রবিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৮

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী

একনজরে জামায়াতে ইসলামী

এই উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামী একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম । এটি অনেকের কাছে যেমন ভালবাসার আবার অনেকের কাছে সমালোচনারও । জামায়াতে ইসলামী শুধুই একটি রাজনৈতিক দল নয় । এটি কেবল সামাজিক প্রতিষ্ঠানও নয় । এটি একটি পূর্ণাংগ ইসলামী আন্দোলন । ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আল্লাহর বিধানের আলোকে গড়ে তোলার জন্য চার দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে কাজ করছে জামায়াতে ইসলামী ।


জামায়াতে ইসলামী গঠন
১৯৪১ সনের ২৬ আগস্ট বৃটিশ শাসিত দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের লাহোর সিটিতে গঠিত হয় জামায়াতে ইসলামী । প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ৭৫ জন । সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী আমীরে জামায়াত নির্বাচিত হন ।
প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণের একাংশে সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীতে যাঁরা যোগদান করবেন তাঁদেরকে এই কথা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে যে, জামায়াতে ইসলামীর সামনে যেই কাজ রয়েছে তা কোন সাধারণ কাজ নয় । দুনিয়ার গোটা ব্যবস্থা তাঁদেরকে পাল্টে দিতে হবে । দুনিয়ার নীতি নৈতিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি সবকিছু পরিবর্তন করে দিতে হবে । দুনিয়ায় আল্লাহদ্রোহিতার ওপর যেই ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে তা পরিবর্তন করে আল্লাহর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ।’

জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ও জামায়াতে ইসলামী হিন্দ
১৯৪৭ সনের ১৪ ও ১৫ই আগস্টের মধ্যবর্তী রাতে দিল্লীতে বসে উপমহাদেশের সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন । তখন গোটা উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য সংখ্যা ছিলো ,মাত্র ৬২৫ জন । দেশ ভাগ হলে জামায়াতে ইসলামীও ভাগ হয় । মোট ২৪০ জন সদস্য নিয়ে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ এবং ৩৮৫ জন সদস্য নিয়ে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান কাজ শুরু করে ।

ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সূচনা
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ এই কথা বলে প্রচার চালিয়েছেন একটি স্বাধীন দেশ হাতে পেলে তাঁরা দেশটিকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করবেন । এতে সাধারণ মুসলিম তাদের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেন । পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পাবার পর তারা সেইসব কথা ভুলে যেতে থাকেন । শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে তারা আলোচনা শুরু করেন পাকিস্তানের জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টারি সিস্টেম উপযোগী, না আমেরিকান প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেম, তা নিয়ে । এতে ক্ষিপ্ত হয় ইসলামপন্থী মানুষরা ।

১৯৪৮ সনের এপ্রিল মাসে করাচির জাহাংগীর পার্কে জামায়াতে ইসলামীর প্রথম রাজনৈতিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয় । এতে প্রধান বক্তা ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী । তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন । বক্তব্যে তিনি পাকিস্তানের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের প্রতি চারটি দফার ভিত্তিতে ‘আদর্শ প্রস্তাব’ গ্রহণ করার উদাত্ত আহ্বান জানান ।
দফাগুলো হচ্ছে
১। সার্বভৌমত্ব আল্লাহর । সরকার আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করবে ।
২। ইসলামী শরীয়াহ হবে দেশের মৌলিক আইন ।
৩। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক আইনগুলো ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত করে ইসলামের সাথে সংগতিশীল করা হবে ।
৪। ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই শরীয়াহর সীমা লংঘন করবে না ।
এইভাবে জামায়াতে ইসলামী ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু করে ।

কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণার আন্দোলন
১৯৫৩ সনের জানুয়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মাজলিসে আহরার, জমিয়তে আহলে হাদীস, মুসলিম লীগ, আনজুমানে তাহাফ্ফুযে হুকুকে শিয়া প্রভৃতি দল করাচিতে একটি সম্মেলনে মিলিত হয় । জামায়াতে ইসলামী প্রস্তাব করে যে কাদিয়ানী ইস্যুটিকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করে নেওয়া হোক । সেই সম্মেলনে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হলো না ।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসে করাচিতে সর্বদলীয় নির্বাহী পরিষদের মিটিং ডাকা হয় । এই মিটিংয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশনের’ পক্ষে প্রবল মত প্রকাশ পায় । জামায়াতে ইসলামী গোড়া থেকেই শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলো বিধায় ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশনের’ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সর্বদলীয় নির্বাহী পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসে ।
১৯৫৩ সনের মার্চ মাসে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে কতিপয় দলের ডাইরেক্ট এ্যাকশনের ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে । এই অবনতি পাঞ্জাবেই ঘটেছিলো বেশি । পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মার্শাল ল’ ঘোষণা করা হয় । কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে যায় ।
মাওলানা মওদুদীর গ্রেফতার ও ফাঁসির আদেশ
যদিও ডাইরেক্ট এ্যাকশনের বিপক্ষে ছিল জামায়াত তারপরও ১৯৫৩ সনের ২৮শে মার্চ মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষ সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী ও আরো কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে । আরো বিস্ময়ের ব্যাপার, সামরিক ট্রাইব্যুনাল ১৯৫৩ সনের ৮ই মে সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদুদীকে ফাঁসির হুকুম দেয় । জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তি এবং সকল শ্রেণীর ইসলামী ব্যক্তিত্ব এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক ও বলিষ্ঠ আন্দোলনে নেমে পড়ে । ফলে সরকার মৃত্যুদণ্ড রহিত করে সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদীর চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের কথা ঘোষণা করে ।
তবে দুই বছর একমাস জেলে থাকার পর ১৯৫৫ সনের ২৯শে এপ্রিল সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদুদী মুক্তি লাভ করেন । তাঁকে মেরে ফেলার চক্রান্তের আসল লক্ষ্য ছিলো ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের বলিষ্ঠতম কণ্ঠটিকে স্তব্ধ করে দেওয়া । কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছা ছিলো ভিন্ন । ফলে তিনি মুক্তি পান । আর ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে । গণদাবির মুখে গণপরিষদ ১৯৫৬ সনের ২৯শে ফেব্রুয়ারি একটি শাসনতন্ত্র পাস করে ।

শাসনতন্ত্র বাতিল ও পুনরায় আন্দোলন
১৯৫৮ সনের ২০শে সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খান সরকারের প্রতি আস্থা ভোটের জন্য পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসে । অধিবেশনে স্পিকার আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয় । স্পিকারের দায়িত্ব লাভ করেন ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটোয়ারী । পরিষদে হট্টগোল চলতে থাকে । উত্তেজিত সদস্যদের আঘাতে শাহেদ আলী পাটোয়ারী মারাত্মক আহত হন । তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয় । তিনি হাসপাতালে মারা যান ।
১৯৫৮ সনের ৭ই অকটোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কানদার আলী মির্যা দেশে সামরিক শাসন জারি করেন । জাতীয় পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদসমূহ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাগুলো ভেঙ্গে দেন । নয় বছরের চেষ্টাসাধনার ফসল শাসনতন্ত্রটি বাতিল করে দেন ।

প্রধান সামরিক প্রশাসক নিযুক্ত হন সেনাপ্রধান জেনারেল মুহাম্মাদ আইউব খান । ২৭ অক্টোবর আইউব খান প্রেসিডেন্ট পদটিও দখল করেন । চলতে থাকে এক ব্যক্তির স্বৈরশাসন । ১৯৬২ সনের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট আইউব খান দেশের জন্য একটি নতুন শাসনতন্ত্র জারি করেন । এটি না ছিলো ইসলামিক, না ছিলো গণতান্ত্রিক । এতে বিধান রাখা হয়, দেশের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’দের দ্বারা নির্বাচিত হবেন । আর ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ হবেন পূর্ব পাকিস্তানের ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান ও মেম্বার মিলে ৪০ হাজার জন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান ও মেম্বার মিলে ৪০ হাজার জন । অর্থাৎ ৮০ হাজার ব্যক্তি ছাড়া দেশের কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয় । এই আজগুবী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম আওয়াজ তোলে জামায়াতে ইসলামী ।

১৯৬২ সনে রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকতবাগ ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী এই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন এবং জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান । এতে প্রেসিডেন্ট আইউব খান ক্ষেপে যান । তাঁরই নির্দেশে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ১৯৬৪ সনের ৬ই জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনী ঘোষণা করে । আমীরে জামায়াত সহ মোট ৬০ জন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয় ।
বন্দিদের মধ্যে ছিলেন- আমীরে জামায়াত সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী, মিয়া তুফাইল মুহাম্মাদ, নাঈম সিদ্দিকী, নাসরুল্লাহ খান আযিয, চৌধুরী গোলাম মুহাম্মাদ, মাওলানা ওয়ালীউল্লাহ, মাওলানা আবদূর রহীম, অধ্যাপক গোলাম আযম, জনাব আবদুল খালেক, ইঞ্জিনিয়ার খুররম জাহ মুরাদ, অধ্যাপক হেলালুদ্দীন, মাস্টার শফিকুল্লাহ, মাওলানা এ.কিউ.এম. ছিফাতুল্লাহ, অধ্যাপক ওসমান রময্, মাস্টার আবদুল ওয়াহিদ (যশোর), আবদুর রহমান ফকির, জনাব শামসুল হক, মাওলানা মীম ফজলুর রহমান প্রমুখ ।

জনাব আব্বাস আলী খান, জনাব শামসুর রহমান ও মাওলানা এ.কে.এম. ইউসুফ জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন বিধায় গ্রেফতার হননি । এবারও জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তি উচ্চমানের ধৈর্যের উদাহরণ পেশ করেন ।

জামায়াতে ইসলামী সরকারের অন্যায় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় । স্বনামধন্য আইনজীবী মি. এ.কে. ব্রোহীর নেতৃত্বে একটি টিম মামলা পরিচালনা করে । পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর বিপক্ষে এবং পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে রায় দেয় । চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে যায় । সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে রায় দেয় । ১৯৬৪ সনের ৯ই অকটোবর জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন ।

‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’
১৯৬৪ সনের ২০শে জুলাই ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আইউব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। এই জোটের নাম দেওয়া হয় ‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’। এতে শরীক ছিল কাউন্সিল মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও নেযামে ইসলাম পার্টি।
১৯৬৪ সনের সেপ্টেম্বর মাসে ‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’ ১৯৬৫ সনের ২রা জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইউব খানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মি. মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর বোন মিস ফাতিমা জিন্নাহকে নমিনেশন দেয়।

এই সময় জামায়াতে ইসলামী ছিলো বেআইনী ঘোষিত । নেতৃবৃন্দ ছিলেন জেলখানায় । জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মাজলিসে শূরার যেইসব সদস্য জেলের বাইরে ছিলেন, তাঁরা ১৯৬৪ সনের ২ অক্টোবর একটি মিটিংয়ে একত্রিত হন ।
‘আলোচনান্তে মাজলিসে শূরা অভিমত ব্যক্ত করে যে স্বাভাবিক অবস্থায় একজন মহিলাকে রাষ্ট্রপ্রধান করা সমীচীন নয় । কিন্তু এখন দেশে চলছে এক অস্বাভাবিক অবস্থা । স্বৈরশাসক আইউব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে মিস ফাতিমা জিন্নাহর কোন বিকল্প নেই । এমতাবস্থায় সার্বিক অবস্থার নিরিখে জামায়াতে ইসলামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিস ফাতিমা জিন্নাহকেই সমর্থন করবে ।’
স্বৈরাচারী আইয়ুবের কবলে জামায়াতে ইসলামী
আইয়ুবের শাসনামলে জামায়াতের আমীর মাওলানা মওদুদীকে কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করা হয় । ১৯৬৪ সালে জাময়াতে ইসলামীকে হঠাৎ বেআইনী ঘোষণা করা হলো । জামায়াতে ইসলামী ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের দাবিতে সমগ্র দেশব্যাপী স্বাক্ষর অভিযান পরিচালনা করে । এ অভিযানের ফলে মৌলিক অধিকারের দাবি তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল । কিন্তু আইনের খসড়া বিল পরিষদে গৃহীত হওয়া সত্ত্বে ও প্রেসিডেন্ট ইচ্ছাপূর্বক তাতে স্বাক্ষর দিতে বিলম্ব করেন ।

১৯৬৪ সালের ৬ই জানুয়ারী জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং নেতাদের গ্রেফতার করে তারপর ১০ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট উক্ত বিলে স্বাক্ষর করে । কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে তার এ পদক্ষেপও জামায়াতকে খতম করতে সক্ষম হয়নি । হাইকোর্ট জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারী এবং সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতের নিষিদ্ধকরণের নিদের্শকে বাতিল ঘোষণা করে । এর আগে ১৯৫৮ সালেও সামরিক আইনে জামায়াত ৪৫ মাস নিষিদ্ধ ছিলো ।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ
১৯৬৫ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ভারত পাকিস্তানের উপর স্থল ও আকাশ পথে হামলা চালায় । দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হয় । এমন সময় মাওলানার প্রতি চিরদিন বিরূপ-মনোভাবাপন্ন আইয়ুব খান তার কাছে যুদ্ধে সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করেন । মাওলানা জিহাদের উপর ক্রমাগত ছ'দিন রেডিও পাকিস্তান থেকে উদ্দীপনাময় ভাষণ দান করেন-জামায়াত কমীগণকে দেশ রক্ষার খেদমতে মাঠে নামিয়ে দেন । জামায়াতে ইসলামীর এ সময়ের নিঃস্বার্থ জাতীয় খেদমত সেনাবাহিনী ও জনগণের মন জয় করে । যুদ্ধে পাকিস্তান জয়ী হয় ।

সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫১ আসনে প্রার্থী দেয় জামায়াত । এর মধ্যে ৪ টি আসন জিতে নেয় । সবচেয়ে বেশি আসনে প্রার্থী দেয় আওয়ামীলীগ এবং তারা সবচেয়ে বেশি আসনে জয়লাভও করে । তৃতীয় সর্বোচ্চ আসনে (১২০) প্রার্থী দেয় ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি । নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে । আওয়ামীলীগের সবগুলো আসনই ছিল পূর্ব পাকিস্তানে ।
১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা
১৯৭১ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে যা হয়েছে তা মূলত সমাজতন্ত্রী ও ভারতীয় ষড়যন্ত্রের মিলিত ফসল । তারা পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের সুযোগ গ্রহণ করেছিল । জামায়াত সেসময় একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে অবস্থান নিয়েছে, কোন সশস্ত্র গ্রুপ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেনি । জামায়াত যুদ্ধ বন্ধে কয়েকবার চেষ্টা করেছিল, শান্তি আনার চেষ্টা করেছিল, সরকার এবং স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেছিল কিন্তু দু-পক্ষের বাড়াবাড়িতে সেটা সম্ভব হয়নি । হত্যা খুন ধর্ষন উভয় পক্ষ করেছে । জামায়াত উভয়পক্ষের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেছে আর বিচ্ছন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলেছে যারা ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে ।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ
একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য হয়েছিল, তার শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি মেনে না নিতে পারলেও দেশের স্বাধীন সত্তাকে জামায়াত কর্মীগণ তখনই মেনে নিয়েছে । শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি ও শাসন পদ্ধতি সদা পরিবর্তনশীল । জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এদেশে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার সংগ্রাম করছে এবং করতে থাকবে । দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের জন্যেও জামায়াত দৃঢ়সংকল্প ।
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের যে সংবিধান রচিত হয় তার অধীনে মুসলমানী জীবন-যাপন সম্ভব ছিল না । এ সম্পর্কে বিভিন্ন বিদেশী সংবাদ সংস্থাও মন্তব্য করে । ইসলামের নামে দল গঠন ও ইসলামী আন্দােলন ও তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় । গণতন্ত্রকে হত্যা করে এক দলীয় শাসন কায়েম হয় । ইসলামের জাতীয় শ্লোগান “আল্লাহু আকবর’ এর স্থানে ‘জয়বাংলা”। জাতীয় শ্লোগান হয়ে পড়েছিল । স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াত তার কার্যক্রম গোপনে পরিচালনা শুরু করে । ভারপ্রাপ্ত আমির ছিলেন আব্বাস আলী খান ।

আবারো প্রকাশ্যে রাজনীতি
৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর জামায়াত আবারো প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে । এর মধ্যে দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকা অধ্যাপক গোলাম আযম দেশে ফিরে আসেন । ১৯৭৯ সালে এক সাধারণ সভায় জামায়াত পুনরায় প্রকাশ্যে কাজ করার ঘোষণা দেয় । ১৯৮০ সালে প্রথমবারের মত বায়তুল মোকারমের সামনে জামায়াতের সভা হয় । প্রকাশ্যে এটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সম্মেলন ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে । স্বৈরাচারী এরশাদের অধীনে কোন বিরোধীদল নির্বাচনে যেতে আস্থাবান না হওয়ায় জামায়াত ১৯৮৪ সালে এক অসাধারণ নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রস্তাব দেয় । কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা । ১৯৮৪ সাল থেকেই কেয়ারটেকার সরকারের দাবীতে আন্দোলন করে আসছে জামায়াত । ১৯৮৯ সালে সকল বিরোধীদল কেয়ারটেকার পদ্ধতিকে স্বাগত জানিয়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ।

১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে । জামায়াত রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানে আসীন হয় । ১৯৯১ সালে নির্বাচনে রেকর্ড ১৮টি আসনে জিতে নেয় জামায়াত । জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠন করে । অধ্যাপক গোলাম আজম আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াতের আমির ঘোষিত হন ।
১৯৯২ সালে জামায়াতের বিরুদ্ধে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয় । তারা জামায়াতকে অবৈধ ঘোষণার জন্য এবং গোলাম আযমকে অবৈধ নাগরিক হিসেবে শাস্তি দাবী করে সারাদেশে প্রচারণা চালায় । কয়েক স্থানে জামায়াতের সাথে ঘাদানিকের সংঘর্ষ হয় । ঘাদানিকের চাপে গোলাম আযম গ্রেফতার হন । ১৯৯৪ সালে উচ্চ আদালতের রায়ে অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব পুনঃস্থাপিত হয় । সে বছরই কার্যত ঘাদানিকের পতন হয় ।
১৯৯৬ সালে জামায়াত পুনরায় কেয়ারটেকার সরকারের দাবীতে আন্দোলন করে বিএনপির বিরুদ্ধে । বিএনপি একদলীয় নির্বাচন করে । তীব্র প্রতিবাদের মুখে আবারো নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় । ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ ।

ক্ষমতার অংশীদার
১৯৯৯ সালে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয় । ২০০১ সালে নির্বাচনে চারদলীয় জোট বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে । স্বাধীন বাংলাদেশে এই বছরই প্রথম ক্ষমতার স্বাদ পায় জামায়াত । তিনটি মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পায় জামায়াত । ২০০৫ সালে জঙ্গী বিরোধী ভূমিকায় জামায়াত ব্যাপক সফলতা পায় ।

পুনরায় ক্ষমতাছাড়া এবং নির্যাতন শুরু
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতা ছাড়ার দিন আওয়ামীলীগ ব্যাপক আক্রমণ করে জামায়াতের উপর । এতে প্রায় ১০ জনের মত জামায়াত কর্মী নিহত হয় । ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি সেনাবাহিনী অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে কেয়ারটেকার সরকারকে পুতুল বানিয়ে রাখে । দুই বছর সেনাশাসনে রাজনীতিবিদরা চরম অপদস্থ হয় দূর্নীতির দায়ে । জামায়াত এসময় সারাদেশে একটি নির্লোভ ও সৎ দল হিসেবে স্বীকৃত হয় ।

২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সেনা কর্মকর্তাদের দায়মুক্তির অঙ্গিকার করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় । ২০১০ সালের ২৯ জুন জামায়াতের ৩ শীর্ষ নেতা গ্রেফতার হন । শুরু হয় তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের বিচার । এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে থাকে জামায়াত । ২০১৩ সালে রায় শুরু হয় । অবৈধ রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জামায়াত কর্মীরা । সারাদেশে হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন । নিহত হন শতাধিক কর্মী । বিশেষ করে ২০১৩, ২৮ ফেব্রুয়ারী আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে দেয়া ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে সারাদেশের রাজপথে জীবন লুটিয়ে দেয় ৭৮ জন । পরবর্তী ৪দিনে আরো প্রায় ২০০ শত নারী পুরুষের জীবন কেড়ে নেয় পুলিশ ।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের বিরুদ্ধে সরকারের স্পস্ট মদদে গণজাগরণ মঞ্চ গঠিত হয় । এর বিরুদ্ধে হেফাযতে ইসলাম তৈরী হয় । হেফাযতের গনজোয়ারে অল্প কয়েকমাসের মধ্যেই গণজাগরণ মঞ্চ ভেসে যায় ।
১২ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা শাহদাত বরণ করেন । ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একদলীয় নির্বাচন করে আওয়ামীলীগ । নজিরবিহীনভাবে ১৫৪ জন বিনা ভোটেই নির্বাচিত হয় । স্বৈরাচারী এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়া সকল দল নির্বাচন বয়কট করে ।
২৩ অক্টোবর ২০১৪ সালে জামায়াতের প্রবীণ নেতা, বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা অধ্যাপক গোলাম আযম কারান্তরীন অবস্থায় শাহদাতবরণ করেন । ১১ এপ্রিল ২০১৫ সালে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান শাহদাতবরণ করেন । ২২ নভেম্বর ২০১৫ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল এবং সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ শাহদাতবরণ করেন ।
১১ মে ২০১৬ সালে জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার । সারা মুসলিম জাহানে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয় । তুরস্ক তাদের দূতকে প্রত্যাহার করে নেয় । ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে শাহদাতবরণ করেন জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী ।

মূলত ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতি নির্যাতনের স্টিমরোলার চলছে । এই কয় বছরে জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মীকে শাহদাতবরণ এবং লক্ষাধিক নেতাকর্মীকে কারাবরণ করতে হয় । বর্তমানে জামায়াতের আমীর মকবুল আহমাদ এবং সেক্রেটারি জেনারেল ডাঃ শফিকুর রহমান ।

সহায়ক সূত্র
১। জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস/ আব্বাস আলী খান
২। প্রবন্ধ/ রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী/ এ কে এম নাজির আহমাদ/ ছাত্রসংবাদ/ জুলাই-আগস্ট ২০১৩
৩। জামায়াতে ইসলামীর ঊনত্রিশ বছর/ সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদুদী
৪। জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ইতিহাস এবং কর্মসূচী/ সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদুদী
সৌজন্যেঃ AHMED AFGANI

শুক্রবার, ২ মার্চ, ২০১৮

জনপ্রিয়তার এমন দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে অদ্বিতীয়, বিশ্বে বিরল


মানুষ তার ভালো কর্ম দিয়ে অগনিত হৃদয়ে স্থান করে নেয় । জনপ্রিয় হয় । কার জনপ্রিয়তার মাত্রা কতটুকু তার সঠিক পরিমাপ করাটা সহজসাধ্য ব্যাপার নয় । এজন্য কোনো এলাকার বা কোনো দেশের বা পুরো বিশ্বের বর্তমানের বা অতীতের শীর্ষ জনপ্রিয় ব্যক্তিটি কে তা বাছাই করাটা সম্ভব হয় না । তবে মাঝে মাঝে কোনো ব্যক্তিকে ঘিরে এমন কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা সংগঠিত হয় যা তাকে শীর্ষ জনপ্রিয় ব্যক্তির কাতারে নিয়ে যায় । বাংলাদেশে তেমনই একজন ব্যক্তি হলেন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ।
বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাটলে বঙ্গবন্ধু, জিয়াউর রহমান, মাওলানা ভাসানীসহ অসংখ্য ব্যক্তির নাম পাওয়া যাবে যারা তাদের জীবদ্দশায় তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। তাদের প্রত্যেকের বেলায় এমন কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও পাওয়া যাবে যা তাদের তুমুল জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য দিবে । কিন্তু ২০১৩ সালে মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির রায়কে ঘিরে এই দেশে যেই ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ইসলামপ্রিয় ও সাধারণ জনতা তা শুধু বাংলাদেশই নয় বিশ্বের ইতিহাসেও বিরল ।
১৯৪০ সালে পিরোজপুর জেলার জিয়ানগরে (ইন্দুরকানি) জন্মগ্রহন করেন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী । একজন ইসলামিক স্কলার ও কোরআনের তাফসীরকারক হিসেবে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন তিনি । ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং ১৯৮৯ সালে দলটির মজলিসে শূরার সদস্য হন । দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন খ্যাতিমান এই ইসলামি ব্যক্তিত্ব ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন, ইসলামপ্রিয় জনতা ও সাধারণ মানুষের মাঝে মাওলানা সাঈদীর জনপ্রিয়তা ও প্রভাব ঈর্ষনীয় । আর এটাই তার জন্য কাল হলো । রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বানোয়াট অভিযোগ দাঁড় করায় আওয়ামী লীগ সরকার । ওই অভিযোগে ২০১০ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয় । তিন বছর পর তার বিরুদ্ধে প্রথমে ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। পরবর্তীতে অপিল করা হলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয় । বলা যায়, ব্যাপক জনরোষের ভয়েই সরকার নিয়ন্ত্রিত আদালত তাকে যাবজ্জীবন দিতে বাধ্য হয় ।
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় প্রদান করে । বিতর্কিত বিচারের এই ন্যাক্কারজনক রায় ঘোষণার পরই রচিত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক অধ্যায় । রায়কে প্রত্যাখ্যান করে সারাদেশে দলমত নির্বিশেষে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে । সেদিন পুরুষের পাশাপাশি যে পরিমানে নারীরা সারাদেশে রাস্তায় নেমেছে তার দৃষ্টান্তও ইতিহাসে বিরল ।

মাওলানা সাঈদীর জনপ্রিয়তা যে শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না তার প্রমানও পাওয়া যায় সেদিন । অসংখ্য হিন্দু নারী –পুরুষও সেদিন প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে । মাওলানা সাঈদী যেই এলাকা থেকে দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন সেই এলাকাটিও ছিলো হিন্দু অধ্যুষিত । তাদের মাঝেও সাঈদীর জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশচুম্বী । ফাঁসির রায় প্রত্যাখ্যান করে তারাও নেমে এসেছিলো রাস্তায় ।

সেদিন প্রতিবাদি জনতার উপর হামলে পড়ে পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত সরকারের যৌথবাহিনী । সাথে ছিলো ছাত্রলীগ-যুবলীগও । নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শুধু ২৮ ফেব্রুয়ারিতেই সারাদেশে হত্যা করা হয় নারীসহ অন্তত ৭০ জনকে । একদিনে এতসংখ্যক লোকের মৃত্যু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও হয়নি । একজন ব্যক্তির জন্য একদিনে এতলোকের প্রাণ দেয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল ।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তথ্যমতে ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে পরের ৮ দিনে সারাদেশে হত্যা করা হয় মোট ২৪৭ জনকে । তবে অধিকারসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের পরিসংখ্যান মতে মৃতের সংখ্যা ১৫৫ । এছাড়া পুলিশের গুলিতে একই সময়ে আহত হয়েছিলেন প্রায় ৫ সহস্রাধিক, গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় ২ সহস্রাধিক আর নিখোঁজের সংখ্যাও ছিলো অনেক ।
মাওলানা সাঈদীর প্রতি সাধারন মানুষের ভালোবাসার তীব্রতার প্রমান পাওয়া যায় দু একটি টেলিভিশনে প্রচারিত ফুটেজ থেকে । ফুটেজগুলোতে দেখা গেছে পুলিশের গুলিতে নিজের সন্তান বা স্বামী বা স্ত্রী মারা গেলেও তিনি একটুও ব্যথিত নন ।  তিনি শুধুই মাওলানা সাঈদীর মুক্তি চান, সেটা নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও ।

‘ফাঁসির দড়িতে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর আগে যেন আমার মৃত্যু হয়’- আল্লাহর কাছে এমনই আকুতি জানিয়ে আসছিলেন পুলিশের গুলিতে নিহত বগুড়ার শাজাহানপুরের সাজাপুর মণ্ডলপাড়ার দিনমজুর মেহেরাজের স্ত্রী রাজেনা বেগম । তার জানাজায় একমাত্র ছেলে রানা মিয়া উপস্থিত মুসল্লিদেরকে তার মায়ের এমন আর্তির কথা জানান । ভালোবাসার এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত তখন পত্রিকা ও টেলিভিশনের খবরগুলোতে দেখা গিয়েছে । যেগুলো একজন দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর তুমুল জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য বহন করে ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থানে অবস্থানকারী একজন হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন । যার আহ্বানে ছাত্র জনতা শ্রমিক নির্বিশেষে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো । কিন্তু তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা একসময় ধ্বসে পড়ে । ক্ষমতার দাম্ভিকতা তাকে আকাশ থেকে মাটিতে নামায় । এমন জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি অনাকাঙ্খিতভাবে পরিবারসহ খুন হলেও আমরা সারাদেশে তার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিনি । এমনকি কথিত আছে তার জানাজায় ১৭ জন মাত্র মানুষ অংশ নিয়েছিলেন ।

কেউ কেউ বলেন তখন সেনাবাহিনীর ভয়ে মানুষ কিছু করতে পারেনি । কিন্তু আদৌ কি এটা সত্য হতে পারে ? একজন মুজিবভক্তও কি ছিলো না যিনি এই ভয়কে উপেক্ষা করে রাস্তায় নামতে পারতেন, জীবন দিতে পারতেন ? মাওলানা সাঈদীর জন্য যারা জীবন দিলেন তারা কি পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবির যৌথ বাহিনীর ভয় করেননি। তখনও তো দেশটাকে থমথমে বানিয়ে রাখা হয়েছিলো । রাস্তায় নামলেই তখনও গুলি করা হতো । তারপরও কিন্তু সাঈদীভক্তরা রাস্তায় নেমেছেন । জীবন দিয়েছেন ।

মাওলানা সাঈদীর রায় ঘোষণার প্রথম দিনে প্রাণ হারিয়েছেন ৭০ জন । এত লোকের প্রাণহানির পর নিশ্চই দেশজুড়ে থমথমে ও ভয়ংকর অবস্থার তৈরি হয়েছিলো । তারপরেও কিন্তু সাঈদীভক্ত ও ইসলামপ্রিয় জনতা একটুও ভয় পায়নি । গুলি খেয়ে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তারা রাস্তায় নামা অব্যাহত রেখেছেন বেশ কয়েকদিন । ৮ দিন ধরে যৌথবাহিনীর গুলির সামনে চলমান এই প্রতিবাদে ২৪৭ জন প্রাণও দিয়েছেন ।
বাংলাদেশের আরেকজন শীর্ষ জনপ্রিয় ব্যক্তি হলেন বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান । সেনাবাহিনীতে তার যেমন ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিলো, তেমনি সরকার গঠন করার পর নানা ব্যতিক্রমী কাজের জন্য রাষ্ট্রপতি হিসেবেও তার জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশচুম্বী । বিশেষ করে শেখ মুজিবের ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে তার ইসলাম ও জাতিয়তাবাদ ধাঁচের নীতি দেশের মানুষের কাছে খুবই প্রশংসিত হয়েছিলো । কিন্তু সেই জনপ্রিয় লোকটি রাষ্ট্রপতি থাকাকালে যখন চট্টগ্রামে সেনানিবাসে একটি ব্যর্থ সেনা অব্যুত্থানে নিহত হন, তখন খোদ চট্টগ্রামের বিএনপির নেতাকর্মীরাও এর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি । তারা ছিলো ভয়ে তটস্থ ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, জিয়াউর রহমানের জানাজায় রেকর্ড সংখ্যক লোক সমাগম ঘটেছিলো । কিন্তু বিবেচ্য বিষয় হলো জানাজাটি ছিলো একটি বিশাল দলের প্রধান নেতার । যেই দলটি ক্ষমতায় রয়েছে । তাদের প্রধান নেতার জানাজায় সারাদেশ থেকে কর্মীবাহিনীর ঢল নামবে সেটাই স্বাভাবিক ছিলো । এই উপস্থিতি তার প্রতি মানুষের ভালোবাসার প্রমাণও দেয় । কিন্তু কাউকে ভালোবেসে তার জানাজায় অংশ নেয়া আর কাউকে ভালোবেসে গুলির সামনে দাঁড়িয়ে জীবন বিলিয়ে দেয়া কখনোই এক ব্যাপার নয় ।
মানুষকে ভালোবেসে তার জানাজায় বিপুল মানুষের অংশ নেয়ার প্রমাণ বাংলাদেশে আরো রয়েছে । জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম ও ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনীর জানাজাতেও বিপুল সংখ্যক লোকের সমাগম ঘটেছিলো ।

যুগে যুগে পৃথিবীতে এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটে যাদের বেলায় কবির লেখা- “এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরনে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভূবন” চরণ দুটি যেনো যথার্থ হয়ে দাঁড়ায় । মাওলানা সাঈদী তেমনই একজন ব্যক্তি, যার মরনে নয়, কেবল আদালতের একটি রায়ের বিরুদ্ধেই দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ কেঁদেছে, জীবন দিয়েছে, গুলিতে আহত ও পঙ্গু হয়েছে । তার মুক্তি চেয়ে এখনো মানুষ কেঁদে চলেছে । এমন জনপ্রিয়তার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে অদ্বিতীয়, বিশ্বে বিরল ।
অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক

বুধবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

হিমালয়ের কাছে ঋণী হয়ে গেলাম

মাউন্ট এভারেস্ট

এশিয়ার একটি পর্বতমালা যা তিব্বতীয় মালভুমি থেকে ভারতীয় উপমহাদেশকে পৃথক করেছে । আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, চীন, নেপাল ও ভূটান এশিয়ার এই পাঁচ দেশে বিস্তৃত হিমালয় পর্বতমালায় মাউন্ট এভারেস্ট, কেটু, কাঞ্চনজঙ্ঘা প্রভৃতি বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গগুলি অবস্থান করছে । এই পর্বতমালা থেকে বিশ্বের তিনটি প্রধান নদী সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র তাঁদের বিভিন্ন প্রধান ও অপ্রধান উপনদীসহ উৎপন্ন হয়েছে ।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার অপূর্ব সৃষ্টি । আজ আপনাদের সেই অপূর্ব সৃষ্টি বিস্ময়কর রাজ্যে নিয়ে যাবো, যেখানে যেতে চায় পৃথিবীর বহু মানুষ । পৃথিবীর সব মানুষ হিমালয় পর্বতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ । একবার যে জেনেছে বা শুনেছে এর সৌন্দর্য্য আর সৌকর্যের কথা, সে আর তার মায়াজাল থেকে বেরোতে পারেনি । হিমালয় মানে এক বিস্ময়কর রহস্য, এক অদ্ভুত ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য । হাজার হাজার বছর ধরে তাবৎ দুনিয়ার মানুষকে অভিভূত করে রেখেছে এই হিমালয় । হিমালয় হলো পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতমালা । আর সেটাও কিন্তু যে সে উঁচু নয় ! ভাবেন তো, আপনাদের বাড়ির ছাদ থেকে একটা মানুষকে কতোটুকু দেখায়, কিংবা ২০ তলা বা ৫০ তলা উঁচু বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ? পিঁপড়ার মতো, তাই না ? কিংবা ভাবেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিল্ডিংয়ের কথা । কিন্তু সে উচ্চতাও এই পর্বতমালার কাছে নস্যি । অতো উপর থেকে মানুষ তো দূরে থাক, হাতিও দেখা যাবে না । নীল তিমির কথাও যদি ধরেন, সেও পাত্তা পাবে না । কারণ পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে আট কিলোমিটার বা ২৯ হাজার ৩৫ ফিট উঁচুতে রয়েছে এর চূড়া "এভারেস্ট"।
এবার চলেন ‘হিমালয়’ শব্দে ফিরে যাই । ‘হিমালয়’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে, অর্থ তুষারের আবাস বা বাসা । (হিম+আলয়= হিমালয়, বরফের ঘর) । কারণ, এর সবচেয়ে উঁচু চূড়াগুলো সবসময় তুষার দিয়ে ঢাকা থাকে । পর্বত আর পর্বতমালার পার্থক্য তো আপনারা বোঝেন, পাহাড়ের চেয়েও উঁচু যেগুলো, সেগুলোকে আমরা বলি পর্বত । আর অনেকগুলো পর্বত একসঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকলে, সেগুলোকে একসঙ্গে আমরা বলি পর্বতমালা । হিমালয় এমনি অনেকগুলো পর্বতমালা; মোটমাট ৬৬টি পর্বত, তিনটি সমান্তরাল রেঞ্জে উঠে গেছে ভারত, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের সমতল ভূমির বিপরীতে । এই বিশাল পর্বতমালাকে যদি আপনি এক বিশালাকার দানবের আকারে ভাবেন, তাহলে দেখতে পাবেন যে এর দেহের মাঝে মানে এর রেঞ্জের একদম মাঝে অবস্থিত ভূটান, নেপাল আর ভারতের সিকিম প্রদেশ । আর এর বিস্তৃত অংশ এবং কয়েকটি চূড়া আছে পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, চীন ও তিব্বতের প্রান্ত ঘিরে ।

আচ্ছা, এবার বলেন, এতো যে উঁচু হিমালয়, সেটা তৈরি হলো কি করে ? আসলে পৃথিবীর এই উচ্চতম পর্বতমালাও কিন্তু সবসময় এতো উঁচু ছিলো না, আদিম পৃথিবীর উচ্চতম স্থান ছিলো আরেকটি । আজকের এই হিমালয় কি আর একদিনে হয়েছে ! তবে হিমালয় এই চেহারায় আসার পর থেকে প্রায় একই রকম আছে । আজ থেকে প্রায় ৬ কোটি বছর আগে জন্ম হয় এই পর্বতমালার । মূলত এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের কারণেই জন্ম হয় এই পর্বতমালার ।
যাহোক, বলছিলাম চূড়ার কথা । হিমালয় পর্বতমালায় যে সমান্তরাল তিনটি রেঞ্জ বা সারি রয়েছে, তাতে পৃথিবীতে ২৪ হাজার ফিট উঁচু পর্বতচূড়া আছে ১০৯ টি । এই ১০৯টি চূড়ার মধ্যে ৯৬টি আছে হিমালয় পর্বতমালার ওই সমান্তরাল তিনটি রেঞ্জে । সবার দক্ষিণে যে শিখর বা চূড়াটি রয়েছে তা প্রায় ৫০০০ ফিট উঁচু, মধ্যসারির পর্বতমালাগুলোর সর্বোচ্চ উচ্চতা ৭০০০ থেকে ১৫০০০ ফিট । আর এর পরেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতচূড়া সম্বলিত হিমালয় রেঞ্জ । মানে, এই রেঞ্জেই আছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট ।
তবে মাউন্ট এভারেস্টকে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বলে ঘোষণা করার ব্যাপারেও কিছু মজা আছে ।
আগে সবাই জানতো, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু চূড়া হল কাঞ্চনজক্সঘা । এই পর্বতশৃঙ্গটিও হিমালয়ে, এভারেস্টের কাছাকাছি । পরে এভারেস্টের খোজ পাওয়া গেলে শুরু হল শৃঙ্গটি মাপার কাজ । এই শৃঙ্গটির উচ্চতা মেপে বের করার কাজটি করেছিলেন এক বাঙালি, রাধানাথ শিকদার, ১৮৫২ সালে । কিন্তু এতো বড়ো সিদ্ধান্ত কি আর মাপজোখ না করে মেনে নেয়া যায় ? তৎকালীন বৃটিশ ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যান্ড্রু ওয়াহ তা মাপজোখ করতে লেগে যান । কয়েক বছর ধরে চলে সেই মাপজোখের পালা । অবশেষে, ১৮৬৬ সালের মার্চ মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, কাঞ্চনজক্সঘা আর পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ নয়, দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ । সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আসলে এভারেস্ট ।

তবে মজার ব্যপার কী জানেন ? তখনো কিন্তু পর্বতশৃঙ্গটির নাম এভারেস্ট দেয়াই হয়নি । শৃঙ্গটিকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ঘোষণা করার পরে ওয়াহ পড়লেন আরেকটা ঝামেলায় । শৃঙ্গটির স্থানীয় অনেক নাম আছে, কিন্তু এমন কোনো নাম নেই, যে নামটি সবার কাছে প্রচলিত । অ্যান্ড্রু ওয়াহ নিরাপদ পথে হাঁটলেন । তিনি স্থানীয় নামগুলোর কোনটিই বেছে নিলেন না । তার আগে বৃটিশ ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল যিনি ছিলেন, ওয়াহ তার নামই বেছে নিলেন, জর্জ এভারেস্টের নামে নামকরণ করা হলো পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গের "মাউন্ট এভারেস্ট" বা "এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্গ"। ১৯৫৩ সালের ২৯ মে । মানবজাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরনীয় দিন । এতোদিন পর্যন্ত যে এভারেস্ট মানুষের কাছে ছিলো অজেয়, সেই সুউচ্চ শৃঙ্গটিও মানুষের পদানত হলো । তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারি ১৯৫৩ সালের ২৯ মে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখে যৌথভাবে হিমালয় জয় করেন ।
তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারি
ভাবছেন উঁচু হলো তো বয়েই গেল, তাতে উঠতে কি সমস্যা ? আছে আছে, সমস্যা আছে বলেই তো বলছি । সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, মাটি থেকে যতো উপরে ওঠা যায়, বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ততো কমে আসে । আর অক্সিজেন আমাদের জন্য কতো দরকারি, তা তো জানেনই । আর মাটি থেকে এতো উপরে যে চূড়া, সেখানকার বাতাসে অক্সিজেন এর পরিমান অনেক কম, তা একবার ভাবেন । তাই পর্বত চূড়ায় উঠতে হলে ঘাড়ে করে অক্সিজেন সিলিন্ডার বয়ে নিয়ে যেতে হয়, মহাকাশচারীদের মতো । কোনো কারণে যদি ট্যাংক ছিদ্র হয়ে যায়, কিংবা ট্যাংক থেকে মাস্কে অক্সিজেন আসার নল ফুটো হয়ে যায়, তবেই মরণ ! তাছাড়া, তুষারাবৃত হিমালয়ের প্রায় সবগুলো পর্বতশৃঙ্গে ওঠার রাস্তা যথেষ্ট খাড়া । শুধু তাই নয়, সে পথে প্রায়ই নানা দুর্যোগ হয় । হঠাৎ করে হয়তো তুষার ঝড় শুরু হলো, কিংবা পাহাড়ে জমা তুষার ধ্বসে পড়লো । তবেই আর আপনাকে বাঁচতে হবে না । আর একবার রাস্তা ভুল করলে হয়েছে, আর রাস্তা খুঁজে পেতে হবে না ! ওখানে যে সবই সাদা, শুধু বরফ আর বরফ ।

ভাবছেন তাহলে নিশ্চয়ই অনেক মানুষ এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে গিয়ে মারা পড়েছে ? তবে আর বলছি কি ! হিলারি আর তেনজিং কী আর প্রথম হিমালয়ে চড়তে গিয়েছিলো ! এর আগে কতো মানুষ চূড়ায় উঠতে গিয়ে মারা পড়েছে । পরেও মারা গেছে অনেকে । তবে এখন হিমালয়ের চূড়ায় ওঠা কিছুটা সহজ হয়ে এসেছে; তবুও কাজটা ভীষণই কঠিন । একই সঙ্গে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণও বটে । যতো প্রযুক্তিই ব্যবহার করেন, একবার তুষার ঝড়ে নয়তো তুষার ধ্বসের মধ্যে যদি পরেই যান, তবে আর বাঁচার উপায় নেই । তবু মানুষ এভারেস্ট জয় করতে চায় । প্রতি বছরই অসংখ্য মানুষ নেপালে নয়তো চীনে ছুটে যায় এভারেস্ট চূড়ায় পা রাখতে । আর সেই তালিকায় কোনো বাংলাদেশীর নাম ছিলো না বহুদিন । অবশেষে সেই আক্ষেপ দূর করেন 'মুসা ইব্রাহিম' । ২০১০ সালের ২৩ মে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় তিনিই প্রথম বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা ওড়ান । তারপর এভারেস্ট জয় করেছেন আরো কয়েকজন বাংলাদেশী । মুসা ইব্রাহিমের পরপরই ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে এভারেস্ট জয় করেন এম এ মুহিত । তবে তিনি একবার এভারেস্টে চড়েই খুশি থাকেননি, গিয়েছেন দু’বার । বাংলাদেশের মেয়েরাই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন ? সেই আক্ষেপও ঘুঁচে গেছে । নিশাত মজুমদার প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন ২০১২ সালের ১৯ মে । পরে ২০১২ সালের ২৬ মে ওয়াসফিয়া নাজরীন দ্বিতীয় বাংলাদেশি নারী হিসেবে জয় করেন মাউন্ট এভারেস্ট ।

এভারেস্ট সাগরমাতা -"সাগরের মাতা", চোমোলংমা অথবা কোমোলংমা ৮,৮৪৮ মিটার । চীন ও নেপাল সীমান্তে অবস্থিত বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ ।

কাঞ্চনজঙ্ঘা Kangchen Dzö-nga, "তুষারের পাঁচ রত্ন" ৮,৫৮৬ মিটার । বিশ্বের ৩য় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, ভারতের সর্বোচ্চ (সিকিম) এবং নেপালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ।

অন্নপূর্ণা ("শস্য দেবী) ৮,০৯১ মিটার । নেপালে অবস্থিত বিশ্বের ১০ম সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ।

বাংলাদেশে

তাজিংডং (বিজয় নামেও পরিচিত) বাংলাদেশের একটি পর্বতশৃঙ্গ । সরকারিভাবে এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ । বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বান্দরবন জেলার রুমা উপজেলার সাইচল পর্বতসারিতে অবস্থিত । সরকারী হিসেবে তাজিংডং পর্বতের উচ্চতা ১,২৮০ মিটার (৪১৯৮.৪ ফুট) । [২] পূর্বে কেওক্রাডংকে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মনে করা হত, আধুনিক গবেষণায় এই তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে । কেওক্রাডং বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় অবস্থিত । অর্থাৎ বান্দরবানেরও দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, এর উচ্চতা পরিমাপ করা হয়েছিল ১,২৩০ মিটার ।

হিমালয়ের নিকটে

ভ্রমন পিয়াসী আমি ছোটবেলায় টিভিতে তুষারপাত দেখে মনে মনে তুষার দেখার গভীর ইচ্ছে জাগতো । স্বপ্ন দেখতাম হিমালয়ের পাদদেশে গিয়ে তুষার দেখছি । ২০০৭-এ হিমালয়ের অনেকটা কাছে গিয়েও তুষার দেখার ভাগ্য হলো না । আমার অনেক বন্ধুরা ইউরোপ আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে সেই কবে । তাদের কাছে তুষারের গল্প, দেশের গল্প, টাকার গল্প শুনতাম । তাই মনে মনে একদিন সংকল্প করলাম, তুষারের দেশে যাবো একদিন । জানুয়ারির শেষ । ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে থামেলের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার । ঘণ্টাখানেক লাগবে যেতে । গাড়ি দরবার স্কয়ারের সামনে থেকে চলে যায় । এখানে গাড়ি থামতে দেয় না । কয়েক বছর আগের ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ে । তবে দরবার স্কয়ারটা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের আওতায় পড়েছে ।
আমি নতুন একটা শহরকে জানতে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে বেশ গল্প করি । তাই প্রথমেই বেছে নিই ট্যাক্সি চালককে । কিছু কথা বলতেই তরুন গাড়ি চালক হেসে হেসে উৎসাহের সঙ্গে বলে যাচ্ছে তার মতামত—ইংরেজি ও হিন্দি মিলিয়ে । চালককে বেশ ভারতবিদ্বেষী দেখলাম । ভারত তাদের রাজনীতিতে যথেষ্ট মাথা ঘামায় । ক্ষোভের সঙ্গে সে বলে, নেপাল উন্নত একটা রাষ্ট্র হতে পারত কিন্তু শাসকদের দুর্নীতিতে দেশের এই অবস্থা । আমি হাসি, দুর্নীতি দক্ষিণ এশিয়ার ভাইরাস রোগ । এর ভ্যাকসিন আছে কিন্তু দেওয়া যাবে না । এই নিয়ে অভিযোগ শেষ হবে না । তালিকা অনেক লম্বা ।
আমরা চারজন, আরজু, আবীর, রোকন এবং আমি । কাঠমুন্ডুর হোটেল ভাইশালিতে পৌঁছুলাম । রাত কাটিয়ে সকাল বেলা গোসল সেরে নাস্তার জন্য ডাইনিংএ গেলাম । যথারীতি গতকালের ড্রাইভার পুরুসুত্তম হাজির । আমাদেরকে পোখরা নিয়ে যাবে । প্রচন্ড ট্রাফিক জ্যামের কাঠমুন্ডু শহর ছেড়ে গাড়ি তখন হাইওয়েতে । জানালাটা খুলে মুক্ত বাতাস নিচ্ছি । রাস্তার এক পাশে উচু উচু পাহাড় আর অন্যপাশে পাথর নদী । পথে চলতে চলতে চারপাশে সবুজ গাছপালা আর খরস্রোতা নদী পার হচ্ছি । ভারতবর্ষের এই এক এলাকা অর্থাৎ মোগল আর ব্রিটিশরা নেপালকে কবজা করতে পারেনি । স্বাধীন ছিল নেপাল ! ভাবতেই ভালো লাগে । তবে ব্রিটিশরাজের মিত্র ছিল নেপাল । তাই দখলের প্রয়োজন পড়েনি । লামজং ও কাস্কির মহারাজা জং বাহাদুর রানা প্রথম দক্ষিণ এশিয়ার রাজা, যিনি ১৮৫০ সালে প্রথম রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে ইউরোপ গমন করেন । চীনও নেপাল নিয়ে দখল খেলায় পিছিয়ে নাই । চীন ৩২টি বর্ডার ক্রসিং পয়েন্ট খুলে রেখেছে নেপালে । যা ভারতের খুব একটা পছন্দের নয় । নেপালিদের মাধেশি বিক্ষোভের কথা শুনেছি । শুনেছি হ্যাশট্যাগ ব্যাক অফ ইন্ডিয়ার কথাও । জ্বালানি তেলের জন্য চীনের কাছে নেপালকে নত থাকতে হয় । যাক আমি পর্যটক, নেপালের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আমার লাভ নেই । হিমালয়ের সৌন্দর্য দেখতে এসেছি ।
বিকেল নাগাদ পোখরা পৌঁছলাম । ডিজিটাল যুগ ! হিমালয় যেতে রাতদিন দিনরাত কসরত করতে হয় না । হেলিকপ্টার ব্যবস্থা আছে । ৩০ মিনিট যেতে, মাঝে আধা ঘন্টা ঘোরাঘুরি, ৩০ মিনিট আসতে, মোট দেড় ঘন্টা । জীবনের অন্যতম স্বরনীয় ঘটনা হয়ে থাকলো ।

সকালে প্রভু হেলিকপ্টার কোম্পানির পক্ষ থেকে গাড়ি এসে আমাদেরকে এয়ারপোর্ট রওনা দিলো । উত্তেজনা বোধ করছিলাম । স্বপ্ন কি সত্যি হতে যাচ্ছে ? আমরা কি হিমালয় জয় করতে যাচ্ছি ? হাস্যকরই বটে কিন্তু আন্নপুরনা বেজ ক্যেম্প নেমে কিছুক্ষনের জন্য হতবাক হয়েছিলাম । শুভ্রতা ছেয়ে আছে গোটা পাহাড়ময় । আমি কি হিমালয় দেখবো নাকি ছবি তুলবো ! আল্লাহু আকবর ! আল্লাহু আকবর । আল্লাহু আকবর । আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার অসীম করুণায় আজ তার অপূর্ব সৃষ্টি অবাক হয়ে দুচোখ ভঁরে দেখলাম । কিছুক্ষন একে অপরের গায়ে তুষার বরফ ছোড়াছুড়ি করে ক্লান্ত হয়ে বেজ ক্যেম্প রেস্টুরেন্টে কফি খেতে ঢুকলাম । ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম । কড়া এক মগ কফি হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে ঐ দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করলাম, আলহামদুলিল্লাহ ।

বিদেশী শহরে রাতের ঘুম । খুব ভোরে ঘুম ভাঙল । জানালার পর্দা সরিয়ে বাহিরে তাকিয়ে স্তব্দ হয়ে গেলাম । সামনে কিছু বিদ্যুৎতিক তার, আর তারের পেছনে স্পস্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছি ম্যঙ্গো কালারের চকবারের মত একটা বিরাট পাহাড় চূড়া । কিচ্ছুখন বিমূড় হয়ে তাকিয়ে রইলাম । আহ এই তাহলে গোল্ডেন সানরাইজ ।
দ্রুত রেড়ি হতে হবে । তাড়া খেয়ে এই ঠাণ্ডা ভোরবেলা নিজের সাথে যুদ্ধ করে উষ্ণ কম্বল্টা সরিয়ে নিজেকে বাথরুমের কুসুম গরম পানিতে সঁপে দিলাম । হোটেল থেকে বের হয়ে দেখি আসেপাশের অনেক দোকানের শাটার খুলছে । বাজে মাত্র ৫ঃ৩০মিনিট, বুঝা গেল আমাদের দেশের গ্রামের মত গ্রামীন নেপালবাসীরাও , early to rise & early to sleep তত্তে বিশ্বাসী অথবা পর্যটকদের জ্বালায় বেচারারা ঘুমাতে পারে না । আমাদেরকে কাঠমুন্ডু হয়ে ঢাকা যেতে হবে ।








সারাংকোট ২০০৭ হাজী হেলাল এবং আমি (Sun rise point) 

সারাংকোট ২০০৭ মাহদী (Sun rise point) 

মাহদী এবং মাহীর