বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৫

শহীদ আলী আহসান মো: মুজাহিদকে যেভাবে বিদায় দিয়ে আসলাম....


(আমার ব্যক্তিগত  কৃতজ্ঞতাঃ যদিও লেখাটি আমার নামে প্রকাশিত হচ্ছে তবে মুল লেখনি আমার নয় ।  আমার ভুমিকা এখানে অনেকটা সংকলনের ।
আমরা যারা শহীদ আলী আহসান মো: মুজাহিদকে শেষ বারের মত দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম, তারা সকলেই একমত হয়েছি যে এই সাক্ষাতটি লিপিবদ্ধ হওয়া দরকার । তবে সেদিনের সেই ঘটনাটি যেহেতু মানসিকভাবে প্রত্যেকের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছে, তাই কারও মনেই এককভাবে পুরো ঘটনাটির স্মৃতিচারন করা দু:সাধ্য ছিল । সেই পরিপ্রেক্ষিতে শহীদ আলী আহসান মো: মুজাহিদের গোটা পরিবার বিশেষ করে আমার মা, বোন, বোন-জামাই, দুই ভাই, ভাবীরা সকলেই এবং ছোট চাচা কয়েকদফা বসে এই লেখাটি চুড়ান্ত করেছি । আমরা চেষ্টা করেছি সেদিন যা ঘটেছে বা শহীদ আলী আহসান মো: মুজাহিদ পরিবারের সদস্যদের সাথে শেষ সাক্ষাতে যা বলেছেন, যেই ভাষায় বলেছেন তাই লিপিবদ্ধ করতে । এই চেষ্টার সফল বাস্তবায়নে উপরোক্ত সকলের ভুমিকা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরন করছি) । ★ Ali Ahmad Mubrur
২১ নভেম্বর রাত ৮টা । আমি তখন পুরানা পল্টনস্থ আইনজীবীদের চেম্বারে । পরিবারের বাকি সবাই উত্তরাস্থ বাসভবনে । হঠাৎ বাসা থেকে ফোন- আমাদেরকে মানে পরিবারকে নাকি শেষ সাক্ষাতের জন্য যেতে বলেছে । ডেপুটি জেলার শিরিন আমার বড় ভাই আলী আহমেদ তাজদীদকে ফোন দিয়ে রাত ৯টার মধ্যে কারাগারে পৌছতে বলেছে । আমি সাথে সাথে তাদেরকে বললাম, আমি তো কাছেই আছি । আপনারা জলদি বের হন । আমি সাথে সাথে সংগঠনের সবাইকে অবহিত করলাম এবং তাদের কাছ থেকে কিছু জানার চেষ্টা করলাম; শেষ সাক্ষাত কোন পরামর্শ আছে কিনা । আইনজীবীদেরকেও জানালাম । তারপর অযু করে কারাগারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম ।
আমাদের পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের মোট ২৫জন সদস্য সেদিন কারাগারে গিয়েছিলাম ।  রাত ১১টার দিকে আমরা সেখানে পৌছাই । ঢোকার পরে প্রয়োজনীয় তল্লাশী শেষে রাত ১১-২০ মিনিটে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের সেল রজনীগন্ধায় পৌছাই । রজনীগন্ধায় সেলের একেবারে ডানকোনায় ৮ নং সেলে আব্বা থাকছেন । এর আগেও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ও শহীদ মুহাম্মাদ কামারুজ্জামানও সেই ঘরটিতেই ছিলেন । আমরা গত কয়েকমাসেও সেখানেই আব্বার সাথে সাক্ষাত করেছি । আমার আগে আব্বার এক নাতি, আমার আম্মা আর বোন আব্বার ঘরে পৌছান । আমি ৪ নম্বর ব্যক্তি হিসেবে পৌছাই, সাথে অন্যরাও । আমি ধারনা করেছিলাম, যেহেতু এত লোক যাচ্ছি শেষ সাক্ষাত । আব্বা হয়তো আমাদের জন্য তৈরী হয়ে বসে থাকবেন । কিন্তু আমরা রুমের বাইরের করিডোরে বা রুমের ভেতরে দাঁড়ানো কোন অবস্থাতেই আব্বাকে পেলাম না । ভেতরে তাকিয়ে দেখি, আব্বা শুয়ে আছেন । পরে বুঝলাম গভীর ঘুমে আছেন । ডান দিকে কাত হয়ে গালের নীচে হাত দিয়ে সবসময় যেভাবে ঘুমাতে দেখেছি সেভাবেই তিনি ঘুমাচ্ছেন । গায়ের উপর কাঁথা নেই, ছোট রুমের মাটিতে জায়নামাজের উপর শুয়ে আছেন । মাথার নীচে কোন বালিশও নেই । আমার বোন, আমরা সবাই আব্বা আব্বা বলে ডাকছি । আর আমার ভাইয়ের ছেলেরা ডাকছে দাদা দাদা বলে । কিন্তু আব্বার কোন সাড়া নেই । যেন ঘুমের সাগরে তলিয়ে আছেন তিনি । এভাবে প্রায় মিনিট খানেক ডাকাডাকির পর আব্বা একটু গুঙ্গিয়ে বললেন, কে কে আব্বা বলে ? তারপর আমাদের দেখে বললেন, ও তোমরা আসছো । এত রাতে কি ব্যাপার ? তোমাদের কি কারা কর্তৃপক্ষ ডেকেছে ? এটা কি শেষ সাক্ষাত ? ততক্ষনে তিনি উঠে বসেছেন । আমাকে তো জেল কর্তৃপক্ষ কিছু জানায়নি । তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ । কিছুটা সময় তিনি বসেই থাকলেন । মনে হলো গভীর ঘুম থেকে উঠার জন্য, পাশাপাশি আমাদের উদ্দেশ্যে তার দিক নির্দেশনাগুলো গুছানোর জন্য আল্লাহর সাহায্য চাইছেন ।
আমরা তাকে উত্তর দিলাম, জ্বী আব্বা, আমরা আমাদের শহীদ হতে যাওয়া বাবার কাছে আসছি । আমরা আমাদের গর্বের ধনের কাছে আসছি । আমার বোন বললো, আমরা আমাদের মর্যাদাবান পিতার সাথে দেখা করতে এসেছি । আমাদেরকে ওরা আজ শেষ বারের জন্য আপনাকে দেখার জন্য ডেকেছে । তিনি এভাবে বসে থাকলেন কিছুক্ষন । বসে বসেই আমাদের কথা শুনলেন । আম্মা বললেন, উঠে আসো । সব শুনে তিনি বললেন ও আচ্ছা, আলহামদুলিল্লাহ । কিছুক্ষন পর তিনি উঠলেন, দাঁড়ালেন । ফিরোজা রং এর গেঞ্জী, সাদা নীলের স্ট্রাইপ পড়া পায়জামা পড়ে ছিলেন তিনি । কিছুক্ষন স্যান্ডেল খুজলেন । পরে খুজে পেয়ে স্যান্ডেল পড়ে আমাদের সামনে দাঁড়ালেন । বললেন কে কে আসছো, কয়জন, আমিই একটু দেখি (সেই সময় লাইটের আলো কম থাকায় ভেতর দিকে ভাল দেখা যাচ্ছিলো না । সেলের লোহার দরজার বাইরে নেটের দরজা দিয়ে লাগানো ছিল । পরে আমার বড় ভাই সেই দরজাটি খুলে দিলেন । আমরা পরিবারের সদস্যরা আগে একে একে সালাম দিলাম, তারপর আত্মীয়রা । আমার বড় ভাইরা প্রত্যেকের নাম বলে দিচ্ছিলেন যে, যে কারা সেদিন সাক্ষাতে গিয়েছিল । কিন্তু আব্বা বললেন দাড়াও আমিই দেখে নেই । তারপর সবাই একটু জোরে নীজেদের নাম বলে উপস্থিতি জানান দিলেন । কিন্তু আব্বা আলাদা আলাদা করে প্রত্যেককে কাছে ডেকে তাদের সাথে হাত মিলাতে শুরু করলেন । একে একে সবাই শিকের ভেতর দিয়ে হাত মেলালেন । প্রত্যেকটা মানুষের সাথে তিনি তাদের খোজঁ খবর নিলেন । যার যা সমস্যা সেটা নিয়েই তিনি আলাপ করলেন । প্রত্যেকে সেল দিয়ে বের হয়ে থাকা তার দুটি হাত ছুয়ে সালাম দিলেন । কেউ বা চুমু দিলেন । শেষ করে বললেন, কারও সাথে মুসাবাহ করা বাদ যায়নি তো ? 
আব্বা দাঁড়ানোর পর আমি নিজ থেকেই একটা সূচনা বক্তব্য দিলাম । বললাম আব্বা আপনি শহীদ হতে যাচ্ছেন । আপনি এর মাধ্যমে নিজেকে ও আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানীত করে যাচ্ছেন । আপনি আমাদেরকে দুনিয়াতেও সম্মানীত করেছেন, আখিরাতেও সম্মানীত করতে যাচ্ছেন ।অতএব মোটেও দুশ্চিন্তা করবেননা । আপনাকে আপনার আব্বা, আমার দাদা মরহুম মাওলানা আব্দুল আলী ইসলামী আন্দোলনের জন্য ওয়াকফ করে গেছেন । আমি মনে করি এরকম একজন ওয়াকফ হওয়া মানুষের সর্বোত্তম ইতি আজ হতে যাচ্ছে । কেননা আপনি আপনার ছাত্র জীবন, যৌবন, মাঝবয়স সব আন্দোলনের জন্য ব্যায় করে এখন দ্বীন কায়েমের জন্য গলায় ফাঁসির দড়ি নিচ্ছেন । আপনার শাহাদাতে সবচেয়ে খুশী হবেন আপনার পিতা মরহুম মাওলানা আব্দুল আলী । কেননা আপনি তার রেখে যাওয়া ওয়াদা অনুযায়ী জীবন যাপন করে আজ দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছেন ।
আব্বা, সেলের দরজায় স্বভাবসুলভ ভংগিতে লোহার শিক ধরে দাঁড়িয়েছেন । এরপর তিনি প্রথম শব্দ করলেন আলহামদুল্লিাহ । প্রথম কথা বললেন, তোমরা জেনে রাখ, কারা কর্তৃপক্ষ এখনও পর্যন্ত আমাকে জানায়নি যে তারা আজ আমার ফাঁসি কার্যকর করতে যাচ্ছে । এটা কত বড় জুলম ?  তখন একটা আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হতে যাচ্ছিল । কিন্তু আব্বা বললেন, কান্নাকাটির দরকার নেই । আমি কিছু কথা বলবো ।
এরপর তিনি অত্যন্ত স্বভাবসুলভ তেজদীপ্ত বলিষ্ঠ কন্ঠে, মাথা উচু করে অনেকটা ভাষনের ভংগিমায় শুরু করলেন, নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসুলিহিল কারীম । উপস্থিত অন্যরা তখনও একটু আবেগ প্রকাশ করছিল, আব্বা আবারও বললেন নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসুলিহিল কারীম । আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, আসসালাতু আসসালামু আলা সাইয়্যেদুল মুরসালীন । ওয়ালা আলিহী ওয়া সাহবিহী আজমাইন । আম্মা বা’আদ । আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া । জেল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ যে তারা এই সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়েছেন । জেল কর্তৃপক্ষ আসলে অসহায় । তারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এই পর্যন্ত আমাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছেন এবং আমার সাথে ভাল ব্যবহার করেছেন । তারা আমাকে একটি লিখিত আবেদনের জন্য যথেষ্ট পীড়াপীড়ি করেন এবং বলেন এটা না হলে তাদের অসুবিধা হয়ে যাবে । এক পর্যায়ে তারা বলেন, আপনার যা বক্তব্য আছে তাই লিখে দেন । আর সেই কারনেই এটা বলার পর আমি কনসিকুয়েন্স বুঝেও আমি তাদের সুবিধার জন্য একটি লিখিত আবেদন দিয়েছি ।
আমি প্রশ্ন করলাম, আব্বু আপনি ঐ চিঠিতে আসলে কি লিখেছেন ?
উত্তরে তিনি বললেন, আমি রাষ্ট্রপতিকে লিখেছি, আইসিটি এ্যাক্ট, যদিও এটা অবৈধ ও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক তারপরও এই বিচারের সময় আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সীমিত সুযোগ দেয়া হয়েছে । আমার ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইন, সাক্ষ্য আইন প্রযোজ্য ছিলনা । সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে ।
আমাকে ট্রাইবুনাল ৬ নং চার্জে মৃত্যুদন্ড দেয়নি । তারা চার্জ ১ কে চার্জ ৬ এর সাথে মিলিয়ে চার্জ ৬ এ মৃত্যুদন্ড দিয়েছে । আপীল বিভাগ আমাকে চার্জ  ১ থেকে বেকসুর খালাস দিয়েছে ।  চার্জ ৬ এ তারা আমার মৃত্যুদন্ড বহাল রেখেছে । অথচ ট্রাইবুনাল শুধু চার্জ ৬ এর জন্য আমাকে মৃত্যুদন্ড দেয়নি । এই চার্জে স্বাক্ষী মাত্র একজন । সে বলেনি, যে কোন বুদ্ধিজীবিকে আমি হত্যা করেছি । কোন বুদ্ধিজীবি পরিবারের সন্তানও এসে বলেনি যে আমি কোন বুদ্ধিজীবিকে মেরেছি । এবং কোন বুদ্ধিজীবি পরিবারও আমার রায়ের পরও দাবী করেনি যে তারা তার পিতা হত্যার বিচার পেয়েছেন । আমার অপরাধ হিসেবে বলা হয়েছে যে আমি নাকি আর্মী অফিসারদের সাথে বসে পরামর্শ দিয়েছি । কিন্তু যে স্বাক্ষী এসেছে সেও বলেনি যে আমি কবে কোন আর্মি অফিসারের সাথে কোথায় বসে এই পরামর্শ করলাম ?
স্বাক্ষী বলেছে আমাকে, নিজামী সাহেব ও অধ্যাপক গোলাম আযমকে দেখেছে । সে আমাদের চিনতো না । পরে আমাদের নাম শুনেছে । অথচ এই অভিযোগটি গোলাম আযমের সাহেবের বিরুদ্ধে আনাই হয়নি । নিজামী ভাইকে যাবজ্জীবন দিয়ে শুধু আমাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে । আমি নিশ্চিত যে আমার মৃত্যুদন্ডের রায় কনফার্ম করে তারপর আমার বিরুদ্ধে বিচারের নামে প্রহসন শুরু করা হয়েছে । (আমরা সকলে তখন চিৎকার করে বললাম শেম)
আমাকে আমার পরিবার, সংগঠন ও দেশবাসীর কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য, কাপুরুষ প্রমান করার জন্য দিনভর রাষ্ট্রীয়ভাবে এই মিথ্যাচারের নাটক করা হয়েছে । এই জালিম সরকারের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসেনা । (এই সময় তার কন্ঠে প্রচন্ড রাগ ও ক্ষোভের সুর প্রকাশ পায়) । আমি নির্দোষ, নির্দোষ এবং নির্দোষ । আমাদের আজ তারা অন্যায় ভাবে হত্যা করতে যাচ্ছে । কত বড় স্পর্ধা তাদের যে তারা মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার করার দাবী করে । অথচ তাদের নিজেদের ভেতর মানবতা নেই । তারা ঘুমন্ত অবস্থায় একজন মানুষকে মধ্যরাতে তুলে তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসে বলে এই তাদের শেষ সাক্ষাত এবং এরপরও তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হবে ।
তারা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মত লোককেও একইভাবে মাঝরাতে তুলে তার পরিবারের সাথে সাক্ষাতের জন্য ডেকেছে । এটা কেমন মানবতা ? আমার মত তিনিও বিচারিক প্রক্রিয়ার যাবতীয় ত্রুটি ও অসংগতি নিয়ে ইংরেজীতে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখেছেন ।
তোমরা শুনে রাখো, তোমরা চলে যাওয়ার পর আজ যদি আমার ফাঁসি কার্যকর করা হয় তাহলে তা হবে ঠান্ডা মাথায় একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা । তোমরা প্রতিহিংসাপরায়ন হবানা । তোমাদের কিছুই করতে হবেনা । আজ আমার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পর এই অন্যায় বিচারিক প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেকের বিচার আল্লাহর দরবারে শুরু হয়ে যাবে, বিচার শুরু হয়ে গেছে । তোমাদের কারও কিছু করতে হবেনা ।
তোমাদেরকে আজ আমি আমার সত্যিকারের জন্ম তারিখ বলি । আমাদের সময় জন্মতারিখ সঠিকভাবে লিখা হতোনা । আমাদের শিক্ষকেরাই ছাত্রদের জন্ম তারিখ বসিয়ে দিতেন । আমার সত্যিকারের জন্ম তারিখ বলি । আমার জন্ম ১৪ আগষ্ট, ১৯৪৭, ২৭ রমজান । আমার চেয়ে শেখ হাসিনা মাত্র ১ মাসের ছোট । সে আমাকে ভালভাবেই চিনে । সে ভাল করেই জানে আমি কোন অন্যায় করিনি কেননা তার সাথে সাথে আমার দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাস ।
আমি পবিত্র মক্কা নগরীতে ওমরাহ করেছি অসংখ্যবার । আর আল্লাহর রহমতে হজ্ব করেছি ৭ থেকে ৮ বার । আমার বাবার কবর পবিত্র নগরী মক্কায় জান্নাতুল মাওয়াতে । সেখানে তার কবর উম্মুল মুমেনীন খাদিজার (রা:) পাশে, বেশ কয়েকজন সাহাবীর কবর আছে আলাদা ঘেরাও করা, তার ঠিক পাশে । এখানে অনেক নবী রাসুলদের কবরও আছে । আমি এই পর্যন্ত যতবার ওমরাহ করেছি, যাদেরকেই সাথে নিয়েছি তাদের প্রত্যেককেই সেই কবর দেখানোর চেষ্টা করেছি । ছোট ভাই আলী আকরাম মো: ওজায়ের তখন স্বাক্ষ্য বললেন, নয়া ভাই, আমাকেও আপনি নিয়ে গেছেন । (উল্লেখ্য আব্বার সব ভাই-বোনেরা তাকে নয়া ভাই বলেন । ফরিদপুরের আঞ্চলিক ভাষায় চতুর্থ ভাইকে নয়া ভাই বলা হয়) । আব্বা আবার বললেন, আমার তো ইচ্ছা হয়, আব্বার পাশে গিয়ে আমি থাকি, (একটু হেসে বলেন) তবে এখন সেটা বললে তো জেল প্রশাসন একটু বিপদে পড়েই যাবে । যাক এই ব্যাপারে আমি তো আমার বড় ছেলেকে দায়িত্ব দিয়েছি, সেই সবার সাথে আলাপ করে ঠিক করে নেবে । সেটাই ঠিক বলে মনে করি ।
এর মাঝেই মেঝ ছেলে তাহকীককে ডিউটিরত ডেপুটি জেলার বারবার সময় নিয়ে ইংগিত করছিল । আমার মেঝ ভাই তাই আব্বাকে জানায় যে, আর ৫ মিনিট সময় আছে । জেল প্রশাসন তাই বলছে । আব্বা তখন তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনারা আমাকে চিনেন । জানেন । দেখেছেনও । আজকে আমি আপনাদের কাছ থেকে আরেকটু মানবিক আচরন আশা করি । আমি আমার জরুরী কথা হয়ে গেলে ১ মিনিটও বেশী নিবোনা ।
তখন উপস্থিত সুবেদার জানান, স্যার আমরা স্বাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আমাদের সহযোগিতা করেছেন সব সময়, আমরাও আপনার সম্মান রাখার চেষ্টা করেছি ।
এর পর আব্বা আবার শুরু করলেন, এখানে আমার সন্তানেরা আছো । এখন আমি আমার পরিবারের জন্য কিছু কথা বলবো ।
তোমরা নামাজের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস থাকবা ।
তোমরা সব সময় হালাল রুজির উপর থাকবা । কষ্ট হলেও হালাল রুজির উপর থাকবা । আমি ৫ বছর মন্ত্রী ছিলাম, ফুল কেবিনেট মন্ত্রী ছিলাম । আল্লাহর রহমতে, আল্লাহর রহমতে, আল্লাহর রহমতে আমি সেখানে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে, পরিশ্রম করে আমার দায়িত¦ পালন করেছি । কেউ আমার ব্যপারে বলতে পারবেনা যে আমি অন্যায় করেছি । অনেক দুর্নীতির মধ্যে থেকেও আমার এই পেটে (নিজের শরীরের দিকে ইংগিত করে) এক টাকার হারামও যায়নি । তোমরাও হালাল পথে থাকবা । তাতে একটু কষ্ট হলেও আল্লাহ বরকত দিবেন ।
 আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে মিলে মিশে চলবে । আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই নামাজ পড়বে, অনেকেই কম । কেউ কেউ হালাল উপার্জনের ব্যপারে অত্যধিক কড়া হবে আবার কেউ কেউ একটু দুর্বল থাকবে । শরীয়তে দুই রকম । আজিমাত এবং রুকসাত । আজিমাত হলো খুবই কড়া, কোন অবস্থাতেই সে হারামের কাছে যাবেনা । আর রুকসাত হলো পরিবেশ ও পরিস্থিতির জন্য একটু ঢিল দেবে । তাই আত্মীয়দের মধ্যে কারও আয়ে সমস্যা থাকবে, কারও নামাজে দুবর্লতা থাকবে । তাই আমাদের দায়িত্ব হলো তাদেরকে সঠিক পথে আনার জন্য সবার সাথে সম্পর্ক ঠিক রেখে মিলে মিশে চলা । আমি সব সময় এভাবে চলেছি এবং তাতে ভাল ফল পেয়েছি । হাদীসে আছে, আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা ।
প্রতিবেশীর হক আদায় করবে । আমার ঢাকার বাসা, ফরিদপুরের বাড়ীর প্রতিবেশীদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে ।  আমার উত্তরার বাসার ব্যাপারে তো আমি আগেই লিখে দিয়েছি । মৌলিক কোন চেঞ্জ দরকার নেই । শুধু প্রয়োজন অনুযায়ী মূল ভিত্তি ঠিক রেখে তোমরা সুবিধা মতো এদিক ওদিক চেঞ্জ করে নিও । ফরিদপুরের বাড়ী নিয়েও যেভাবে বলে দিয়েছি, সেভাবেই তোমরা কাজ করবে । আমরা ভাই ভাইদের মধ্যে কোন সম্পত্তি নিয়ে কখনো ঝামেলা হয়নাই । তোমরাও মিলেমিশে থাকবে । এসব নিয়ে কোন সমস্যা করবানা । শান্তির জন্য কাউকে যদি এক হাত ছাড়তেও হয়, তাও কোন ঝামেলা করবেনা, মেনে নিবে ।
বেশী বেশী করে রাসুল (সা) এর জীবনী ও সাহাবীদের জীবনী পড়বে । আমি জানি তোমরা পড়েছো, কিন্তু তাও বার বার পড়বে । বিশেষ করে পয়গম্বর-এ-মোহাম্মাদী, মানবতার বন্ধু হযরত মোহাম্মাদ (সা:), সীরাতে সারওয়ারে আলম, সীরাতুন্নবী, সীরাতে ইবনে হিশাম, রাসুলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন । আর সাহাবীদের জীবনীর উপরও ভাল বই আছে । আগে পড়েছো জানি, তাও তোমরা পড়ে নিও ।

আমি আমার সন্তানদের উপর সন্তুষ্ট । তোমাদের ভুমিকার ব্যপারে সন্তুষ্ট । 
দেখো আমি এখানে পেপার পত্রিকা নিয়মিত পাইনা । তারপরও আমি যা চাই, যা ভাবি তোমরা তা করে ফেলো । যেমন আজকের সকালের প্রেস কনফারেন্স । এটা অনেক ভাল হয়েছে । আমাকে ছাড়াই তোমরা যে পরামর্শ করে এত সুন্দর একটা কাজ করে ফেলেছো, তাতে আমি অনেক খুশী হয়েছি । আসলে হৃদয়ের একটা টান আছে । আমি এখান থেকে যা ভাবি তোমরা কিভাবে যেন তাই করে ফেলো । তোমরা এভাবেই বুদ্ধি করে মিলে মিশে পরামর্শ করে কাজ করবে ।

আইনজীবীদেরকে আমার ধন্যবাদ ও দোয়া দেবে । তারা অনেক পরিশ্রম করেছেন । তাদের ভুমিকার ব্যপারে আমি সন্তুষ্ট । আইনজীবীরা যেভাবে পরিশ্রম করেছে, অবিশ্বাস্য । ওনারা যদি টাকা নিতো তাহলে ৫-১০ কোটি টাকার কম হতোনা । কিন্তু তারা অলমোস্ট বিনা পয়সায় তারা সাহসিকতার সাথে এই আইনী লড়াই চালিয়ে গেছেন ।
আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের মত এত বড় নেয়ামত দুনিয়াতে আর একটিও নেই । আমার জানা মতে এই সংগঠন দুটি পৃথিবীর মধ্যে সেরা সংগঠন । এই সংগঠনের ব্যপারে আমি সন্তুষ্ট । গত কয়েক বছরে অনেক নেতাকর্মী শহীদ হয়েছে, হাজার হাজার নেতাকর্মী আহত হয়েছেন, আমার মত জেলখানায় আছে কয়েক হাজার মানুষ । বিশেষ করে ইসলামী ছাত্রশিবির বিগত ৫ বছরে যে ভুমিকা রেখেছে, যে স্যাক্রিফাইস করেছে তা অতুলনীয় । আমার শাহাদাত এই দেশে ইসলামী আন্দোলনকে সহস্ত্রগুন বেগবান করবে এবং এর মাধ্যমে জাতীয় জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে ইনশাআল্লাহ ।
তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে যারা স্বাক্ষী দিয়েছেন, তাদের মধ্যে দুইজন ছাড়া বাকি সবাই দরিদ্র । তারা মূলত অভাবের তাড়নায় এবং বিপদে পড়ে মিথ্যা স্বাক্ষ্য দিতে বাধ্য হয়েছেন । আমি তাদের সবাইকে মাফ করে দিলাম, তোমরাও কোন ক্ষোভ রাখবানা ।
তোমাদের আম্মাকে দেখে শুনে রাখবে । সে আমার চেয়ে ভাল মুসলমান, ভাল মনের মানুষ । এই ব্যাপারে আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি । তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে তার সম্মানীত শ্বশুড়-শাশুড়ীকে স্মরন করেন । শাশুড়ী সেখানে উপস্থিত ছিলেন । তিনি বলেণ শ্বাশুড়ী তো মায়ের মতই । আপনি আমাকে যেভাবে স্নেহ করেছেন, তার কোন তুলনা হয়না । তারপর তিনি বললেন, আমার জানা মতে শহীদের মৃত্যুতে কষ্টের হয়না । তোমরা দোয়া করবে যাতে আমার মৃত্যু আসানের সাথে হয় । আমাকে যেন আল্লাহর রহমতের ফেরেশতারা পাহাড়া দিয়ে নিয়ে যান ।
এরপর তিনি উপস্থিত সবাইকে নিয়ে দোয়া করেন । মুনাজাতের মধ্যে তিনি জালিমের ধ্বংস চেয়েছেন । পরিবারের জন্য আল্লাহকে অভিভাবক বানিয়েছেন । তিনি বলেছেন, আল্লাহ যেন তার রহমতের চাদর দিয়ে যেন তার পরিবারকে ঢেকে রাখেন । ছোট মেয়ে আদরের তামরীনাকে তিনি মা বলে সম্বোধন করেন ।  তাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ওখানে আমার মা, বাবা, ছোট ভাই শোয়ায়েব এবং বড় মেয়ে মুমতাহিনা আছে । শোয়ায়েব অত্যন্ত ভাল মনের মানুষ ছিল এবং আব্বার খুব কাছাকাছি ছিল ।
আমার বোন তখন বলে, আব্বা একটু পরেই মুমতাহিনা (বড় মেয়ে, যে আড়াই বছর বয়সে অসুস্থতায় মারা যায়) আপনাকে রিসিভ করতে আসবে । মেঝ ভাই বললেন ফুল হাতে আসবে ইনশাল্লাহ । আর তখন আম্মা বললেন, তুমি আমার পক্ষ থেকে ওকে আদর করে দিও । আমার বড় ভাই তাজদীদ তখন বললেন, আপনি তো শহীদ হতে যাচ্ছেন । জান্নাতে শহীদের প্রবেশের সময় অনেকের জন্য আপনার সুপারিশ করার সুযোগ থাকবে । আপনি সেই তালিকায় আমাদের রাখবেন ।
তারপর পুত্রবধুদের উদ্দেশ্য করে আব্বা বললেন, আমার বউমাদের আমি সেভাবে আদর করতে পারিনি । বউমা’রাতো মাই । আমাদের বাংলা ভাষায় তো সেভাবেই বলে, বউ-মা । এই সময়, তিনি সকল পুত্রবধুর বাবা-মা’র খোজ খবর নেন এবং তাদের প্রত্যেককে তার পক্ষ থেকে সালাম জানান । পুত্রবধুদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমি তোমাদের প্রতি সেভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারিনি । বিশেষ করে ছোট বউমা জেরিনকে আমি খুব একটা সময় দিতে পারিনি । কেননা ওর বিয়ের কয়েকদিন পরেই তো আমি এখানে চলে আসি । এই সময় তিনি সকল পুত্রবধুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমি তোমাদের প্রতি ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারিনি । তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও ।
ঠিক একইভাবে আমার মেয়ে জামাই ফুয়াদ আর মেয়েকেও আমি সেভাবে সময় দিতে পারিনি । ওদেরকে নিয়ে একবেলাও একত্রে খাবার খাওয়ারও সুযোগ হয়নি । এই সময় তিনি মেয়ে জামাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন, বাবা তোমার ভুমিকায় ও দায়িত্বপালনে আমি সন্তুষ্ট । তোমার মা বাবাকে আমার সালাম পৌছে দেবে । প্রতিউত্তরে মেয়ে জামাই বলেন, আব্বু আপনি আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা আমি যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করবো ।
জেল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন । তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের সাথে আমার কোন ভুল আচরন হলে আপনারা আমায় মাফ করে দেবেন । নারায়নগঞ্জ ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার সেবকদের তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরন করেন এবং তার নিজের পিসির টাকাগুলো সেবকদের প্রয়োজন মাফিক বন্টন করে দেন এবং সেই ব্যাপারে জেল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেন ।
নিজামী ভাই ও সাইদী ভাইসহ আরও যারা আছেন সবাইকে তিনি সালাম পৌছে দিতে বলেন ।
দেশবাসীকে তিনি সালাম দেন এবং সকলের কাছে দোয়া চান । সর্বশেষে তিনি তার শাহাদাত কবুলিয়াতের জন্য দোয়া করেন । এরপর তিনি সকলের সাথে একে একে হাত মিলিয়ে বিদায় জানান ।
তারপর আমরা তার রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম । সেই যে আসার পথে ঘুরে তাকে দেখে আসলাম, সেটাই আমার বাবার শেষ জীবন্তকালীন ছবি । যা কোনদিন ভুলতে পারবোনা । ভুলে যাবোনা ইনশাআল্লাহ । ভুলে যাওয়া সম্ভবও নয় । এই অসম্ভব স্বচ্ছ মনের মানুষটির জন্য আপনারা দোয়া করবেন । প্রানভরে দোয়া করবেন ।


(লেখাটি দৈনিক সংগ্রামে অাজ ২৬ নভেম্বর, ২০১৫ তারিখে উপ-সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত হয়েছে ।

শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৫

আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে

إِنَّا للهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعونَ
“নিঃসন্দেহ আমরা আল্লাহ্‌র জন্যে, আর অবশ্যই আমরা তাঁরই কাছে প্রত্যাবর্তনকারী ।

আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে । 

প্রিয় ভাইয়েরা, আমার স্যারের শাহাদাতে চোখের পানি কেউ ফেলো না;
ওরা আমাদের গর্বের ধন, ওরা মাবুদের প্রিয়জন । শাহাদাত ঈমানের চরম চাওয়া, 
শাহাদাত মুমিনের পরম পাওয়া ।
আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা তাঁর রক্তকে ইসলামের জন্য কবুল করুন । মহান আল্লাহ তাকে শাহদাতের মর্যাদায় জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করুন । আমিন ইয়া রব ।