শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাই না

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণপ্রিয় নাতি,
৬১ হিজরির ১০ মহররম হযরত ইমাম হোসেন রাদিয়াল্লাহু আনহু রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ইসলামের পতাকা উড্ডীন রাখতে বুকের তাজা রক্তে কারবালার প্রান্তরকে রঙিন করে শাহাদাতের পেয়ালা গ্রহণ করেন । শহিদ হওয়াকে কেন্দ্র করে বর্তমানে আশুরার গুরুত্ব পেলেও ইসলামের ইতিহাসে এইদিনে অসংখ্য তাৎপর্যময় ঘটনা রয়েছে । অনেক কারণে মুসলমানরা দিনটিকে ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে স্মরণ করে থাকেন ।
মহররম আরবি বর্ষের প্রথম মাস । আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাস । এ মাসের রয়েছে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা । যা ইসলামের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে, এ মাসের ১০ তারিখে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী সৃষ্টি করেন এবং পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী হজরত আদম ও মা হাওয়া আলাহিমুস সালাম শয়তানের প্রতারণায় আল্লাহর হুকুম লংঘন করে তাঁর শাস্তির সম্মুখীন হন । অবশেষে দুনিয়ায় আগমন, দু’জনের মিলন, আল্লাহর ক্ষমা লাভসহ সবই এ মাসের সংঘটিত হয় ।
পৃথিবীতে আগত সব নবী-রাসূলগণেরই কম-বেশি স্মৃতিবিজড়িত এ মহররম মাস । মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আলাহিস সালামের জন্য নমরুদের আগুন শান্তিতে পরিণত হয় এ মাসেই । যখন তাওহিদের দাওয়াত দেয়ায় জালিম শাসক নমরুদ হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন । আল্লাহ তাঁর প্রিয় খলিলকে অগ্নিকুণ্ডলি থেকে রক্ষা করেন । হযরত নূহ আলাইহিস সালামের আমলের মহাপ্লাবন থেকে তাঁর উম্মতগণও ১০ মহররমে পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করেন । হযরত মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা ফেরাউনের অত্যাচার থেকে রক্ষা করে তার দম্ভ চূর্ণ করে দেন এ মহররমের ১০ তারিখে । যার শোচনীয় পরিণতি হচ্ছে দলবলসহ ফেরাউন নীল নদে ডুবে যায় । সেই নির্মম করুন ধংসের আজও এক নজির হয়ে আছে পৃথিবীতে ।

সর্বোপরি হযরত ইমাম হোসেন রাদিয়াল্লাহু আনহু যা সমগ্র মুসলিম হৃদয়ে আজও চির অম্লান । এ দিনে অনেক মানুষ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যা ইসলাম সম্মত নয় । মহররমের তাৎপর্য ও গুরুত্বকে উজ্জীবিত রাখতে যারা কারবালার শোকাবহ ঘ্টনার জন্য শোক প্রকাশ করতে চান তারা অপাত্রে রক্ত অপচয় না করে রোগিদের জন্য হাসপাতালে রক্ত দান করলে অনেক সাওয়াবের অধিকারী হবেন বলেও আলেম সমাজ মনে করেন ।
বিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলে আশুরা ও মহররমের শোক প্রকাশের নামে অনেকেই নানা পন্থায় শরীরকে রক্তাক্ত করেন । আর এ বিষয়টি মহররমের পবিত্রতা ও শোক-প্রকাশকারীদের সম্পর্কে নানা নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করছে অনেকের মধ্যেই । এ ধরনের তৎপরতার ফলে ইসলামের শত্রুরা এই মহান ধর্ম সম্পর্কে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানোর সুযোগ নিচ্ছে বলে শীর্ষস্থানীয় অনেক আলেম মনে করেন । আবার অনেকে বলেন, মহররমে শরীর রক্তাক্ত করে শোক পালন হারাম ।
হাদিসের প্রায় সব কিতাবে মহররম মাসের ফজিলত এবং এ মাসের ১০ তারিখ আশুরার রোজা সম্পর্কে সাইয়েদুল মুরসালীন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত একাধিক হাদিস রয়েছে । হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ রমজানের রোজার পর মহররম মাসের রোজা আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে বেশি ফজিলতময় । -সহিহ মুসলিম: ১৯৮২
মদিনায় হিজরতের পর যখন প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদিদের এ মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখতে দেখলেন, তখন তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন । ইহুদিরা জানালো, এ মাসের ১০ তারিখে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা হযরত মুসা আলাইহিস সালামকে অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন । এ তারিখে ফেরাউন নীল নদে ডুবে মারা যায় । এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এ দিনটিতে রোজা রাখতেন । মানবতার নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ আমরাও মুসা (আ.)-এর অনুসরণ করবো । তোমাদের চেয়ে আমাদের অধিকার বরং বেশি । তিনি তখন থেকে মহররমের ১০ তারিখ রোজা রাখা শুরু করলেন এবং সবাইকে নির্দেশ দিলেন । -সহিহ বোখারি: ১৮৬৫
এ মাসের প্রতিটি দিন ও রজনীকে ইবাদাত-বন্দেগি, নফল নামাজ, রোজা পালনের মাধ্যমে অতিবাহিত করা উচিত । আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ মাসে ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন থাকার তৌফিক দান করুন । আমিন

বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আরবী নববর্ষের শুভেচ্ছা

প্রথম কথা হল, ১লা মুহাররম হিজরী বর্ষের প্রথম দিন । কিন্তু এটা ‘ইসলামী পবিত্র দিনসমূহ’ বা ‘ইসলামী ফযীলতপূর্ণ দিবস-রজনী’ শিরোনামে আসবে কিনা সেটা ভাববার বিষয় । ইসলামী ফযীলতপূর্ণ দিবস হতে হলে কুরআন-সুন্নাহয় তার আলাদা ফযীলত উল্লেখ থাকতে হবে । এছাড়া এখানে হিজরী নববর্ষ শব্দ থেকে কেউ বুঝতে পারে যে, অন্যান্য জাতি যেমন নববর্ষ উদযাপন করে, হিজরী নববর্ষও মুসলমানদের জন্য সে রকম উদযাপনের দিবস । অথচ ইসলামে নববর্ষ, বর্ষপূর্তি কিংবা জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করার কোনো বিধান নেই । তবে চান্দ্রমাস ও বছরের সাথে যেহেতু রোযা, হজ্ব, ঈদুল ফিত্র, ঈদুল আযহা ও যাকাতসহ বহু ইবাদাত ও শরয়ী বিধিবিধান সম্পৃক্ত এ জন্য এর হেফাযত ও চর্চা রাখা ফরযে কেফায়া । এবং এ ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শন করা জাতীয় আত্মমর্যাদাবোধ হ্রাস বা বিলুপ্তিরই নামান্তর ।

মুহররম (আরবী: محرم ) ইসলামিক বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্রতম মাসের মধ্যে এটি একটি। মুহররম শব্দটি আরবী যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে মুহররম মাস পবিত্র হিসাবে গন্য। মহররমের ১০ তারিখ বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন দিন, যাকে আশুরা বলা হয়ে থাকে। মহররম মাসের পরবর্তি মাসের নাম সফর
besas kichu din== আশুরার দিনের ঘটনা == মুহররম মাসের দশম দিন ইসলামে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন একটি দিন, কারণ এই দিনে ইসলাম ধর্মমতে অনেক ঘটনার অবতারণা হয়েছে। বিভিন্ন ঘটনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
  • এই দিনে প্রথম মানব আদি পিতা হযরত আদম [আ.]-কে সৃষ্টি করেন ঈশ্বর (আল্লাহ)।
  • হযরত আদম [আ.]-কে এদিনেই স্বর্গ বা বেহেশতে স্থান দেয়া হয়, এবং পরবর্তীতে এই দিনেই পৃথিবীতে পাঠিয়ে আল্লাহ তাঁকে প্রতিনিধি মনোনীত করেছেন।
  • হযরত নূহ [আ.]-এর সময়কালে এই দিনে মহাপ্লাবন হয়।
  • হযরত ইব্রাহীম [আ.] জন্ম নেন এই দিনে, এবং হযরত মুসা আঃ ও তার বাহিনী ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার পানও এই দিনে
  • Hajrat Musha [আ.] সমসাময়িক ফেরাউনকে আল্লাহ এই দিনে নীল নদের পানিতে ডুবিয়ে মারেন।
  • হযরত ইউনুছ [আ.] মাছের পেট থেকে মুক্তি পান এই দিনে।
  • হযরত আইয়ূব [আ.] রোগ মুক্তি পান এই দিনে।
  • হযরত ঈসা [আ.] (খ্রিস্টধর্মমতে যিশু) এই দিনে জন্ম নেন এবং পরবর্তিতে তাঁকে সশরীরে ঊর্ধ্বাকাশে উঠিয়ে নেয়া হয় এই দিনে।


বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৭

ঈদ মুবারক


🌹السلام عليكم ورحمة الله وبر كاته
🌻পবিত্র ঈদুল আযহার শিক্ষা নিয়ে ত্যাগ ও কল্যাণের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক সবার জীবন ।
 ঈদ সবার জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ ও সমৃদ্ধি ।
💞 সুস্থ থাকুন-নিরাপদে থাকুন. সত্যের সাথে থাকুন. সকলের জন্য রইলো শুভকামনা 
💚💛💜মু💙বা💜

শনিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৭

একনজরে জামায়াতে ইসলামী

একনজরে জামায়াতে ইসলামী


এই উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামী একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। এটি অনেকের কাছে যেমন ভালবাসার আবার অনেকের কাছে সমালোচনারও। জামায়াতে ইসলামী শুধুই একটি রাজনৈতিক দল নয়। এটি কেবল সামাজিক প্রতিষ্ঠানও নয়। এটি একটি পূর্ণাংগ ইসলামী আন্দোলন। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আল্লাহর বিধানের আলোকে গড়ে তোলার জন্য চার দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে কাজ করছে জামায়াতে ইসলামী।


জামায়াতে ইসলামী গঠন

১৯৪১ সনের ২৬ আগস্ট বৃটিশ শাসিত দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের লাহোর সিটিতে গঠিত হয় জামায়াতে ইসলামী। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ৭৫ জন। সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী আমীরে জামায়াত নির্বাচিত হন।
প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণের একাংশে সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীতে যাঁরা যোগদান করবেন তাঁদেরকে এই কথা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে যে, জামায়াতে ইসলামীর সামনে যেই কাজ রয়েছে তা কোন সাধারণ কাজ নয়। দুনিয়ার গোটা ব্যবস্থা তাঁদেরকে পাল্টে দিতে হবে। দুনিয়ার নীতিনৈতিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি সবকিছু পরিবর্তন করে দিতে হবে। দুনিয়ায় আল্লাহদ্রোহিতার ওপর যেই ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে তা পরিবর্তন করে আল্লাহর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’

জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ও জামায়াতে ইসলামী হিন্দ

১৯৪৭ সনের ১৪ ও ১৫ই আগস্টের মধ্যবর্তী রাতে দিল্লীতে বসে উপমহাদেশের সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তখন গোটা উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য সংখ্যা ছিলো ৬২৫ জন। দেশ ভাগ হলে জামায়াতে ইসলামীও ভাগ হয়। মোট ২৪০ জন সদস্য নিয়ে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ এবং ৩৮৫ জন সদস্য নিয়ে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান কাজ শুরু করে।

ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সূচনা

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ এই কথা বলে প্রচার চালিয়েছেন একটি স্বাধীন দেশ হাতে পেলে তাঁরা দেশটিকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করবেন। এতে সাধারণ মুসলিম তাদের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পাবার পর তারা সেইসব কথা ভুলে যেতে থাকেন। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে তারা আলোচনা শুরু করেন পাকিস্তানের জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টারি সিস্টেম উপযোগী, না আমেরিকান প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেম, তা নিয়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয় ইসলামপন্থী মানুষরা। 

১৯৪৮ সনের এপ্রিল মাসে করাচির জাহাংগীর পার্কে জামায়াতে ইসলামীর প্রথম রাজনৈতিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান বক্তা ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যে তিনি পাকিস্তানের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের প্রতি চারটি দফার ভিত্তিতে ‘আদর্শ প্রস্তাব’ গ্রহণ করার উদাত্ত আহ্বান জানান।
দফাগুলো হচ্ছে
১। সার্বভৌমত্ব আল্লাহর। সরকার আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করবে।
২। ইসলামী শরীয়াহ হবে দেশের মৌলিক আইন।
৩। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক আইনগুলো ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত করে ইসলামের সাথে সংগতিশীল করা হবে।
৪। ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই শরীয়াহর সীমা লংঘন করবে না।
এইভাবে জামায়াতে ইসলামী ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু করে। আরো জানতে ক্লিক করুন। 

কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণার আন্দোলন

১৯৫৩ সনের জানুয়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মাজলিসে আহরার, জমিয়তে আহলে হাদীস, মুসলিম লীগ, আনজুমানে তাহাফ্ফুযে হুকুকে শিয়া প্রভৃতি দল করাচিতে একটি সম্মেলনে মিলিত হয়। জামায়াতে ইসলামী প্রস্তাব করে যে কাদিয়ানী ইস্যুটিকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করে নেওয়া হোক। সেই সম্মেলনে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হলো না।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসে করাচিতে সর্বদলীয় নির্বাহী পরিষদের মিটিং ডাকা হয়। এই মিটিংয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশনের’ পক্ষে প্রবল মত প্রকাশ পায়। জামায়াতে ইসলামী গোড়া থেকেই শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলো বিধায় ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশনের’ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সর্বদলীয় নির্বাহী পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসে।

১৯৫৩ সনের মার্চ মাসে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে কতিপয় দলের ডাইরেক্ট এ্যাকশনের ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এই অবনতি পাঞ্জাবেই ঘটেছিলো বেশি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মার্শাল ল’ ঘোষণা করা হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে যায়।

মাওলানা মওদুদীর গ্রেফতার ও ফাঁসির আদেশ

যদিও ডাইরেক্ট এ্যাকশনের বিপক্ষে ছিল জামায়াত তারপরও ১৯৫৩ সনের ২৮শে মার্চ মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষ সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী ও আরো কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার, সামরিক ট্রাইব্যুনাল ১৯৫৩ সনের ৮ই মে সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদুদীকে ফাঁসির হুকুম দেয়। জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তি এবং সকল শ্রেণীর ইসলামী ব্যক্তিত্ব এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক ও বলিষ্ঠ আন্দোলনে নেমে পড়ে। ফলে সরকার মৃত্যুদণ্ড রহিত করে সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদীর চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের কথা ঘোষণা করে।

তবে দুই বছর একমাস জেলে থাকার পর ১৯৫৫ সনের ২৯শে এপ্রিল সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদুদী মুক্তি লাভ করেন। তাঁকে মেরে ফেলার চক্রান্তের আসল লক্ষ্য ছিলো ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের বলিষ্ঠতম কণ্ঠটিকে স্তব্ধ করে দেওয়া। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছা ছিলো ভিন্ন। তিনি মুক্তি পান। আর ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গণদাবির মুখে গণপরিষদ ১৯৫৬ সনের ২৯শে ফেব্রুয়ারি একটি শাসনতন্ত্র পাস করে।


শাসনতন্ত্র বাতিল ও পুনরায় আন্দোলন

১৯৫৮ সনের ২০শে সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খান সরকারের প্রতি আস্থা ভোটের জন্য পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসে। অধিবেশনে স্পিকার আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়। স্পিকারের দায়িত্ব লাভ করেন ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটোয়ারী। পরিষদে হট্টগোল চলতে থাকে। উত্তেজিত সদস্যদের আঘাতে শাহেদ আলী পাটোয়ারী মারাত্মক আহত হন। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি হাসপাতালে মারা যান।

১৯৫৮ সনের ৭ই অকটোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কানদার আলী মির্যা দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। জাতীয় পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদসমূহ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাগুলো ভেঙ্গে দেন। নয় বছরের চেষ্টাসাধনার ফসল শাসনতন্ত্রটি বাতিল করে দেন।

প্রধান সামরিক প্রশাসক নিযুক্ত হন সেনাপ্রধান জেনারেল মুহাম্মাদ আইউব খান। ২৭ অক্টোবর আইউব খান প্রেসিডেন্ট পদটিও দখল করেন। চলতে থাকে এক ব্যক্তির স্বৈরশাসন। ১৯৬২ সনের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট আইউব খান দেশের জন্য একটি নতুন শাসনতন্ত্র জারি করেন। এটি না ছিলো ইসলামিক, না ছিলো গণতান্ত্রিক। এতে বিধান রাখা হয়, দেশের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’দের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। আর ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ হবেন পূর্ব পাকিস্তানের ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান ও মেম্বার মিলে ৪০ হাজার জন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান ও মেম্বার মিলে ৪০ হাজার জন। অর্থাৎ ৮০ হাজার ব্যক্তি ছাড়া দেশের কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।এই আজগুবী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম আওয়াজ তোলে জামায়াতে ইসলামী।

১৯৬২ সনে রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকতবাগ ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী এই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন এবং জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। এতে প্রেসিডেন্ট আইউব খান ক্ষেপে যান। তাঁরই নির্দেশে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ১৯৬৪ সনের ৬ই জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনী ঘোষণা করে। আমীরে জামায়াত সহ মোট ৬০ জন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।

বন্দিদের মধ্যে ছিলেন- আমীরে জামায়াত সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী, মিয়া তুফাইল মুহাম্মাদ, নাঈম সিদ্দিকী, নাসরুল্লাহ খান আযিয, চৌধুরী গোলাম মুহাম্মাদ, মাওলানা ওয়ালীউল্লাহ, মাওলানা আবদূর রহীম, অধ্যাপক গোলাম আযম, জনাব আবদুল খালেক, ইঞ্জিনিয়ার খুররম জাহ মুরাদ, অধ্যাপক হেলালুদ্দীন, মাস্টার শফিকুল্লাহ, মাওলানা এ.কিউ.এম. ছিফাতুল্লাহ, অধ্যাপক ওসমান রময্, মাস্টার আবদুল ওয়াহিদ (যশোর), আবদুর রহমান ফকির, জনাব শামসুল হক, মাওলানা মীম ফজলুর রহমান প্রমুখ।

জনাব আব্বাস আলী খান, জনাব শামসুর রহমান ও মাওলানা এ.কে.এম. ইউসুফ জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন বিধায় গ্রেফতার হননি। এবারও জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তি উচ্চমানের ধৈর্যের উদাহরণ পেশ করেন।

জামায়াতে ইসলামী সরকারের অন্যায় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। স্বনামধন্য আইনজীবী মি. এ.কে. ব্রোহীর নেতৃত্বে একটি টিম মামলা পরিচালনা করে। পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর বিপক্ষে এবং পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে রায় দেয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে যায়। সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে রায় দেয়। ১৯৬৪ সনের ৯ই অকটোবর জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।

‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’

১৯৬৪ সনের ২০শে জুলাই ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আইউব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। এই জোটের নাম দেওয়া হয় ‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’। এতে শরীক ছিল কাউন্সিল মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও নেযামে ইসলাম পার্টি।
১৯৬৪ সনের সেপ্টেম্বর মাসে ‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’ ১৯৬৫ সনের ২রা জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইউব খানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মি. মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর বোন মিস ফাতিমা জিন্নাহকে নমিনেশন দেয়।

এই সময় জামায়াতে ইসলামী ছিলো বেআইনী ঘোষিত। নেতৃবৃন্দ ছিলেন জেলখানায়। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মাজলিসে শূরার যেইসব সদস্য জেলের বাইরে ছিলেন, তাঁরা ১৯৬৪ সনের ২ অক্টোবর একটি মিটিংয়ে একত্রিত হন।
‘আলোচনান্তে মাজলিসে শূরা অভিমত ব্যক্ত করে যে স্বাভাবিক অবস্থায় একজন মহিলাকে রাষ্ট্রপ্রধান করা সমীচীন নয়। কিন্তু এখন দেশে চলছে এক অস্বাভাবিক অবস্থা। স্বৈরশাসক আইউব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে মিস ফাতিমা জিন্নাহর কোন বিকল্প নেই। এমতাবস্থায় সার্বিক অবস্থার নিরিখে জামায়াতে ইসলামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিস ফাতিমা জিন্নাহকেই সমর্থন করবে।’


স্বৈরাচারী আইয়ুবের কবলে জামায়াতে ইসলামী

আইয়ুবের শাসনামলে জামায়াতের আমীর মাওলানা মওদুদীকে কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। ১৯৬৪ সালে জাময়াতে ইসলামীকে হঠাৎ বেআইনী ঘোষণা করা হলো। জামায়াতে ইসলামী ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের দাবিতে সমগ্র দেশব্যাপী স্বাক্ষর অভিযান পরিচালনা করে। এ অভিযানের ফলে মৌলিক অধিকারের দাবি তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আইনের খসড়া বিল পরিষদে গৃহীত হওয়া সত্ত্বে ও প্রেসিডেন্ট ইচ্ছাপূর্বক তাতে স্বাক্ষর দিতে বিলম্ব করেন। 

১৯৬৪সালের ৬ই জানুয়ারী জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং নেতাদের গ্রেফতার করে তারপর ১০ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট উক্ত বিলে স্বাক্ষর করে। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে তার এ পদক্ষেপও জামায়াতকে খতম করতে সক্ষম হয়নি। হাইকোর্ট জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারী এবং সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতের নিষিদ্ধকরণের নিদের্শকে বাতিল ঘোষণা করে। এর আগে ১৯৫৮ সালেও সামরিক আইনে জামায়াত ৪৫ মাস নিষিদ্ধ ছিলো। 

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ 

১৯৬৫ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ভারত পাকিস্তানের উপর স্থল ও আকাশ পথে হামলা চালায়। দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়। এমন সময় মাওলানার প্রতি চিরদিন বিরূপ-মনোভাবাপন্ন আইয়ুব খান তার কাছে যুদ্ধে সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করেন। মাওলানা জিহাদের উপর ক্রমাগত ছ'দিন রেডিও পাকিস্তান থেকে উদ্দীপনাময় ভাষণ দান করেন-জামায়াত কমীগণকে দেশ রক্ষার খেদমতে মাঠে নামিয়ে দেন। জামায়াতে ইসলামীর এ সময়ের নিঃস্বার্থ জাতীয় খেদমত সেনাবাহিনী ও জনগণের মন জয় করে। যুদ্ধে পাকিস্তান জয়ী হয়।

সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫১ আসনে প্রার্থী দেয় জামায়াত। এর মধ্যে ৪ টি আসন জিতে নেয়। সবচেয়ে বেশি আসনে প্রার্থী দেয় আওয়ামীলীগ এবং তারা সবচেয়ে বেশি আসনে জয়লাভও করে । তৃতীয় সর্বোচ্চ আসনে (১২০) প্রার্থী দেয় ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামীলীগের সবগুলো আসনই ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। 

১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা 

১৯৭১ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে যা হয়েছে তা মূলত সমাজতন্ত্রী ও ভারতীয় ষড়যন্ত্রের মিলিত ফসল। তারা পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের সুযোগ গ্রহণ করেছিল। জামায়াত সেসময় একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে অবস্থান নিয়েছে, কোন সশস্ত্র গ্রুপ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেনি। জামায়াত যুদ্ধ বন্ধে কয়েকবার চেষ্টা করেছিল, শান্তি আনার চেষ্টা করেছিল, সরকার এবং স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে সমজোতার চেষ্টা করেছিল কিন্তু দু-পক্ষের বাড়াবাড়িতে সেটা সম্ভব হয়নি। হত্যা খুন ধর্ষন উভয় পক্ষ করেছে। জামায়াত উভয়পক্ষের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেছে আর বিচ্ছন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলেছে যারা ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ

একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য হয়েছিল, তার শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি মেনে না নিতে পারলেও দেশের স্বাধীন সত্তাকে জামায়াত কর্মীগণ তখনই মেনে নিয়েছে। শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি ও শাসন পদ্ধতি সদা পরিবর্তনশীল। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এদেশে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার সংগ্রাম করছে এবং করতে থাকবে। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের জন্যেও জামায়াত দৃঢ়সংকল্প।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের যে সংবিধান রচিত হয় তার অধীনে মুসলমানী জীবন-যাপন সম্ভব ছিল না। এ সম্পর্কে বিভিন্ন বিদেশী সংবাদ সংস্থাও মন্তব্য করে। ইসলামের নামে দল গঠন ও ইসলামী আন্দােলন ও তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। গণতন্ত্রকে হত্যা করে এক দলীয় শাসন কায়েম হয়। ইসলামের জাতীয় শ্লোগান “আল্লাহু আকবর’ এর স্থানে ‘জয়বাংলা”। জাতীয় শ্লোগান হয়ে পড়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াত তার কার্যক্রম গোপনে পরিচালনা শুরু করে। ভারপ্রাপ্ত আমির ছিলেন আব্বাস আলী খান। 


আবারো প্রকাশ্যে রাজনীতি 

৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর জামায়াত আবারো প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এর মধ্যে দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকা অধ্যাপক গোলাম আযম দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৯ সালে এক সাধারণ সভায় জামায়াত পুনরায় প্রকাশ্যে কাজ করার ঘোষণা দেয়। ১৯৮০ সালে প্রথমবারের মত বায়তুল মোকারমের সামনে জামায়াতের সভা হয়। প্রকাশ্যে এটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সম্মেলন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। স্বৈরাচারী এরশাদের অধীনে কোন বিরোধীদল নির্বাচনে যেতে আস্থাবান না হওয়ায় জামায়াত ১৯৮৪ সালে এক অসাধারণ নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রস্তাব দেয়। কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা। ১৯৮৪ সাল থেকেই কেয়ারটেকার সরকারের দাবীতে আন্দোলন করে আসছে জামায়াত। ১৯৮৯ সালে সকল বিরোধীদল কেয়ারটেকার পদ্ধতিকে স্বাগত জানিয়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। 

১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। জামায়াত রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানে আসীন হয়। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে রেকর্ড ১৮টি আসনে জিতে নেয় জামায়াত। জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠন করে। অধ্যাপক গোলাম আজম আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াতের আমির ঘোষিত হন।

১৯৯২ সালে জামায়াতের বিরুদ্ধে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। তারা জামায়াতকে অবৈধ ঘোষণার জন্য এবং গোলাম আযমকে অবৈধ নাগরিক হিসেবে শাস্তি দাবী করে সারাদেশে প্রচারণা চালায়। কয়েক স্থানে জামায়াতের সাথে ঘাদানিকের সংঘর্ষ হয়। ঘাদানিকের চাপে গোলাম আযম গ্রেফতার হন। ১৯৯৪ সালে উচ্চ আদালতের রায়ে অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব পুনঃস্থাপিত হয়। সে বছরই কার্যত ঘাদানিকের পতন হয়। 

১৯৯৬ সালে জামায়াত পুনরায় কেয়ারটেকার সরকারের দাবীতে আন্দোলন করে বিএনপির বিরুদ্ধে। বিএনপি একদলীয় নির্বাচন করে। তীব্র প্রতিবাদের মুখে আবারো নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। 

ক্ষমতার অংশীদার 

১৯৯৯ সালে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। ২০০১ সালে নির্বাচনে চারদলীয় জোট বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে। স্বাধীন বাংলাদেশে এই বছরই প্রথম ক্ষমতার স্বাদ পায় জামায়াত। তিনটি মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পায় জামায়াত। ২০০৫ সালে জঙ্গী বিরোধী ভূমিকায় জামায়াত ব্যাপক সফলতা পায়।    

পুনরায় ক্ষমতাছাড়া এবং নির্যাতন শুরু 

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতা ছাড়ার দিন আওয়ামীলীগ ব্যাপক আক্রমণ করে জামায়াতের উপর। এতে প্রায় ১০ জনের মত জামায়াত কর্মী নিহত হয়।  ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি সেনাবাহিনী অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে কেয়ারটেকার সরকারকে পুতুল বানিয়ে রাখে। দুই বছর সেনাশাসনে রাজনীতিবিদরা চরম অপদস্থ হয় দূর্নীতির দায়ে। জামায়াত এসময় সারাদেশে একটি নির্লোভ ও সৎ দল হিসেবে স্বীকৃত হয়। 

২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সেনা কর্মকর্তাদের দায়মুক্তির অঙ্গিকার করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ২০১০ সালে জামায়াতের সকল শীর্ষনেতা গ্রেফতার হন। শুরু হয় তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের বিচার। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে থাকে জামায়াত। ২০১৩ সালে রায় আসতে শুরু হয়। অবৈধ রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জামায়াত কর্মীরা। সারাদেশে হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। নিহত হন শতাধিক কর্মী।

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের বিরুদ্ধে গণজাগরণ মঞ্চ গঠিত হয়। এর বিরুদ্ধে হেফাযতে ইসলাম তৈরী হয়। হেফাযতের গনজোয়ারে অল্প কয়েকমাসের মধ্যেই গণজাগরণ মঞ্চ ভেসে যায়।

১২ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা শাহদাতবরণ করেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একদলীয় নির্বাচন করে আওয়ামীলীগ। নজিরবিহীনভাবে ১৫৪ জন বিনা ভোটেই নির্বাচিত হয়। স্বৈরাচারী এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়া সকল দল নির্বাচন বয়কট করে।

২৩ অক্টোবর ২০১৪ সালে জামায়াতের প্রবীণ নেতা, বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা অধ্যাপক গোলাম আযম কারান্তরীন অবস্থায় শাহদাতবরণ করেন।  ১১ এপ্রিল ২০১৫ সালে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান শাহদাতবরণ করেন। ২২ নভেম্বর ২০১৫ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল এবং সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ শাহদাতবরণ করেন।        

১১ মে ২০১৬ সালে জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার। সারা মুসলিম জাহানে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। তুরস্ক তাদের দূতকে প্রত্যাহার করে নেয়। ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে শাহদাতবরণ করেন জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী। 

মূলত ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতি নির্যাতনের স্টিমরোলার চলছে। এই কয় বছরে জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মীকে শাহদাতবরণ এবং লক্ষাধিক নেতাকর্মীকে কারাবরণ করতে হয়। বর্তমানে জামায়াতের আমীর মকবুল আহমাদ এবং সেক্রেটারি জেনারেল ডাঃ শফিকুর রহমান। 

সহায়ক সূত্র
১। জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস/ আব্বাস আলী খান
২। প্রবন্ধ/ রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী/ এ কে এম নাজির আহমাদ/ ছাত্রসংবাদ/ জুলাই-আগস্ট ২০১৩
৩। জামায়াতে ইসলামীর ঊনত্রিশ বছর/ সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদুদী
৪। জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ইতিহাস এবং কর্মসূচী/ সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদুদী  

সৌজন্যেঃ  http://www.ahmedafgani.com/2017/08/jamaat_26.html

সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৭

ইসলামী শিক্ষা দিবস

ইসলামী শিক্ষা দিবস
.
প্রেরণার বাতিঘর শহীদ আবদুল মালেক.
শহীদ আব্দুল মালেক জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৭ সালে বগুড়া জেলার ধূনট থানার অন্তর্গত খোকসাবাড়ীর নামক গ্রামে। ধর্মপ্রাণ মৌলভী মুহম্মদ আলীর কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন আব্দুল মালেক। সর্বকনিষ্ঠ সন্তান হওয়ার কারণে স্বভাবতই তিনি পিতামাতার একান্ত স্নেহ ও আদরে বড় হতে থাকেন। শহীদ আব্দুল মালেকের জন্মের পূর্বে পর পর দু’টি ভাইয়ের মৃত্যু এ পরিবারটিকে শোকের সাগরে ভাসিয়েছিল। তাই ছোট বেলা থেকেই পরিবারের সবার কাছে তিনি ছিলেন “সাত রাজার ধন।”

.
পাঁচ বছর বয়সে আব্দুল মালেককে তাঁর পিতা খোকসাবাড়ী প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করেন দেন। সাধারণ ছেলেদের চাইতে এ শিশুটি ছিল একটু ব্যতিক্রম। শিক্ষকদের কাছে গিয়ে প্রত্যহই নতুন কিছু না জেনে মালেক বাড়ি ফিরতো না কোনোদিন। তাই সব শিক্ষকই তাকে দেখতেন অত্যন্ত স্নেহের চোখে। খোকসাবাড়ী প্রাইমারি স্কুল হতে কৃতিত্বের সাথে তৃতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলে বাবা- মা তাকে ভর্তি করে দেন গোসাইবাড়ী হাই স্কুলে। জোড়াখালী নিবাসী মহিউদ্দিনের বাড়িতে লজিং থাকতেন তিনি। মহিউদ্দিন সাহেব লক্ষ্য করলেন ইসলাম সম্পর্কে মালেকের অসীম আগ্রহ। ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে তিনি তাকে পরিচিত করালেন ইসলামের বৈপ্লবিক রূপের সাথে। বুঝালেন দুঃখ দারিদ্র্যতা, ভয়Ñভীতি, ক্ষুধা ও দুর্দশা থেকে মানব জাতিকে একমাত্র ইসলামই রক্ষা করতে পারে । শহীদ আ. মালেকের কোমল হ্রদয়ে তাই মহিদ্দীনের প্রভাব পড়েছিল অপরিসীম।
.
ইতোমধ্যে ১৯৬০ সালে তিনি জুনিয়র স্কলারশিপ পান এবং অষ্টম শ্রেণী পাস করার পর বগুড়া শহরে এসে পড়াশুনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এইভাবে ১৯৬১ সালে তিনি বগুড়া জিলা স্কুলে নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এখানেও তাঁর আর্থিক অসচ্ছলতার জন্যে জায়গীয়র থাকতে হয়। কিন্তু কিছুদিন পরই স্কুলের ছাত্রাবাসে চলে আসেন। ১৪ বছরের এক কিশোর। সবুজ শ্যামল গাঁয়ের মায়া কাটিয়ে, আম্মা, আব্বা ও ভাই -বোনের আদরের জাল ছিন্ন করে। সে শহরের বুকে দিন কাটায় । কি দুরন্ত আশা তার বুকে! ভাবতেই অবাক লাগে! বগুড়ায় স্কুলে ভর্তি হতে এসে চিঠি লিখছেন, “বাড়ির কথা ভাবিনা, আমার শুধু এক উদ্দেশ্য, খোদা যেন আমার উদ্দেশ্য সফল করেন। কঠিন প্রতিজ্ঞা নিযে এসেছি এবং কঠোর সংগ্রামে অবর্তীণ, দোয়া করবেন খোদা যেন সহায় হন। আমি ধন-সম্পদ কিছুই চাই না, শুধু মাত্র যেন প্রকৃত মানুষরূপে জগতের বুকে বেঁচে থাকতে পারি।” ছোট্র পোস্টকার্ডে এক কিশোরের লেখা কয়েকটি কথা। কি বলিষ্ঠতা তার বিশ্বাসে! সংগ্রামী এই কিশোর তাই সাধনার পথে একে একে সফল পদক্ষেপে এগিয়ে চললেন। বগুড়া জিলা স্কুলেও তিনি তাঁর কৃতিত্বেও পরিচয় দেন এবং ১৯৬৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংক ও রসায়নে লেটারসহ রাজশাহী বোর্ডে একাদশ স্থান অধিকার করেন। কিন্তু এ সময়েই তার জীবনে নেমে আসে এক কঠিন দুর্যোগ। পিতৃস্নেহ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হলেন তিনি। এরপর থেকে বিধবা মায়ের ছায়াই হয় তার একমাত্র সম্বল।
.
এসএসসি পরীক্ষায় একাদশ স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তাঁর অমায়িক ও সহৃদয় ব্যবহার এবং মিশুক মনোবৃত্তি সহপাঠীদের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। কলেজের সকল বির্তক সভা, রচনা ও বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন তিনি। লজিং মাস্টার মহিউদ্দিন সাহেবের উৎসাহে তিনি এ সময় ইসলামী ছাত্র সংঘের কাজ পুরোদমে শুরু করেন। রাজশাহীতে ইসলামী ছাত্র সংঘের আন্দোলন জোরদার হওয়ার পিছনে তাঁর অবদান অনন্য। তিনি এখানে ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান প্রসারের জন্যে অনেক চেষ্টা সাধনা করে একটি পাঠাগার স্থাপন করেন। রাজশাহীতে ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের ভিত্তিরুপে কাজ করে এ পাঠাগারটি। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর মেধা ও সময়ে আরো উৎকর্ষতা লাভ করে। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও ম্যাথমেটিক্স এ লেটারসহ রাজশাহী বোর্ড থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে চতুর্থ স্থান অধিকার করার পর তিনি ৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রাসায়ন বিভাগে ভর্তি হন।
.
ঢাকায় আসার পর তাঁর ওপর ছাত্র সংঘের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়। প্রথমে শহর শাখায় দফতর সম্পাদক ও পরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সর্বশেষে শহর শাখায় সভাপতির দায়িত্বপূর্ণ পদ অর্পিত হয় তার ওপর, সংঘের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি। কঠিন পরিশ্রমী ও কঠোর অধ্যবসায়ী শহীদ আ. মালেক সংঘের এত দায়িত্বপূর্ণ কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইসলাম, ইসলামী দর্শন ও বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দর্শন ও আন্দোলন সর্ম্পকে ব্যাপক অধ্যয়ন করেন। হাজারো দায়িত্বের মাঝেও তাঁর এ পড়াশুনা চলেছে অব্যাহত গতিতে। কাসের পড়াশুনোর প্রতি তিনি অবহেলা করেননি কখনো। কিন্তু গত বছর (৬৮) বিরামহীন গতিতে সংঘের কাজ করতে গিয়ে তাঁর পড়াশুনা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয় এবং অর্নাস ফার্স্ট কাস পাবেন না ভেবে দু’টি পরীক্ষা দেবার পর পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছিলেন। এবার তিনি পূর্ণোদ্যমে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু কে জানতো তার হইজীবনে ফাইনাল পরীক্ষার সময় এত সন্নিকটে?
.
২ আগস্ট ‘৬৯ ঢাকার নিপা’য় ছাত্রদের আহ্বান করা হলো শিক্ষানীতির উপর আলোচনা করার জন্য। সেদিন শহীদ আব্দুল মালেকের ক্ষুরধার যুক্তি ও বলিষ্ঠ ভাষণ মিলানায়তনের সবাইকে মুগ্ধ করলো। শ্রোতারা ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার পক্ষেই মত প্রকাশ করল। সেদিন তাঁর কণ্ঠস্বরে দৃঢ় বিশ্বাস ফুটে উঠেছিল। তার সে কণ্ঠস্বর ছিল বলিষ্ঠ, ছিল দ্বিধাহীন। অনেকের কাছে হয়তো এই শিক্ষানীতি নিয়ে পরস্পর বিরোধী যে আন্দোলন হচ্ছিল তা সাধারণ ব্যাপার বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু শহীদ আবদুল মালেক এসবের মাঝে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ পথ দেখতে পাচ্ছিলেন। তাই তিনি ১০ আগস্ট বাড়িতে এক চিঠি লিখলেন : “পাকিস্তান এক সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় মধ্য দিয়ে চলছে ইসলামী ও ইসলাম বিরোধী শক্তির মধ্যে চূড়ান্ত এক সংঘর্ষের প্রচুর সম্ভাবনা লক্ষ্য করছি। জানি না কি হবে।’’
আসলেও তাই, ইসলাম বিরোধী চক্র মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বশীল কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নামে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার পক্ষে প্রস্তাব পাস করতে চাইলো। সে জন্যে তারা ১২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র- শিক্ষক কেন্দ্র মিলানায়তনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবক্তা কয়েকজন ছাত্র আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে চাইলো। কিন্তু তাদের বক্তৃতা দিতে দেয়া হলো না। সভার এক পার্যযে শ্রোতাদের পক্ষ থেকে এক আপত্তিকর উক্তির প্রতিবাদ করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্রের প্রবক্তাদের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো উপস্থিত ইসলমী আন্দোলনের তরুণ কর্মীদের উপর। ছাত্র নামধারী এসব গুন্ডাদের সাথে মিলনায়তনেই সংঘর্ষ হলো। ইসলামপন্থী ছাত্রদের কয়েকজন গুরুতরভাবে আহত হলো। এদিকে গুণ্ডারা আরও দু’তিনজন কর্মী। তাঁরা রেসকোর্সের দিকে দৌঁড়াতে লাগলেন । কিন্তু দুর্বৃত্তরা তবুও তাঁদের তাড়া করছিল। মাঠের মাঝখানে তারা শহীদ আব্দুল মালেককে লাঠি লোহার রড প্রভৃতি দিয়ে আক্রমণ করে তাকে গুরুতরভাবে আহত করলো। তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন। প্রায় আধমরা অবস্থায় সেখানে তাদের রেখে দৃর্বৃত্তরা চলে গেলে আশে পাশের লোকেরা তাদেরকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। তার সংবাদ ছড়িয়ে সাথে সাথে হাসপাতাল ভরে গেল ইসলামী আন্দোলনের কর্মী আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীতে। সবার চোখে অশ্রুর বন্যা।
বাতাসের সাথে ছড়িয়ে পড়লো এখবর ঢাকা শহরের অলি- গলিতে । যারা তাকে চিনতো তারা অবাক হয়ে গেল শুনে । আর যারা চিনতো না তারাও আশ্চর্য হলো পাকিস্তানের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার দাবি তোলার এই কি পরিণতি?
শহীদ আব্দুল মালেকের যুক্তি, জ্ঞান ও প্রতিভার মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্রী মহল তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়াই ভালো মনে করেছিল। তাই তারা মাথায় অত্যন্ত গুরুতরভাবে আঘাত করেছিল। তাঁর সংজ্ঞা ফিরে আসেনি আর। ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় তিনি বিদায় নিলেন এদশের হাজার হাজার তাজা তরুণ প্রাণে দীপ্ত শপথের দাগ রেখে। সকলে কাঁদলো তাদের প্রিয় সাথীকে হারিয়ে। সকলেই শপথ নিলো তার অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে। এদেশের বুকে ইসলামী জীবন বিধান বাস্তবায়নের শপথে উজ্জীবিত হলো তরুণ তাজা হাজারো মুজাহিদরা।
.
বড় আশা ছিল সকলের- তিনি বড় হবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হবেন। কিন্তু সংগ্রামী এ যুবক যে তার জীবনের উদ্দেশ্য অনেক আগেই ঠিক করে ফেলেছেন। জীবন জিজ্ঞাসার সঠিক উত্তর যে তিনি পেয়ে গেছেন। পেয়ে গেছেন চলার পথ তা কেউ জানত না। তাইতো তিনি লিখেছিলেন “জিন্দেগীর প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা। সংগ্রামের বন্ধুর পথে এগিয়ে চলার জন্যে মায়ের বাঁধন ছাড়া আমার আর কোনো বাঁধন নেই। বৃহত্তর কল্যাণের পথে সে বাঁধনকে ছিঁড়তে হবে। কঠিন শপথ নিয়ে আমার পথ আমি চলতে চাই। আমার মা এবং ভাইয়েরা আশা করে আছেন আমি একটা বড় কিছু হতে যাচ্ছি। কিন্তু মিথ্যা সে সব আশা। আমি বড় হতে চাইনে, ছোট থেকেই সার্থকতা পেতে চাই।” তিনি আরও লিখেছেন “সব বাধা তুচ্ছ করে গাঢ় তমস্যার বুক চিরে যেদিন আমরা পথ করে নিতে পারব সেদিন আমরা পৌঁছব এ পথের শেষ মঞ্জিলে, আর সেইদিনই হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন । যেদিন আমাদের চরিত্র হবে হজরত ইউসূফের (আ.) মত-কেবল সেই দিনই আসবে সাফল্য।” দারিদ্র্য এবং উজ্জল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা, কোনো কিছুই তাকে পিছু টানতে পারলো না। চলার পথের শেষ মঞ্জিলে পৌঁছে গেলেন শাহাদাতের এক অমীয় সুধা পান করে। সবুজ পাখী হয়ে উড়ে গেলেন মহান প্রভুর একান্ত সান্নিধ্যে। মাওলানা সৈয়দ মাহমুদ মোস্তফা আল মাদানী (যিনি শহীদ আ. মালেকের জানাজায় ইমামতি করেছিলেন) জানাজায় সমবেত মুসলিম জনতার উদ্দেশ্যে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “ইসলামী আদর্শ বাস্তব রুপ দেওয়ার জন্যে কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে আব্দুল মালেক শাহাদাতের যে, দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন তা অনুসরণ করে এদেশের হাজার হাজার আ. মালেক ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য শহীদ হতে কুন্ঠা বোধ করবে না।” সেই বৃদ্ধ নেতার ভাষণ আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। শহীদী মিছিল যতই বড় হচ্ছে ততই বেগবান হচ্ছে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন : আর শাহাদাতের অদম্য বাসনা নিয়ে এগিয়ে আসছে হাজার হাজার তরুণ যুবক।
.
গোসাইবাড়ীর পাশেই সবুজ শ্যামল ছায়া ঘেরা আর মায়া- মমতায় ভরা খোকসাবাড়ী গ্রাম। যেখানে ছিল শহীদ পরিবারের আদিবাস। এ গ্রামেরই শান্ত এক কবরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন শহীদ আব্দুল মালেক। ধন নয়, সম্মানন নয়, পার্থিব জীবনের কোন সফলতার নয়, জীবনের প্রকৃত সার্থকতা তিনি চেয়েছিলেন; চেয়েছিলেন শাহাদাতের মৃত্যু। আল্লাহ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। শহীদ আ. মালেক ভাই আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার আরধ্য সংগ্রামের পতাকা রয়েছে আজো। সে পতাকা অবনমিত হবেনা কোনদিন । শহীদদের ইমাম শহীদ আ. মালেক ভাইয়ের রক্তের শপথে উদ্দীপ্ত তাঁর সংগ্রামী কাফেলার লক্ষ সাথীরা সে পতাকা বয়ে নিযে যাবে সাফল্যেও সুউচ্চ শিখরে। ইনশাআল্লাহ।
.
তার দেখানো স্বপ্ন, আগামী বিপ্লবের আকাঙ্খা আজো আন্দোলিত করে ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই জনপথকে ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃত। শহীদ আব্দুল মালেক আজো জেগে আছে সবুজ ঘাসের শিশিরে আমাদের বিশ্বাসের বিপ্লবে চিরকালের আশা জাগানিয়া বাতিঘর হয়ে ।
“মালেকের স্বপ্নেরা খেলা করে ঐ রাতের আঁধার কালিমা চিরে শিখারির বুলেটে আহত পাখি। থামেনা তো হায়, উড়ে যায় নীড়ে। চাঁদের টানে জোয়ার আসে। নদীর দু’কূল ধুয়ে হাজার প্রাণে মালেক আসে বিপ্লবী সুর ছুয়ে।” আমিন।

সোমবার, ৩১ জুলাই, ২০১৭

প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দিন আর নেই


মহান মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবন সাব সেক্টর কমান্ডার ও প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা পিরোজপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অবঃ) জিয়াউদ্দিন আহমেদ সিংগাপুর মাউন্ট এলিজাভেত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন । 
ইন্তানালিল্রলাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন । তাঁর দু’টি কিডনী অচল এবং লিভারের অবস্থাও খারাপ ছিলো । 
পরিবারের পক্ষ থেকে কামাল উদ্দিন দেশবাসীর কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধে এই অকুতোভয় সেনা নায়কের জন্য দোয়া কামনা করেছেন ।  
পিরোজপুরের অহংকার সুন্দরবনের মুকুটহীন সম্রাট মেজর (অব) জিয়াউদ্দিন সম্পর্কে কিছু তথ্য--
জন্ম:
পিরোজপুর জেলা শহরের তিনবারের নির্বাচিত পৌর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আফতাব উদ্দীন আহম্মেদের সন্তান।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা:
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ৯ নম্বর সেক্টরের সুন্দরবন সাব-সেক্টর কমান্ডার। তাঁকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অনন্য।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী :
জিয়াউদ্দিন আহমেদ ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুলাই মাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যোগ দেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। দায়িত্ব পান ৯ নম্বর সেক্টরের সুন্দরবন অঞ্চলের সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে রাখেন বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যারাকে ফিরে যান। পরে মেজর হিসেবে পদমর্যাদা পান। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে নিহত হন তখন তিনি ঢাকায় ডিজিএফআইতে কর্মরত ছিলেন। ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহি- জনতার বিপ্লবে তিনি অংশ নেন। এরপর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কর্নেল তাহেরের সৈনিক সংস্থার পক্ষে অবস্থান নিয়ে তার অনুসারীদের নিয়ে সুন্দরবনে আশ্রয় নেন। '৭৬ সালের জানুয়ারিতে সুন্দরবনে সেনা অভিযানে মেজর জিয়াউদ্দিন গ্রেফতার হন। সামরিক আদালতে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি ও আ স ম আবদুর রব, মেজরজলিল সহ অন্যদের সঙ্গে মেজর জিয়াউদ্দিনও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ নিয়ে তখন সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধারা আন্দোলন শুরু করলে আ স ম আবদুর রব, মেজর জলিলসহ অন্যদের সঙ্গে মেজর জিয়াউদ্দিনও ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি লাভ করেন। '৮৩ সালে জেনারেল এরশাদের সময় মেজর জিয়াউদ্দিন দেশ ছেড়ে আশ্রয় নেন সিঙ্গাপুরে।
কর্ম ও রাজনৈতিক জীবন:
'৮৪ সালের অক্টোবরে ছোট ভাই কামালউদ্দিন আহমেদ, ভাগ্নে শামীমসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে চলে যান সুন্দরবনের দুবলার চরে। বনদস্যু বাহিনীগুলোর হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত সুন্দরবনের জেলেদের সংগঠিত করে শুরু করেন শুঁটকি মাছের ব্যবসা। ৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুন্দরবনের মূর্তিমান আতঙ্ক ডাকাত দল কবিরাজ বাহিনীর সঙ্গে শ্যালারচরে সরাসরি বন্দুকযুদ্ধে জয়ী হন মেজর জিয়াউদ্দিন, নিহত হয় কবিরাজ বাহিনীর প্রধান। এরই মাঝে '৮৯ সালে পৌরবাসীর দাবির মুখে নির্বাচন করে তিনি পিরোজপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। গড়ে তুলেছেন সুন্দরবন বাঁচাও কর্মসূচি নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। এর চেয়ারম্যানও তিনি। কর্মজীবনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত দুলবার চর ফিসারমেন গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে আছেন। আর সংগত কারণে হাজার হাজার জেলের স্বার্থ রক্ষায় ডাকাতদের প্রতিরোধ করতে হয়েছে। কখনো জেলেদের নিয়ে, কখনো প্রশাসনকে সহায়তা দিয়ে ডাকাতদের নির্মুলের নায়কের ভূমিকা রেখেছেন। আর এ কারণেই অনেকশত্রু তার পিছু নিয়েছে। বিশেষ করে বন ও জল দস্যুদের দমনে তার ভূমিকা প্রশংসিত। আবার প্রশাসনের বনদস্যু নির্মুলে জনবল ও বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন। সুন্দরবনের একাধিক ডাকাত গ্রুপ বিভিন্ন সময় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এসব ডাকাত গ্রুপ জিয়াউদ্দিনকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। এর আগে তিনি একাধিকবার হামলার শিকার হয়েছেন।' এরপর দীর্ঘ সময় ধরে দুবলার চরসহ সুন্দরবনের শুঁটকিপলি্ল থেকে দূরে থেকেছে বনদস্যু বাহিনীগুলো। কয়েক বছর ধরে সুন্দরবনে জুলফিকার, গামা, রাজু, মোর্তজাসহ বেশ কয়েকটি শক্তিশালী বনদস্যু বাহিনী জেলে-বাওয়ালীদের মুক্তিপণের দাবিতে একের পর এক অপহরণ শুরু করে। এসব বাহিনী দুবলার চরসহ শুঁটকিপল্লিতে মাঝে মাঝে হানা দিতে থাকে। এসব বাহিনী দুবলার চর ফিশারমেন গ্রুপের কাছে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সর্বশেষ মোর্তজা বাহিনীর সদস্যরা পূর্ব সুন্দরবনের হারবাড়িয়া ও মেহেরালীর চর এলাকার মাঝামাঝি চরপুঁটিয়ায় মেজর জিয়াকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে। বন্দুকযুদ্ধে মোর্তজা বাহিনীর চার সদস্য নিহত ও মেজর জিয়া মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।

প্রকাশণা:
মুক্তিযুদ্ধে নিজের ও অন্যান্যদের অংশগ্রহণ এবং যুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি "সুন্দরবন সমরে ও সুষমায়" নামে একটি বই লিখেছেন।
প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দিন আর নেই 
মহান মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবন সাব সেক্টর কমান্ডার ও প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা পিরোজপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অবঃ) জিয়াউদ্দিন আহমেদ সিংগাপুর মাউন্ট এলিজাভেত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন । 
ইন্তানালিল্রলাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন । তাঁর দু’টি কিডনী অচল এবং লিভারের অবস্থাও খারাপ ছিলো । 
পরিবারের পক্ষ থেকে কামাল উদ্দিন দেশবাসীর কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধে এই অকুতোভয় সেনা নায়কের জন্য দোয়া কামনা করেছেন ।  
পিরোজপুরের অহংকার সুন্দরবনের মুকুটহীন সম্রাট মেজর (অব) জিয়াউদ্দিন সম্পর্কে কিছু তথ্য--
জন্ম:
পিরোজপুর জেলা শহরের তিনবারের নির্বাচিত পৌর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আফতাব উদ্দীন আহম্মেদের সন্তান।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা:
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ৯ নম্বর সেক্টরের সুন্দরবন সাব-সেক্টর কমান্ডার। তাঁকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অনন্য।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী :
জিয়াউদ্দিন আহমেদ ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুলাই মাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যোগ দেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। দায়িত্ব পান ৯ নম্বর সেক্টরের সুন্দরবন অঞ্চলের সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে রাখেন বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যারাকে ফিরে যান। পরে মেজর হিসেবে পদমর্যাদা পান। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে নিহত হন তখন তিনি ঢাকায় ডিজিএফআইতে কর্মরত ছিলেন। ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহি- জনতার বিপ্লবে তিনি অংশ নেন। এরপর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কর্নেল তাহেরের সৈনিক সংস্থার পক্ষে অবস্থান নিয়ে তার অনুসারীদের নিয়ে সুন্দরবনে আশ্রয় নেন। '৭৬ সালের জানুয়ারিতে সুন্দরবনে সেনা অভিযানে মেজর জিয়াউদ্দিন গ্রেফতার হন। সামরিক আদালতে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি ও আ স ম আবদুর রব, মেজরজলিল সহ অন্যদের সঙ্গে মেজর জিয়াউদ্দিনও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ নিয়ে তখন সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধারা আন্দোলন শুরু করলে আ স ম আবদুর রব, মেজর জলিলসহ অন্যদের সঙ্গে মেজর জিয়াউদ্দিনও ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি লাভ করেন। '৮৩ সালে জেনারেল এরশাদের সময় মেজর জিয়াউদ্দিন দেশ ছেড়ে আশ্রয় নেন সিঙ্গাপুরে।
কর্ম ও রাজনৈতিক জীবন:
'৮৪ সালের অক্টোবরে ছোট ভাই কামালউদ্দিন আহমেদ, ভাগ্নে শামীমসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে চলে যান সুন্দরবনের দুবলার চরে। বনদস্যু বাহিনীগুলোর হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত সুন্দরবনের জেলেদের সংগঠিত করে শুরু করেন শুঁটকি মাছের ব্যবসা। ৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুন্দরবনের মূর্তিমান আতঙ্ক ডাকাত দল কবিরাজ বাহিনীর সঙ্গে শ্যালারচরে সরাসরি বন্দুকযুদ্ধে জয়ী হন মেজর জিয়াউদ্দিন, নিহত হয় কবিরাজ বাহিনীর প্রধান। এরই মাঝে '৮৯ সালে পৌরবাসীর দাবির মুখে নির্বাচন করে তিনি পিরোজপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। গড়ে তুলেছেন সুন্দরবন বাঁচাও কর্মসূচি নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। এর চেয়ারম্যানও তিনি। কর্মজীবনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত দুলবার চর ফিসারমেন গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে আছেন। আর সংগত কারণে হাজার হাজার জেলের স্বার্থ রক্ষায় ডাকাতদের প্রতিরোধ করতে হয়েছে। কখনো জেলেদের নিয়ে, কখনো প্রশাসনকে সহায়তা দিয়ে ডাকাতদের নির্মুলের নায়কের ভূমিকা রেখেছেন। আর এ কারণেই অনেকশত্রু তার পিছু নিয়েছে। বিশেষ করে বন ও জল দস্যুদের দমনে তার ভূমিকা প্রশংসিত। আবার প্রশাসনের বনদস্যু নির্মুলে জনবল ও বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন। সুন্দরবনের একাধিক ডাকাত গ্রুপ বিভিন্ন সময় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এসব ডাকাত গ্রুপ জিয়াউদ্দিনকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। এর আগে তিনি একাধিকবার হামলার শিকার হয়েছেন।' এরপর দীর্ঘ সময় ধরে দুবলার চরসহ সুন্দরবনের শুঁটকিপলি্ল থেকে দূরে থেকেছে বনদস্যু বাহিনীগুলো। কয়েক বছর ধরে সুন্দরবনে জুলফিকার, গামা, রাজু, মোর্তজাসহ বেশ কয়েকটি শক্তিশালী বনদস্যু বাহিনী জেলে-বাওয়ালীদের মুক্তিপণের দাবিতে একের পর এক অপহরণ শুরু করে। এসব বাহিনী দুবলার চরসহ শুঁটকিপল্লিতে মাঝে মাঝে হানা দিতে থাকে। এসব বাহিনী দুবলার চর ফিশারমেন গ্রুপের কাছে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সর্বশেষ মোর্তজা বাহিনীর সদস্যরা পূর্ব সুন্দরবনের হারবাড়িয়া ও মেহেরালীর চর এলাকার মাঝামাঝি চরপুঁটিয়ায় মেজর জিয়াকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে। বন্দুকযুদ্ধে মোর্তজা বাহিনীর চার সদস্য নিহত ও মেজর জিয়া মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।

প্রকাশণা:
মুক্তিযুদ্ধে নিজের ও অন্যান্যদের অংশগ্রহণ এবং যুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি "সুন্দরবন সমরে ও সুষমায়" নামে একটি বই লিখেছেন।