বড় ধরণের ভূমিকম্প অনুষ্ঠিত হয় । তখন এই ভূমিকম্প মানুষকে ভীত করে । তারা মহান আল্লাহর নিকট তাওবা করে, পাপ কর্ম ছেড়ে দেয়, আল্লাহর প্রতি ধাবিত হয় এবং তাদের কৃত পাপ কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মুনাজাত করে । আগেকার যুগে যখন ভূমিকম্প হত, তখন সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকেরা বলত, ‘মহান আল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক করেছেন' ।

বিজ্ঞান কী বলে ?

ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানের আলোকে ভূপৃষ্ঠের নীচে একটি নির্দিষ্ট গভীরতায় রয়েছে কঠিন ভূত্বক । ভূত্বকের নীচে প্রায় ১০০ কি.মি. পূরু একটি শীতল কঠিন পদার্থের স্তর রয়েছে । একে লিথোস্ফেয়ার (Lithosphere) বা কঠিন শিলাত্বক নামে অভিহিত করা হয় । আমাদের পৃথিবী নামের এই গ্রহের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, কঠিন শিলাত্বক (লিথোস্ফেয়ার) সহ এর ভূপৃষ্ঠ বেশ কিছু সংখ্যক শক্ত শিলাত্বকের প্লেট (Plate) এর মধ্যে খন্ড খন্ড অবস্থায় অবস্থান করছে । ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানের আলোকে এই প্লেটের চ্যুতি বা নড়া-চড়ার দরুণ ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয় ।

ভুমিকম্প বিষয়ক কুরআনতত্ত্বঃ

ভূমিকম্প বিষয়ে পবিত্র কুরআনে সূরা ‘যিলযাল’ নামে একটি সূরাই নাযিল করা হয়েছে । মানুষ শুধু কোন ঘটনা ঘটার কার্যকারণ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয় এবং ভূতত্ত্ববিজ্ঞানও এই কার্যকারণ সম্পর্কেই আলোচনা করে থাকে । কিন্তু কুরআনুল কারীম একই সাথে কোন ঘটনা ঘটার কার্যকারণ বর্ণনার পাশাপাশি উক্ত ঘটনা থেকে শিক্ষনীয় বিষয় কি এবং এই ঘটনা থেকে অন্য আরো বড় কোন ঘটনা ঘটার সংশয়হীনতার প্রতি ইংগিত করে । ভূমিকম্প বিষয়ে কুরআনুল কারীমে দু’টি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে । একটি হল ‘যিলযাল’, যার অর্থ হল একটি বস্তুর নড়াচড়ায় অন্য আরেকটি বস্তু নড়ে ওঠা । দ্বিতীয় শব্দটি হল ‘দাক্কা’, এর অর্থ হল প্রচন্ড কোন শব্দ বা আওয়াজের কারণে কোন কিছু নড়ে ওঠা বা ঝাঁকুনি খাওয়া । পৃথিবীতে বর্তমানে যেসব ভূমিকম্প ঘটছে, তা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে কঠিন শিলাত্বকে চ্যুতি বা স্থানান্তরের কারণে । কিয়ামতের দিন আরেকটি ভূমিকম্পে পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে ধুলিকনায় পরিণত হবে এবং তা হবে ফেরেশেতা হযরত ইসরাফিলের আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিঙ্গায় ফুৎকারের কারণে, যাকে বলা হয় ‘দাক্কা’। যা হবে এক প্রচন্ড আওয়াজ ।

পৃথিবীতে মাঝে মাঝে কঠিন শিলাত্বকের স্থানান্তরের কারণে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প আমাদেরকে এ কথার প্রতি ইংগিত করে যে, একদিন ওই ‘দাক্কা’ সংঘটিত হবে, যার নাম কেয়ামত । তখন এই চাকচিক্যময় দুনিয়ার সবকিছুই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে । মানুষ যেন কিয়ামতকে ভুলে না যায়, দুনিয়াকেই তার আসল ঠিকানা মনে না করে, তাই মাঝে মাঝে মহান আল্লাহ ভূমিকম্পসহ আরো অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগ দিয়ে মানুষকে সতর্ক করে থাকেন ।

ভুমিকম্প একটি আজাবঃ

আল্লাহ মহান পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, বলোঃ  আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম, অথবা তিনি তোমাদের দল-উপদলে বিভক্ত করে একদলকে আরেক দলের শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতেও সম্পূর্ণরূপে সক্ষম ।” (সূরা আল আনআম : ৬৫)

আল-বুখারি তার সহিহ বর্ণনায় জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ যখন তোমদের উপর থেকে (আসমান থেকে) নাজিল হলো তখন  নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি তোমার সম্মূখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, অথবা যখন, অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আজাব নাযিল হলো, তখন রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমার সম্মূখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি । (সহিহ বুখারি, ৫/১৯৩)

আবূল-শায়খ আল-ইস্পাহানি এই আয়াতের তাফসিরে বর্ণনা করেন, “বলোঃ আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) তীব্র শব্দ, পাথর অথবা ঝড়ো হাওয়া; আর অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম- যার ব্যাখ্যা হলো, ভুমিকম্প এবং ভূমি ধ্বসের মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়া ।

বান্দার ওপর আজাব কেন আসে ?

হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু  হতে বর্ণিত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করছেনঃ যখন আমার উম্মত যখন ১৫ টি কাজে লিপ্ত হতে শুরু করবে তখন তাদের প্রতি বালা মুসীবত আসতে আরম্ভ করবে । কাজগুলো হলোঃ
১. গণীমতের মাল ব্যাক্তিগত সম্পদে পরিণিত হবে ।
২. আমানতের সম্পদ পরিনত হবে গনীমতের মালে ।
৩. জাকাত আদায় করাকে মনে করবে জরিমানা আদায়ের ন্যায় ।
৪. স্বামী স্ত্রীর বাধ্য হবে ।
৫. সন্তান মায়ের অবাধ্য হবে ।
৬. বন্ধু-বান্ধবের সাথে স্বদব্যাবহার করা হবে ।
৭. পিতার সাথে করা হবে জুলুম ।
৮. মসজিদে উচ্চস্বরে হট্টোগোল হবে ।
৯. অসাম্মানী ব্যাক্তিকে জাতির নেতা মনে করা হবে ।
১০. ব্যাক্তিকে সম্মান করা হবে তার অনিষ্ট থেকে বাচার জন্য ।
১১. প্রকাশ্যে মদপান করা হবে ।
১২. পুরুষ রেশমী পোষাক পরবে ।
১৩. গায়িকা তৈরি করা হবে ।
১৪. বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা হবে। 
১৫.পুর্ববর্তী উম্মতদের (সাহাবী, তাবে তাবেঈন) প্রতি অভিসমাপ্ত করবে পরবর্তীরা ।
এই কাজগুলি যখন পৃথিবীতে হতে শুরু হবে তখন অগ্নীবর্ষী প্রবল ঝড়, ভুমিকম্প ও কদাকৃতিতে রূপ নেয়ার অপেক্ষা করবে । এখন একটু চিন্তা করা উচিত যে আমরা এগুলোর মাঝেই লিপ্ত রয়েছি । আর যখন আমাদের উপর মুসীবত আসে তখন প্রকৃতির বা মানুষের বা অন্যান্য জিনিসের দোষ দেই । আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত যে সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন আমরা হই তা আসলে আমাদের গুনাহের কারনেই এত আযাব ।

ভুমিকম্প হলে করনীয় কি?

যখন কোথাও ভূমিকম্প সংগঠিত হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন মানুষদের উচিত মহান আল্লাহর নিকট অতি দ্রুত তওবা করা, তাঁর নিকট নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা এবং মহান আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা যেভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য গ্রহণ দেখলে বলতেন, যদি তুমি এরকম কিছু দেখে থাক, তখন দ্রুততার সাথে মহান আল্লাহকে স্মরণ কর, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর । [বুখারি ২/৩০ এবং মুসলিম ২/৬২৮] বর্ণিত আছে যে, যখন কোন ভূমিকম্প সংগঠিত হতো, উমর ইবনে আব্দুল আযিয রাহিমাহুল্লাহ তার গভর্ণরদের দান করার কথা লিখে চিঠি লিখতেন ।
মহা গ্রন্থ আল-কুরআনের একাধিক আয়াতে বলা হয়েছে যে, জলে স্থলে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয় তা মানুষেরই কৃতকর্মের ফল । আল্লাহ সুভানাহু তায়ালা মানুষের অবাধ্যতার অনেক কিছুই মাফ করে দেন । তারপরও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় ।পবিত্র কুরআন নাজিল হওয়ার পূর্বেকার অবাধ্য জাতি সমূহকে আল্লাহপাক গজব দিয়ে ধ্বংস করেছেন । সে সবের অধিকাংশ গজবই ছিল ভুমিকম্প । ভুমিকম্প এমনই একটা দুর্যোগ যা নিবারন করার মতো কোন প্রযুক্তি মানুষ আবিষ্কার করতে পারে নাই । এর পূর্বাভাষ পাওয়ার মতো কোন প্রযুক্তিও মানুষ আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারে নাই । হাদিস শরীফেও একাধিকবার বলা হয়েছে যে, মানুষের দুষ্কর্মের জন্যই ভুমিকম্পের মতো মহা দুর্যোগ ডেকে আনে । পবিত্র কুরআন এবং হাদীসে আদ, সামুদ, কওমে লুত এবং আইকার অধিবাসীদের ভুমিকম্পের দ্বারা ধ্বংস করার কাহিনী বিভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করা হয়েছে ।


একটু ভাবুন তো...

সামান্য এই ভূমিকম্পেই সম্পদের মায়া ছেড়ে আমরা রাস্তায় নামছি । এটা যখন আরো বাড়বে, তখন সম্পর্কের মায়াও ছেড়ে দেবো আমরা । নিজেকে বাচানোর চেষ্টায় ব্রতী হবো সবাই । যখন তার চাইতেও আরো বাড়বে তখন যেই মা দুধ খাওয়াচ্ছেন তিনিও তার বাচ্চাকে ছুড়ে ফেলে দেবেন, গর্ভের শিশুকেও বের করে দেবেন । ভূমিকম্পের সময় কে কি অবস্থায় ছিলাম, কে টের পেয়েছে, কে টের পায়নি, চেয়ার টেবিল নড়ছিলো কিনা, ফ্যান দুলছিলো কিনা- এই সব গবেষণা পরে করলেও হবে । আগে করা দরকার তওবা, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া । সবচেয়ে বড় কথা হল, এটি আল্লাহ কর্তৃক একটি নিদর্শন । যাতে করে মানুষ স্বীয় অপরাধ বুঝতে সক্ষম হয় । ফিরে আসে আল্লাহর পথে । আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের সবাইকে আন্তরিকতার সাথে খাটি তওবা করার তাওফিক দান করুন । আমিন ইয়া রব ।









রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৬

আপনি কোনটি পালন করছেন ?

আজ ঐতিহাসিক ১৫ই আগষ্ট ।

১৯৪৬ সালের এইদিনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জন্ম গ্রহন করেন । খালেদা জিয়ার শুভ জন্মদিন কিন্তু  দেশের ‘চলমান সংকট, উত্তরঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি ও নেতা-কর্মীদের জেল-গুম-খুনের’ কারণে খালেদা জিয়া এ বছর জন্মদিনের অনুষ্ঠান না করার জন্য নেতা কর্মী ও ভক্তবৃন্দকে নির্দেশ দিয়েছেন । 

১৯৪৭ সালে ১৫ আগষ্ট ২০০ বছর ইংরেজদের গোলামীর জিঞ্জির থেকে ভারত স্বাধীন হয় । আজ  ভারতের মহান স্বাধীনতা দিবস । 
---
১৯৬৯ সালের ১৫ আগষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র আব্দুল মালেক নিহত হন । পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত এ বিষয়ে তিনি তার মতামত যুক্তি সহকারে তুলে ধরার চেষ্টা করেন । তার প্রতিপক্ষ ছিল তৎকালীন ছাত্রলীগ ও বাম ছাত্র সংগঠনগুলি । তারা এখনকার মতই যুক্তির বদলে শক্তিকেই বেছে নেয় ! ততকালীন রেসকোর্স ময়দানে নির্মমভাবে পিটিয়ে মাথায় ইট দিয়ে থেতলিয়ে আহত করে তাকে । পরে হাসপাতালে মারা যান তিনি । এ ঘটনায় সব শ্রেণীপেশার মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় ! রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সরকারের শিক্ষামন্ত্রীসহ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন । তৎকালীন পাকিস্তান আওয়ামীলীগ এর জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান । তাই ইসলামী ছাত্র শিবির আজকের দিনকে "শিক্ষা দিবস" হিসেবে পালন করে ।  

সবাই জানেন, জাতীয় শোক দিবস । ১৯৭৫ সালের এইদিনে স্বপরিবারের নিহত হন স্বাধীনতার স্থপতি, প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান । এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় এই নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার । পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ নেতা খন্দকার মুশতাক ক্ষমতা গ্রহণ করেন । কিন্তু দূর্ভাগের বিষয় দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকমীদের কাছে সেই সময়ে সামান্যতম সহানুভূতিও পাননি এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট । ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আবারও আওয়ামীলীগ রাস্ট্র ক্ষমতায় । বাংলাদেশের জনগণ বিশেষ করে যারা আগে কখনও আওয়ামী শাসন দেখেননি তারা নতুন করে তাদের শাসন স্টাইল(!) নতুন করে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন ।
সময় মানুষকে সম্মানিত করে আর সময়ের কারণেই মানুষ অসম্মান বয়ে আনে । সম্মানজনক জীবনই শেষ কথা নয় সম্মানের মৃত্যুও সমান গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ ।

রবিবার, ৭ আগস্ট, ২০১৬

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে ইসলামঃ মাওলানা সাঈদী (পর্ব - ৬)

শক্তি প্রয়োগে আদর্শ প্রতিষ্ঠা

ইতিহাসে দেখা যায়, রাষ্ট্র বা দলীয় শক্তি প্রয়োগ করে কোনো কোনো আদর্শ দেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে । শাস্তির ভয়ে প্রকাশ্যে অনিচ্ছাকৃতভাবে মানুষ সে আদর্শের অনুসরণ করেছে আর আড়ালে প্রকাশ করেছে অন্ত্রের ঘৃণা । অনেক রাজা বদশাহই এ ধরনের হঠকারিতামূলক কাজ করেচ্ছেন । তারা যে বোধ-বিশ্বাস অন্তরে লালন করতেন, তাই জোরপূর্বক জাতির উপর আইন প্রয়োগ করে চাপিয়ে দিতেন । বিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নেও আমরা দেখতে পেয়েছি, ইয়াহুদী সন্তান কার্লমার্কস সৃষ্ট সমাজতন্ত্র নামক আদর্শও রাস্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার নির্মম-নিষ্ঠুর কার্যক্রম । 
কিন্তু যারা এই অবাস্তব পদ্ধতি প্রয়োগ করে আদর্শ টিকিয়ে রাখার প্রচেস্টা চালিয়েছে, তারা এ কথা ভুলে গিয়েছে যে, বিশ্বাস হলো মানুষের মনের সাথে সম্পৃক্ত । শক্তি প্রয়োগে কোনো বিশ্বাসের প্রতি মানুষের মৌখিক স্বীকৃতি আদায় করা যায় বা কিছু সময়ের জন্য পালন করানোও যায় কিন্তু হৃদয়-মনে তা প্রতিষ্ঠিত করা যায় না । মানুষ তো পরম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও নিষ্ঠার সাথে সেই আদর্শই অনুসরণ করে, যারা তা মনপ্রান দিয়ে বিশ্বাস করে । যে আদর্শের শিকড় হৃদয়- গভীরে প্রোথিত, তাই মানুষের বাহ্যিক অবয়বে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ।
সম্রাট অশোক, সম্রাট আকবর, হালাকু খান, চেঙ্গিশ খান শক্তি প্রয়োগ করে কতো নিয়ম-নীতি চালু করেছিলেন, এসবের কোন অস্তিত্বও নেই । নিকট অতীতে সমাজতান্ত্রিক দেশসমুহে সমাজতন্ত্রের প্রবক্তাদের প্রচলিত নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা তো দূরে থাক, তাদের বিশাল বিশাল মূর্তি গুলোর গলায় শিকল লাগিয়ে টেনে নামানো হয়েছে । শক্তি প্রয়োগ করে, লোভ লালসা দেখিয়ে, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা করে যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা হয়, সে আদর্শ অত্যন্ত ভঙ্গুর এবং এর স্থায়িত্ব নেই- ক্ষণস্থায়ী । সামান্য কিছু কালের ব্যবধানে এর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে ।
পৃথিবীতে একমাত্র ইসলামই হলো ব্যতিক্রম সেই আদর্শ, যা লোভ-লালসা দেখিয়ে, প্রতারনা-প্রবঞ্চনা করে অথবা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রচার-প্রসার করা হয়নি । ইসলামী আদর্শের বাহ্যিক ও অভ্যান্তরিন অনুপম গুন-বৈশিস্ট্য, নবী- রাসুলদের আকর্ষণীয় চারিত্রিক গুন এবং সাহবায়ে কেরামের আচরিত তুলনাহীন গুনাবলীর প্রতি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেনীর মানুষ আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম কবুল করেছে । আর এভাবেই ইসলামের প্রচার -প্রসার ঘটেছে । সুতরাং সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, বোমাবাজি করে, মানুষ হত্যা করে জঙ্গি পন্থায় যারা আল্লহর আইন চালু করার চিন্তা করে, তাদের বোঝা উচিত এপথ ইসলামের নয় এবং এপথ অবলম্বন করে মানুষের মনে আল্লাহর আইনের প্রতি সম্মানবোধ, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা সৃষ্টি করা যাবে না ।
ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ঢাল চুরির ঘটনা ইতিহাসের পাঠক মাত্রই অবগত রয়েছেন । তার ঢাল চুরি করলো এক ইয়াহুদী, তিনি রাস্ট্রপ্রধানের পদে আসীন । রাস্ট্রশক্তি প্রয়োগ করে ইয়াহুদীকে চরম শাস্তি দিয়েই তো ঢালটি উদ্ধার করতে পারতেন কিন্তু ইসলামী শিক্ষা তাকে সে পথে অগ্রসর হতে না দিয়ে আদালতে বিচারকের কাছে পাঠিয়েছে । আদলতে সাক্ষী গ্রহনযোগ্য না হবার কারনে ইয়হুদীর পক্ষে আর ইসলামী রাস্ট্রপ্রধানের বিপক্ষে রায় দিয়েছে । রাস্ট্রপ্রধান আদালতের রায় মেনে নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছেন । পথিমধ্যে সেই ইয়াহুদী ছুটে এসে হযরত আলীকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল কন্ঠে বলছে, যাদের আদর্শ এতো সুন্দর মানুষ সৃষ্টি করেছে, আমি সেই আদর্শ গ্রহন করে মুসলমান হলাম । এই নিন আপনার ঢাল, এটি আমিই চুরি করেছিলাম ।  
ইসলাম এভাবেই প্রসারিত হয়েছে, শক্তি প্রয়োগে নয় ।  ***** চলবে *****

বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৬

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে ইসলামঃ মাওলানা সাঈদী (পর্ব - ৫)

আল্লাহর আইন- বৃটিশ ও পাকিস্তান যুগঃ

বৃটিশ এদেশকে প্রায় দুইশত বছরব্যাপী শাসন করেছে । এরপর ২৪ বছর বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত ছিলো । তখন তো কেউ-ই  'আল্লাহর আইন চালু'র নামে এদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপর্যয় সৃষ্টি করেনি । ১৯৭১ সালে মহান  মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ স্থান করে নিলো, একের পর এক সরকার পরিবর্তন হলো, দীর্ঘ এ সময়েও কেউ উক্ত দাবি তুলে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাস সৃষ্টি করেনি ।
১৯৯৬ সালের পরে এদেশের শাসন ক্ষমতায় যারা এলেন, তাদের শাসনামলে ১৯৯৯ সালের ৬ই মার্চ যশোরে উদীচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা করা হলো । একই সালের ৮ই অক্টোবর খুলনায় কাদিয়ানীদের উপাসনালয়ে বোমা নিক্ষেপ করে ৮ জনকে হত্যা করা হলো এবং ফরিদপুর জেলার এক মাজারে বোমা নিক্ষেপ করে হত্যা করা হলো ৪ জনকে । ২০০১ সালের ২০শে জানুয়ারী ঢাকার পল্টন মাঠে কমিউনিস্ট পার্টির সমাবেশে বোমা হামলা করে হত্যা করা হলো ৭ জনকে এবং  একই সময়ে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বোমা বিস্ফোরন ঘটানো হলো । ২০০১ সালের ১৪ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখে ঢাকার রমনা বটমুলে নববর্ষের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে ১০ জনকে হত্যা করা হলো । ২০০১ সালের জুন মাসের ৩ তারিখে গোপালগঞ্জের বানিয়ারচরের একটি গির্জায় বোমা বিস্ফোরন ঘটিয়ে ১০ জনকে হত্যা করেছে । একই বছরের ঘটনা অর্থাৎ কয়েকদিন পর ১৫ই জুন নারায়ণগঞ্জের আওয়ামীলীগ কার্যালয়ে বোমা বিস্ফোরন করে হত্যা করা হয় ২২ জনকে । ২৩শে সেপ্টেম্বর বাঘেরহাটের মোল্লারহাটে বোমা বিস্ফোরন করে হত্যা করলো ৮ জনকে । ২৬শে সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জে আওয়ামীলীগ সমাবেশে বোমা নিক্ষেপ করে হত্যা করলো ৪ জনকে ।
অর্থাৎ ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০১ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বোমা নিক্ষেপ করে অনেক মানুষ হত্যা করা হয়েছিলো, চিরতরে পঙ্গু করে দিয়েছে কয়েক শত মানুষকে এবং কয়েক কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট করা হয়েছিলো । এসব বোমাবাজি যেখানে যেখানে ঘটলো বা ঘটানো হলো, সেখানের কোথাও 'আল্লাহর আইন চালু'র দাবি তুলে বোমা নিক্ষেপ হয়েছে বলে শোনা যায়নি এবং 'আল্লাহর আইন চালু'র পক্ষে কোন সংগঠনের লিফলেটও পাওয়া যায়নি । এ সময়ে বাংলাদেশের কোন একটি আদালতের  বিচারককেও হুমকি দিয়ে কেউ-ই কোনো চিঠি দিলো না, আদালতেও কেউ বোমা নিক্ষেপ করলো না এবং আত্মঘাতিকোনো লোকেরও সন্ধান পাওয়া গেলো না ।
বাংলাদেশকে 'অকার্যকর ও ব্যর্থরাষ্ট্র' হিসেবেও কোন মহল থেকে চিহ্নিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হলো না ।
২০০১ সালের ১লা অক্টোবরের নির্বাচনে ইসলামী মুল্যবোধে বিশ্বাসী চার দলীয় ঐক্যজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শাসন ক্ষমতায় আসীন হলো । ইতিপূর্বে যখন কুকুরের মাথায় টুপি পরিয়ে ইসলামপন্থীদের অমর্যাদা করা হয়েছে, খুনের অভিযোগে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীন আলেমকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়েছে, মসজিদ মাদরাসা বন্ধ করা হয়েছে, অগণিত আলেম উলামাকে গ্রেফতার করে জেলখানা পরিপূর্ণ করা হয়েছে । সেখানে ১লা অক্টোবরের নির্বাচনের পরে আলেম-উলামাগন সম্মান মর্যাদার আসনে আসীন হয়েছেন । প্রচার মাধ্যমে তারা বক্তব্য রাখার ও সরকারী অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেয়েছেন । প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী ও এমপিগন আলেমদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন, মাদরাসা শিক্ষার প্রতি সরকার গুরুত্ব দিয়েছিলো ও সন্ত্রাস নির্মূলের লক্ষে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করেছিলো ফলে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছিলো । এই যখন দেশের বাস্তব অবস্থা, ঠিক তখনই চার দলীয় জোট সরকারের শেষ বছরে হঠাৎ করে নানা ধরনের ভুঁইফোড় সংগঠনের নাম দিয়ে 'আল্লাহর আইন চালু'র নামে আত্মঘাতি বোমাবাজদের মাধ্যমে দেশে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা করা  এবং সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা হয়েছিলো ।

ইসলামের নাম শুনলেই যাদের গাত্রদাহ শুরু হয় এবং আলেম দেখলেই যাদের নাকে কয়েকটি ভাজ দেখা যয়, কুকুরের মাথায় টুপি পরিয়ে যারা ইসলামকে ব্যং-বিদ্রুপ করে, মাদরাসাকে যারা মৌলবাদী ও সন্ত্রাসীদের আখড়া বলে চিহ্নিত করে, সংবিধানের শুরু থেকে  "বিসমিল্লাহ" মুছে দিতে চায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রাম থেকে যারা কুরআনের আয়াত মুছে দেয়, নাস্তিক-মুরতাদদের যারা পরম হিতৈষী -বন্ধু এবং আলেমদেরকে শত্রু মনে করে, চারদলীয় জোটকে ক্ষমতায় যাবার প্রধান বাধা মনে করে যারা, জোট ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র-এ ব্যর্থ হয়ে প্রকাশ্যে দাবি তোলে, উদ্ভুত সমস্যা সমাধানের লক্ষে জাতীয় ঐক্য গড়ার লক্ষে যারা আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানায়, 'আল্লাহর আইন চালু'র নামে আত্মঘাতি বোমাবাজ তাদেরই তত্ত্বাবধানে সৃষ্টি ও পরিচালিত হচ্ছে কিনা, এ প্রশ্ন বর্তমানে সর্বস্তরের নাগরিকদের মনে সৃষ্টি হয়েছে ।   ***** চলবে *****