সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৫

জেদ্দা এয়ারপোর্ট

জেদ্দা বিমান বন্দরে নেমে বিশ্রাম কক্ষে অপেক্ষা করতে হবে । পাসপোর্টে প্রবেশ সিল লাগানো হলে আপনার লাগেজ/ব্যাগ সংগ্রহ করুন । ব্যাগ মেশিনে স্ক্যান করিয়ে মুল বিল্ডিং থেকে বের হলে ট্রান্সপোর্ট কর্তৃপক্ষ আপনার ব্যাগ নিয়ে বড় ট্রলিতে উঠিয়ে নিবে । পাসপোর্টে সিল মোহর লাগানো এবং স্ক্যানিং পর্যন্ত আপনাকে অনেক সময় বসে কিংবা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে । 

বাংলাদেশের পতাকা টানানো জায়গায় আপনার ব্যাগসহ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন । পাসপোর্টে লাগানো স্টিকারই আপনার সৌদি মোয়াল্লেম নাম্বার । জেদ্দা থেকে মক্কা কিংবা মদীনা যেতে আপনার পাসপোর্টে লাগানো স্টিকারে যে নাম্বার আছে সেই নাম্বারের বাসে আপনাকে নিয়ে যাবে । সর্ব অবস্থায় বাসের জন্য ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করুন । আপনার এজেন্সীর কন্ট্রাককৃত সৌদি মোয়াল্লেমের বাস মক্কা ও মদীনায় হোটেলে/বাসায় পৌঁছে দেবে । আপনার পাসপোর্টটি জেদ্দা এয়ারপোর্ট থেকে মোয়াল্লেম কর্তৃপক্ষ নিয়ে নেবে । --(চলবে)-------
"শারঈ' মানদন্ডে
দোয়া-যিকির,হজ্জ ও উমরা" 

বিবাহ এবং তার গুরুত্ব

প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও মনের পরম প্রশান্তি লাভই হচ্ছে বিয়ের প্রধানতম উদ্দেশ্য । 
ইসলামে নারী পুরুষের মধ্যে  সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিয়েই হচ্ছে একমাত্র বৈধ উপায়, একমাত্র বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা । বিয়ে ছাড়া অন্য কোনো ভাবে- অন্য পথে - নারী পুরুষের মিলন ও সম্পর্ক স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ । বিয়ে হচ্ছে পুরুষ ও নারীর মাঝে সামাজিক পরিবেশ ও সমর্থনে শরীয়াত মোতাবেক অনুষ্ঠিত এমন এক সম্পর্ক স্থাপন, যার ফলে দুজনের একত্রে বসবাস্ব পরস্পরে যৌন সম্পর্ক স্থাপন সম্পূর্ণরুপে বৈধ হয়ে যায় । যার দরুন পরস্পরের উপর অধিকার আরোপিত হয় এবং পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য অবশ্য পালনীয় হয়ে দাড়ায় ।
পবিত্র কুরআনুল কারীমে্র সুরা আন-নুরের ৩২নং আয়াতে মহান আল্লাহ পাক বলেনঃ বিয়ে দাও তোমাদের এমন সব ছেলে -মেয়েদের, যাদের স্বামী বা স্ত্রী নেই, বিয়ে দাও তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা বিবাহের যোগ্য হয়েছে । Marry the unmarried among you and the righteous among your male salves and female salevs. Sura an-noor- 32 অন্যত্র আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেনঃ তোমরা মেয়েদের অভিভাবক মুরুব্বীদের অনুমতিক্রমে তাদের বিয়ে করো । অবশ্য অবশ্যই তাদের দেন মোহর দাও । সুরা নিসা- ২৫ 
Whoever among you cannot the means to marry free believing women........   ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তায়াল আনহু থেকে বর্ণিত সাইয়েদুল মুরসালীন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কুমারিত্ব ও অবিবাহিত বা নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের কোন নিয়ম ইসলামে নেই । বুখারী-১৪১৬

ইসলামের দৃষ্টিতে পারিবারিক জীবনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে নরনারীর নৈতিক পবিত্রতা ও সতীত্ব সংরক্ষন । আর এজন্য বিয়ে করা কে ফরজ করা হয়েছে । তেমনি পুরুষদের জন্য এ অনুমতিও দেয়া হয়েছে যে, বিশেস কোন কারনে যদি একসাথে একের অধিক স্ত্রী গ্রহন করা তার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়ে তাহলে সে করতে পারে । তবে তার শেষ সীমা হচ্ছে চারজন পর্যন্ত । একসঙ্গে চারজন পর্যন্ত  স্ত্রী গ্রহন করা একজন পুরুষের পক্ষে জায়েয-বিধি সম্মত ।  এ সম্পর্কে পবিত্র  কুরআন মজিদে যে আয়াতটি রয়েছে তা হচ্ছেঃ তবে যে সব নারীদের তোমরা পছন্দ করো, তাদের মধ্য থেকে বিয়ে করে নাও - দুই -তিন -চারজনকে । সুরা আন-নিসা- ৩ । Then marry those that please you of women, two or three or four.  চারটি কাজ নবীগনের সুন্নাতের মধ্যে গন্য; তা হচ্ছেঃ 
(১) সুগন্ধি ব্যবহার করা । (২) বিয়ে করা । (৩) মিসওয়াক করা । এবং (৪)  খাতনা করানো ।
সুরা আন-নিসার ৩ নং আয়াতের শেষে বলা হয়েছে - আর তাদের মধ্যে সুবিচার করতে পারবে না বলে যদি ভয় করো তোমরা, তাহলে একজনমাত্র স্ত্রী গ্রহন করবে । 


মাওলানা আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের আনা অভিযোগ ডাহা মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত

# ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন
# ১৯৭৬ সালে তিনি গোপালগঞ্জ জেলার গোয়ালগ্রাম কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান
# ১৯৮১ সালে তিনি জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত হন
# তিনি একাধারে ইউনিয়ন পরিষদ,  উপজেলা পরিষদ সর্বশেষ জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন

সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের আমীর,  সাবেক সংসদ সদস্য,  বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল খালেককে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে একটি মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। জেলার শীর্ষ পর্যায়ের একজন আলেমকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনায় জেলাব্যাপি গত দ’ুদিন ধরে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ছাত্রজীবনে তিনি একজন মেধাবি ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়সহ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি জ্ঞান অর্জন করেন। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি গোপালগঞ্জ জেলার গোয়ালগ্রাম কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ পান। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না।
 ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে কয়েকটি হত্যাসহ হিন্দু পরিবারের জমি ও বাড়ি দখল করার অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত এ নেতার পরিবারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকরা করা হয়েছে। তার স্ত্রী জানান, বর্তমান সরকার যে প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু করেছে তারই ধারাবাহিকতায় তার স্বামীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তার স্বামী এ ধরনের অপরাধে জড়িত থাকলে সাতক্ষীরার জনগণ তাকে বিপুল ভোটে এমপি হিসেবে নির্বাচিত করতো না। রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে সরকার মাওলানা আব্দুল খালেককে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়েছে। ইতঃপূর্বে সরকারি দলের ইঙ্গিতে তার বাড়িতে ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়।
তিনি বলেন,  সরকার আইনের শাসন ও গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করে চিরদিন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী জনগণের ভালবাসা ছাড়া জোর করে ক্ষমতায় থাকা যায় না। মিথ্যা,  বানোয়াট মামলা দিয়ে তার স্বামীকে যতই হয়রানি করার অপচেষ্টা করা হোক না কেন জনগণের নিকট তা গ্রহণযোগ্য হবে না। জুলুম-নির্যাতন বন্ধ করে অবিলম্বে তার স্বামী মাওলানা আব্দুল খালেককে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দেয়ার দাবি জানান তিনি।
সূত্রে জানা যায়,  ছাত্রজীনে তিনি মেধাতালিকায় দুই-পাকিস্তানের স্বর্ণ পদক পেয়েছেন। বেশির ভাগ সময়ে তিনি জ্ঞান সাধনায় ব্রত থাকতেন। কুরআন হাদিসের জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়াই ছিল তার কাজ। হাজার হাজার আলেম তাকে উস্তাদ হিসেবে সম্মান করে। তিনি একাধারে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সাংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিগত বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সময়ে তিনি সাতক্ষীরা সদর আসন থেকে বিপুল ভোটে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
ক্ষমতায় থাকাকালে তার বিরুদ্ধে কেউ অনিয়য়ম দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেনি। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পাপলন করার পরও সারাজীন তিনি সাধারণ জীপনযাপন করতেন। বিলাশবহুল বাড়ি গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ তিনি পেলেও তা করেননি। সকল লোভ লালশার উর্ধ্বে উঠে তিনি মানুষের সেবা করতেন। সংসদ সদস্য থাকাকালে তিনি এক কাঠা জমিও ক্রয় করতে পারেননি। এমনকি যেদিন তার সংসদ সদস্য পদ শেষ হয়ে যায় সেদিন ও তার ঘরে ভাল খাদ্য খাবার ছিল না। এমন মানুষের সন্ধান খঁজে পাওয়া বিরল বলে অনেকে তাকে মহৎ মানুষের জীবনের সাথে তুলনা করেন। তাকে পীরের মর্যাদা দিতেও সাতক্ষীরার মানুষ পিছে থাকেনি । এমন একজন বড় মাপের মানুষ অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল খালেক।
গ্রামের মক্তবে তার লেখা পড়া জীবন শুরু। ১৯৫৭ সালে আগরদাড়ী মাদ্রাসা হতে প্রথম বিভাগে দাখিল পাশ করেন। ১৯৬১ সালে আলিম পরীক্ষায় তিনি বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) First Class Second । ১৯৬৩ সালে ফাযিল পরীক্ষায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে) First Class 3rd হন তিনি। ১৯৬৯ সালে কামিল পরীক্ষায় দুই পাকিস্তানে First Class 1st হন। কৃতিত্বে পুরস্কার স্বরূপ পান Gold Meda। এরপর তিনি HSC ভর্তি হন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে। ১৯৬৭ সালে তিনি সমগ্র পাকিস্তানে First Class 3rd হন। ১৯৬৯ সালে Degree পরীক্ষায় First Class 6th  হন। তারপর তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি হতে Masters প্রথম পর্ব পরীক্ষায় ১৯৭০ সালে প্রথম বিভাগে 11th এবং ১৯৭৫ সালে MA দ্বিতীয় পর্ব চূড়ান্ত পরীক্ষায় First Class Second হন তিনি। এ মানুষটি ২০১৩ সালে সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্ত করেন। তাই তিনি একজন কুরআনের হাফেজ। তার এ দীর্ঘ শিক্ষা জীবনে কোথাও কখনো নিয়ম ভঙ্গ করার অভিযোগ কেউ করতে পারেনি। আর আজ শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য তাকে জঘন্য মিথ্যা মামলায় ফাসানো হলো।
 মাওলানা আব্দুল খালেক ১৯৭৩ সালে সাতক্ষীরা আলিয়া মাদ্রাসায় হেড মাওলানা পদে তার কর্মজীবন শুরু করেন। তিন বছর পর ১৯৭৬ সালে তিনি গোপালগঞ্জ জেলার গোয়ালগ্রাম কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭৭ সালে নড়াইল শাহাবাগ কামিল মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক হন। একই বছর তিনি আগরদাড়ী আমিনিয়া কামিল মাদ্রাসায় প্রধান মাওলানা পদে যোগদান করেন। ১৯৮১ সালে আগরদাড়ি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হন। ১৯৮১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর অত্যান্ত যোগ্যতার সাথে তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৮৭ সালে স্থানীয় ইউনিয় পরিষদ নির্বাচনে বৈকারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য হলে বিপুল ভোটে তিনি চেয়ারম্যান হতে পারতেন না। ১৯৮৯ সালে প্রথম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সারা বাংলাদেশব্যাপী। সেই নির্বচনে তিনি প্রায় ৪০, ০০০ (চল্লিশ হাজার) ভোটের ব্যবধানে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তারপর ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনে সাতক্ষীরা সদর আসনের সাংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এক লক্ষেরও বেশি ভোটের ব্যাবধানে। যেই শিমুল বাড়ীয়ায় তাকে ৭১ এর নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে তা যদি সত্য হতো তাহলে ১৯৮৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে সেই এলাকা থেকে তিনি কি ভোট পেতেন? শুধু ভোট পাওয়া নয় সেই কেন্দ্রেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিলেন।
 ১৯৮০ সালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ড নয় শিক্ষামূলক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৮১ সালে আগরদাড়ী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রুকন হন এবং ইউনিয়ন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান। এরপর থানা সভাপতি, জেলা নায়েবে আমীর এবং ২০১২ সালে সাতক্ষীরা জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত হন। ২০১২ থেকে ২০১৫ চলতি সাল পর্যন্ত তিনি সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের আমীর আছেন। সুত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম 

রবিবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৫

প্লেনে যাত্রীর করণীয়


প্লেনে উঠার পর একজন হাজীর সর্বপ্রথম কর্তব্য হলো হাতে কোনো কিছু থাকলে তা সীট বক্সে রেখে নিজের সীটে বসে সীট বেল্ট বাধা । নিজের সীট খুজে পেতে সমস্যা হলে প্লেনের লোকদের সাহায্য নিতে হবে, তারা সীট দেখিয়ে দেবে । সীট বেল্ট বাধতে না জানলে অন্যের সহযোগিতা নিতে হবে । সীটে বসে সেই দোয়াটি পড়তে হবে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাহনে উঠে যে দোয়া পড়তেন ।
"বিসমিল্লাহিল হামদুলিল্লাহি, সুবহানাল্লাযী সাখখারা লানা হাযা ওয়ামা কুন্না লাহু মুক্বরিনীনা, ওয়া ইন্না রাব্বিনা লামুন ক্বালিবুন" সীটে নিরবে বসে না থেকে তাসবীহ তাহলীল দোয়া দুরুদ পড়তে থাকুন । সাথে যদি কুরআন শরীফ থাকে তাহলে তিলাওয়াত করা উত্তম ।
প্রস্রাব, পায়খানা প্রয়োজন হলে প্লেন ছাড়ার পূর্বেই তা সেরে নেয়া ভালো । প্লেন আকাশে উড়া অবস্থায় টয়লেট ব্যবহার না করাই উত্তম । ইহরামের কাপড় নোংরা/ নষ্ট হবার ভয় থাকে । প্লেনে পানির পরিবর্তে টিস্যু পেপারের ব্যবস্থা থাকে । খুব জরুরী হলে সতর্কতার সাথে বাথরুম যেতে হবে । নামাযের ওয়াক্ত হলে কর্তৃপক্ষ তায়াম্মুম করার জন্য মাটির চাকা সরবরাহ করে থাকেন । তায়াম্মুম করে সীটে বসেই সফরকালীন কসর নামাজ আদায় করুন । কিবলা কোনদিকে জানা না থাকলে, জিজ্ঞাসা করে জেনে নিন । --(চলবে)-------
"শারঈ' মানদন্ডে
দোয়া-যিকির,হজ্জ ও উমরা" 

শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫

ঢাকা হজ্জ ক্যাম্পে করনীয়


ব্যালটি হাজী হলে হজ্জ অফিস থেকে প্রেরিত অনুমতিপত্রে নির্ধারিত যে তারিখ থাকবে, সে তারিখে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হজ্জ ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করবেন । নন-ব্যালটি বা বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় হজ্জযাত্রীগন এজেন্সীর পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী কার্যসমূহ করবেন । হজ্জ ক্যাম্পে রিপোর্ট করার সময় সরকারী ব্যবস্থাপনার ব্যালটি হাজীগন সাথে করে আনবেন অনুমতিপত্র, ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার ডুব্রলিকেট রশিদ সমূহ, মেডিকেল সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজপত্র । নন- ব্যালটি বা বেসরকারী ব্যবস্থাপনার হাজী সাহেবগন সংশ্লিস্ট এজেন্সীর পরামর্শ অনুযায়ী কাগজপত্র সাথে আনতে হবে । হজ্জ ক্যাম্পের ডরমেটরিতে শুধু হজ্জযাত্রীদের থাকার অনুমতি দেয়া হয় । তাই আত্মীয় স্বজন সাথে আসলেও তারা নিচ তলায় হজ্জযাত্রীকে নানাবিধ দাফতরিক কাজে সহযোগিতা করতে পারেন । হজ্জ ক্যাম্পে ধূমপান ও পান খাওয়া নিষেধ । প্রয়োজনীয় খাবার খেতে তিনটি ক্যান্টিনে ২৪ ঘণ্টা খোলা পাবেন । বাইরে থেকে খাবার আনার প্রয়োজন নেই । প্রয়োজনীয় সকল  কাগজপত্র ও বৈদেশিক মুদ্রা যথাযথভাবে সংরক্ষন করতে হবে । এগুলো হারিয়ে গেলে বা ত্রুটি থাকলে হজ্জে যাওয়া যাবে না । নিজের ব্যাগ বা লাগেজে নাম ঠিকানা, পাসপোর্ট ও মোবাইল নাম্বার লিখে লাগেজের গায়ে সেঁটে দেয়া যেতে পারে । ---(চলবে)-------

"শারঈ' মানদন্ডে

দোয়া-যিকির,হজ্জ ও উমরা"


গোলাম আজমের রুপরেখা বাস্তবায়ন হল বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, তিউনিশিয়ার পর তুরস্কেও


বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নন্দিত এবং নিন্দিত একটি নাম গোলাম আজম । আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাকে চিনি না । খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়নি । তবে তার লেখা অনেক বই পড়েছি । তার মেধার তুলনা তার বই । ছোটবেলা থেকেই আর নয় জন বাংলাদেশীর মত আমিও তাকে ঘৃণা করেই বড় হয়েছি হলুদ মিডিয়ার কল্যাণে । “আর নয়জন” বললাম এ কারনে দশজনের একজন তার বা তার আদর্শের পক্ষে ছিল । ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা “র” এর এক জরিপ ছিল এমন যে “শতকরা ২৫ জন জামায়াতের সমর্থক বাংলাদেশে” ২০০৯ এর পরে তাকে/তাদের সম্পর্কে জানার সুজুগ হয় আমার । এখনও কম বেশী জানার চেষ্টা করছি । আমি সব সময় বিতর্কিত মানুষকে পছন্দ করতাম যারা দেশ ব্যাপি বিশ্ব ব্যাপি বিতর্কিত এমন সব লোক । আমার লজিক পৃথিবীর সব বহুল বিতর্কিত ব্যক্তিরাই ছিল জ্ঞানী , স্বরণীয়, বরণীয় । সেটা হিটলার থেকে মুছোলিনী, চেঙ্গিস খান থেকে নেপোলিয়ান, শেখ মুজিব থেকে গোলাম আজম ।

আজকের বিষয় গোলাম আজম । মেধাবী চৌকস ও অভাবনীয় নেতৃত্বের গুণাবলীসম্পন্ন ক্ষণজন্মা মানুষটি ১৯২২ সালে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সম্পৃক্ত হন ছাত্র আন্দোলনের সাথে। ১৯৪৭-৪৮ ও ৪৮-৪৯ সালে পরপর দু’বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর জিএস (জেনারেল সেক্রেটারি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়ে পাকিস্তান সরকার দ্বারা কারা নির্যাতিত হন। এই মহান নেতা ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। শেখ মুজিব কর্তৃক ’৬৬ সালের ছয় দফা দাবি তৈরিতে অংশ নেয়া ২১ সদস্যের অন্যতম। 

১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৪ সালে যোগদান করেন জামায়াতে ইসলামীতে এবং প্রত্যক্ষভাবে শুরু করেন রাজনৈতিক জীবন। অখ- পাকিস্তানে ১৯৫৫ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। কপ (কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি) পিডিএম (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট) এর সেক্রেটারী জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। , ডাক (ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি) ইত্যাদি আন্দোলনে জনাব শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য সকল দলের নেতাদের সাথে অংশগ্রহণ করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক কারণে ১৯৬৪ সালেও তাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল ।

১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আসেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তাকে ২৭ নবেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সংবলিত একটি ঐতিহাসিক স্মারকলিপি প্রদান করা হয় যার নেতৃ্ত্ব দেন গোলাম আজম ।

তার ছোট্ট একটা বর্ণনা দিলাম এ কারনে তার সত্য সম্পর্কে আমরা খুব কম জেনেছি । ৯১ বছর বয়সে ৯০ বছর সাজা পাওয়া এ মানুষটি সম্পর্কে জানা উচিৎ আমাদের নতুন প্রজন্মের ।

৭১ এর মহান মুক্তিযু্দ্ধ নিয়ে তাকে সব চেয়ে বিতর্কিত হতে হয়েছে । যারা ৪৭ এর দেশ ভাগ দেখেছে । দেখেছে বিশাল ভারতের নোঙরামি । কিভাবে ছোট ছোট দেশ গুলোকে নপুংশুক এর মত গিলে খেতে (উদা: স্বাধীনদেশ "সিকিম") তাদের পক্ষে ৭১ এ সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন ছিল । ১৯৪ বছর ইংরেজদের কাছে পরাধীন থাকার পর যে মুসলিমরা আলাদা দেশ পেল সে দেশ আবার হাত ছাড়া হয়ে যাবে , ভাগ হয়ে যাবে । এটা মানতে পারছিল না তারা । যেমন মানতে পারছিল না সদ্য পাওয়া নতুন দেশ পাকিস্তানের সাশকদের অত্যাচার ও । ইন্দিরা গান্ধিরা যখন বার বার এ কথা বলে বেড়ােতা সভা সমাবেশে " মাথার এক পাশে ব্যাথা থাকলে বাঁচা জায় কিন্তু মাথার দুই পাশে ব্যাথা নিয়ে ঘুমানো মুশকিল" ভারতের দুই পাশে দুই মুসলিম দেশ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান কে উদ্ধেশ্য করে ছিল এমন বক্তব্য 

তার জানাজা নামাজের দিন গিয়েছিলাম, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত একজন মানুষের এমন শোক মিছিল দেখে আমার মত অবাক হয়েছিল এ দেশের সকল গনমাধ্যম, বিশ্বমিডিয়া । 

বহুল বিতর্কিত ছিল তার অভিযোগ । ট্রেয়াল দেয়া শাক্ষি । ৪৩ নাম্বার আসামির যদি ৯০ বছর সাজা হয় তা হলে বাকি ৪২ জনের নামও কেন জাতি জানেনা । নতুন প্রজন্মের কাছে আজীবন এটা কৌতুহল থেকে জাবে আ,লীগ সহ তার বিরোধীর কাছে । ২০১২ তে গোলাম আজম যুদ্ধাপরাধীর আসামি হলে । ৯৪ তে কিভাবে আ, লীগের কাছ থেকে মন্ত্রীর প্রস্তাব পাঠায় । কি ভাবে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আবদুস সাত্তার কে জায়নামাজ, তসবি দিয়ে কদমবুচি করতে পাঠায় খোদ দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা । আরো অসংখ প্রশ্ন হয়তো মাথায় আসবে নতুনদের । যার উত্তর হয়তো কেউই দিবে না ।

১৯৮০’র দশকে এবং ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে বিএনপি’র বিরুদ্ধে আন্দোলনে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ যুগপৎ আন্দোলন করেছিল । একটি সুষ্ঠ পদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য যখন কোন ফর্মুলাই কাজে আসছিলনা । তখন গোলাম আজম কেয়ারটেকার পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন । কিছুটা বিরোধীতা থাকলেও একটা পর্যায় সকলেই বলতে বাধ্য হন এর থেকে ভাল দ্বিতীয় কোন পথ নেই । দেশে বিদেশে উচ্ছসিত প্রসংশা পায় । যারা একটা সময় এক সাথে আন্দোলন করে কেয়ারটোকার পদ্ধতি চালু করলেন আবার সেই তারাই তাদের স্বার্থে সেটার বিলুপ্তি করে দেন । যার খেসারত আজো দিচ্ছে বাংলাদেশ । যে গণতন্ত্র উত্তরণে ৯০-এ তার কেযারটেকার পদ্ধতি জাতিকে দিয়েছিল মুক্তির দিশা । 

কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পথিকৃত মনে করা হয় বাংলাদেশকে। এ ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ এক সময় বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। 

আওয়ামী লীগ এ ব্যবস্থার জন্য কৃতিত্ব দাবি করলেও এই দলটিই আবার ব্যবস্থাটি বাতিল করে দিয়েছে, যার জের ধরে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

আওয়াম লীগ সরকার সংবিধান পরিবর্তন করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিলেও নেপাল, পাকিস্তা তিউনিশিয়া সহ বহু দেশই এখন এ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছে। সর্বশেষ এই তালিকায় যোগ হচ্ছে তুরস্কের নাম।

ড.মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর একটি লেখা পড়ছিলাম “যে দেশে গুণিদের কদর করতে জানেনা, সে দেশে গুণি জন্মে না” ড. শহিদু্ল্লাহ নেই তার কথা আছে । গোলাম আজম নেই তার দেখানো পদ্ধতিতে আজো সমাধান খুঁজে পায় বিশ্বের বিভিন্ন্ প্রান্তে । 

বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৫

ভেক্সিনেশন ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র

সৌদি সরকারের নির্দেশিত ভেক্সিনেশন বা টিকা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য অবশ্যই নিতে হবে এবং তার সার্টিফিকেট পাসপোর্টের সাথে থাকতে হবে । বাংলাদেশ থেকে যারা হজ্জ আদায়ের জন্য যান তাদের টিকার ব্যবস্থা হজ্জ এজেন্সীর পত্র নিয়ে জেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগাযোগ করলে ভেক্সিনেশন পাওয়া যাবে । কিন্তু বিদেশ থেকে যে সকল বাংলাদেশি হজ্জে যান তাদেরকে নিজ দায়িত্বে এ ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করতে হবে । এরপর সফরের জন্য আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে নিতে হবে । যেমনঃ
০১ । পুরুসদের জন্য দুই টুকরা সেলাইবিহীন সাদা সুতি কাপড় যেটা টাওয়েল জাতিয় হলে ভালো হয় । দুই সেট নিতে হবে ।
০২ । নামাজ আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক নেয়া যায় বা মক্কা মদীনা থেকে লম্বা জুব্বাও কিনে নেয়া যায় ।
০৩ । টুপি বা সৌদি রুমাল ।
০৪ । আন্ডারওয়ার, কিন্তু ইহরাম  অবস্থায় আন্ডারওয়ার পরা যাবে না ।
০৫ । সাধারন জুতা যা পুরুষ ও মহিলাগন নিবেন এবং দুই ফিতা ওয়ালা স্যান্ডেল ।
০৬ ।  কোমরের বেল্ট যা প্যান্ট বা ইহরামের কাপড়ের সাথে পরতে পারবেন ।
০৭ । ঘুমানোর জন্য লুঙ্গী বা পায়জামা, গেঞ্জি ।
০৮ । গোসলের জন্য টাওয়েল ছোট একটি ও বড় একটি এবং গামছা ।
০৯ । ঠান্ডার মৌসুম হলে প্রয়োজনীয় শীতের পোশাক ।
১০ । মহিলাদের বোরখা, সেলাওয়ার কামিজ, ওড়না হিজাব ।
১১ । বিছানার চাদর ও বালিশের কভার যদি প্রয়োজন মনে করেন ।
১২ । আরাফাত ও মুজদালিফায় অবস্থানের জন্য বাতাস দিয়ে ফুলানো বালিশ, জায়নামাজ, সানগ্লাস, কোমরে বাধার জন্য মানি বেল্ট, টাকা রাখার জন্য গলায় ঝুলানো ব্যাগ, এগুলো অবশ্য ওখান থেকেও কেনা যায়, এজেন্সীও দিয়ে থাকে ।
১৩ । ছাতা, হাত ঘড়ি, খাবার প্লেট-গ্লাস, নেইল কাটার, কাপড় ধোয়া ও গায়ে মাখা সাবান, পিঠে ঝুলানো ব্যাগ । 
টুথ পিক, টয়লেট ও ফেসিয়াল টিস্যু পেপার, মোবাইল ফোন, ছোট টর্চ লাইট, লোশন বা শরীরে মাখার জন্য তেল, মুখে মাখার ক্রীম, ভ্যাজলিন, পাউডার, ছোট একটা কেচি, শেভ যারা করেন তারা প্রয়োজনীয় উপকরন নিবেন ।

আপনার প্রেসক্রিপশন সহ নিয়মিত সেবনের প্রয়োজনীয় ঔষধ ছাড়াও আমাশা, ডাইরিয়া, সর্দি কাশি জ্বর অ্যালার্জি ইত্যাদীর জন্য কিছু ঔষধ নিতে পারেন । আলাদা একটি ছোট ব্যাগের মধ্যে একটি নোট বুকে প্রয়োজনীয় দেশী বিদেশী ফোন নাম্বার নিন । পাসপোর্ট, অর্থ, ভ্রমনের সকল কাগজপত্র ইত্যাদী দুই সেট ফটোকপি যথাযথভাবে সংরক্ষন করুন  এবং এগুলোর ব্যাপারে সব সময় সচেতন থাকুন । ---(চলবে)-------

"শারঈ' মানদন্ডে
দোয়া-যিকির,হজ্জ ও উমরা"

বুধবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৫

একান্ত প্রয়োজনীয় বিষয় পূর্বেই জেনে নিন



আপনি যে ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ্জ এজেন্সীর মাধ্যমে হজ্জে যাচ্ছেন সেখান থেকে পূর্বেই কিছু বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হন । যেমনঃ
০১ ।  আপনার ভিসা এবং বিমানের টিকিট যথাযথভাবে হলো কিনা ?
০২ । আপনাকে যে বাসা বা হোটেলে রাখা হবে, সেটা মান সম্পন্ন কিনা ?
০৩ । সে বাসা বা হোটেল পাহাড়ের উপরে কিনা ?
০৪ । মক্কা এবং মদীনার মুল মসজিদ থেকে থাকার অবস্থান কতোদুরে ?
০৫ । আপনার তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা হবে কিনা ?
০৬ । মিনায় থাকা এবং খাবার ব্যবস্থা করা হবে কিনা ?
০৭ । মিনা থেকে মক্কায় আসা যাওয়ার ব্যবস্থা কি ভাবে করা হবে ?
০৮ । জেদ্দা, মক্কা এবং মদীনায় আসা যাওয়ার ব্যবস্থা কিভাবে করা হবে ?
০৯ । পবিত্র মক্কা এবং মদীনার ঐতিহাসিক স্থান সমূহ পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হবে কিনা ?
১০ ।  কুরবানীর কি ব্যবস্থা করা হবে এবং কতো টাকা প্রয়োজন হবে ?  ---(চলবে)-------

"শারঈ' মানদন্ডে
দোয়া-যিকির,হজ্জ ও উমরা"

মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৫

বাংলাদেশ থেকে হজ্জের সফর

বাংলাদেশ থেকে দুইভাবে হজ্জের সফর সম্পন্ন করতে পারেন । সরকারী ব্যবস্থাপনায় ও প্রাইভেট হজ্জ এজেন্সীর মাধ্যমে । সরকারী ব্যবস্থাপনার আওতায় দুইটি ক্যাটাগরি রয়েছে যেমন সবুজ এবং নীল । এ দুইটির যে কোন একটির আওতাভুক্ত হয়ে হজ্জের সফর সম্পন্ন করতে পারেন । থাকার ব্যবস্থা অর্থাৎ বাসা বা হোটেলে কাছে দূরে, উন্নত অনুন্নত হওয়ার উপর ভিত্তি করেই সবুজ এবং নীল ক্যাটাগরি নির্ণয় করা হয় । কারন অন্যান্য খরচ উভয় ক্যাটাগরির ক্ষেত্রে অভিন্ন । আপনি সরকারী ব্যবস্থাপনায় হজ্জে গমন বিষয়ে মনস্থির করলে সরকারের ধর্ম মন্ত্রনালয়ের বেধে দেয়া সময় ও নিয়ম অনুযায়ী টাকা জমা দিন । ধর্ম মন্ত্রনালয় কর্তৃক সরবরাহকৃত ফরম পুরন করে যে কোন অনুমোদিত ব্যাংকে অর্থ জমা দিয়ে প্রদত্ত রশিদ নিয়ে জেলা প্রশাসকের অফিসে রিপোর্ট করুন । টাকা জমা দেয়ার রশিদ ও অন্যান্য কাগজপত্র রাখতে হবে যত্ন সহকারে ও তা দেখিয়ে অফিস থেকে বলে দেয়া সময়ে উপস্থিত হয়ে বিমানের টিকিট ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে । আপনার জমা দেয়া টাকা যে সব খাতে ব্যায় করা হবে তা হলোঃ

১ ।  বিমান ভাড়া,  ২ ।   এম্বারকেশন ফী, ৩ ।  ভ্রমন কর, ৪ ।  ইন্স্যুরেন্স ও সারচার্জ, ব্যাজ, কার্ড, পুস্তিকা, কব্জি বেল্ট, ব্যাগ, আইটি সার্ভিস, ইত্যাদী  ৫ ।  মুয়াল্লীম, সৌদি আরবের হজ্জ কন্ট্রাকটর ফী,  ৬ ।  মক্কা মদীনা শরীফের বাড়ি ভাড়া,  ৭ ।  সৌদি আরবে অবস্থানকালে খাওয়া ।
বেসরকারী ব্যবস্থাপনার আওতায় এ + এ, বি, সি ইত্যাদী ক্যাটাগরি রয়েছে । আপনার শক্তি সামর্থ অনুযায়ী ক্যাটাগরি নির্বাচন করুন । যেসব হজ্জ এজেন্সীর সুনাম, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও সরকারের অনুমোদন রয়েছে সেগুলো মধ্যে
কোনো একটি অনুসন্ধান করে বের করে নিন । তাদের নির্ধারিত টাকা চুক্তি অনুসারে পরিশোধ করুন । যথাযথ রশিদ ব্যতিত শুধু মৌখিক কথার উপর টাকা দিবেন না । খরচের হিসাব ও সুযোগ সুবিধা কেমন পাবেন এ সম্পর্কে লিখিত চুক্তি করুন । যদিও এজেন্সী কর্তৃক বলে দেয়া সুবিধাসমুহ থেকে বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা নেই তবুও লিখিত চুক্তি করুন । সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নয় এমন এজেন্সী বা কাফেলাকে টাকা দিবেন না । ---(চলবে)-------
"শারঈ' মানদন্ডে
দোয়া-যিকির,হজ্জ ও উমরা"

শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৫

শহীদ আবদুল মালেক একটি নাম


শহীদ আবদুল মালেক ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও বীর সেনানী। শহীদ আবদুল মালেক একটি নাম, একটি প্রেরণা, একটি বিশ্বাস, একটি আন্দোলন, একটি ইতিহাস, একটি মাইলস্টোন। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে ১৯৬৯ সালে ইসলামী শিক্ষার পক্ষে কথা বলতে গিয়েই ঢাকায় ইসলামবিদ্বেষী সেকুলারপন্থীদের হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ১৫ আগস্ট শাহাদত বরণ করেন ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক শহীদ আবদুল মালেক। শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের শাহাদতের তাৎপর্য ছাত্রসমাজের কাছে তুলে ধরা এবং তাঁর আত্মত্যাগ থেকে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের অনুপ্রাণিত করার নিমিত্তে ইসলামী ছাত্রশিবির এ দিনটিকে ‘ইসলামী শিক্ষা দিবস’ হিসেবে প্রতি বছর পালন করা আসছে।

শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদতের প্রেক্ষাপট ও ঘটনাঃ
১৯৬৯ সালে পাকিস্তানজুড়ে ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান দেখা দেয়। ফলে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতার মঞ্চে আরোহণ করেন। এরই এক পর্যায়ে এয়ার মার্শাল নূর খানের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দেখা দেয়। ছাত্রসমাজের একটি অংশ ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের দাবি তুলে। শহীদ আবদুল মালেকসহ ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল এয়ার মার্শাল নূর খানের সাথে সাক্ষাৎ করে দেশে সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালুর দাবি করেন। শহীদ আবদুল মালেকের প্রতিনিধিদলের পর দেশের অন্যান্য আরো সংগঠন একই দাবি তুলে। সবার দাবির মুখে অল্প কিছুদিনের মধ্যে সরকার নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এটি ছিল পাকিস্তান আমলের গঠিত সর্বশেষ শিক্ষা কমিশন। গঠিত শিক্ষা কমিশন একটি শিক্ষানীতিও ঘোষণা করে, ঘোষিত শিক্ষানীতিতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও এতে ইসলামী আদর্শের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু আপত্তি তোলে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধ্বজাধারীরা। তারা এ শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি জানায়। এমনই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তি কী হবে তা নিয়ে জনমত জরিপের আয়োজন করা হয়।

জনমত জরিপের অংশ হিসেবে ১৯৬৯ সালের ২ আগস্ট “National Institute of Public Administration” (NIPA) এর উদ্যোগে সরকারের পক্ষ থেকে ‘শিক্ষার আদর্শিক ভিত্তি’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে। ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন আবদুুল মালেক সেই আলোচনায় অংশগ্রহণ করে মাত্র পাঁচ মিনিটের বক্তব্যে বামপন্থী সকল ছাত্রসংগঠনের সকল যুক্তিকে হার মানিয়ে উপস্থিত সবার চিন্তার রাজ্যে এক বিপ্লবী ঝড় সৃষ্টি করে ইসলামী শিক্ষার পক্ষে জনমত সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। ফলে সভার মোটিভ পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ইসলামী শিক্ষার পক্ষে মতামত প্রকাশ করায় সেকুলার মহল মরিয়া হয়ে ওঠে। ছাত্রদের এ মতামতকে বানচাল করার জন্য পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে ডাকসু কর্তৃক ১২ আগস্ট আরো একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এর মূল আয়োজক ছিলেন বামপন্থী শিক্ষকরা। তারা সেখানে আবদুল মালেককে অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আবদুল মালেক তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে টিএসসির আলোচনা সভাস্থলেই তার প্রতিবাদ করেন। এই প্রতিবাদ সংঘর্ষে রূপ লাভ করে। সংঘর্ষ এক পর্যায়ে থেমে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে আবদুল মালেক ও তার কতিপয় সঙ্গীকে টিএসসির মোড়ে সেকুলারপন্থীরা হামলা করে এবং রেসকোর্সে এনে তার মাথার নিচে ইট দিয়ে ওপরে ইট ও লোহার রড দিয়ে আঘাত করে মারাত্মকভাবে জখম করে এবং অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে চলে যায়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে এ পরিকল্পিত হামলার নেতৃত্ব দান করে। আবদুল মালেক ভাইকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু তার আঘাত এতটাই মারাত্মক ছিল যে, ১৫ আগস্ট তিনি শাহাদত বরণ করেন।

ইসলামী শিক্ষার পক্ষে শহীদ আবদুল মালেকের অবস্থানের যৌক্তিকতাঃ
শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে একটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত করার প্রধান সোপান, জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি, জাতীয় ঐক্যের প্রতীক, জনগণের মধ্যে চিন্তা ও কর্মের বিভাজন দূরীকরণের সহায়ক শক্তি এবং জাতীয় মিশন ও ভিশন বাস্তবায়নের রূপকার। জনগণের সকল প্রকার আর্থ-সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের উদ্দীপক ও প্রেরণাদানকারী শক্তি হিসেবেও কাজ করে শিক্ষাব্যবস্থা। শুধু তাই নয়, জনগণকে তার সর্বোচ্চ ধর্মীয় চেতনায় উদ্দীপ্ত করণে শিক্ষাব্যবস্থার অপরিসীম ভূমিকা থাকে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপনে শিক্ষাব্যবস্থা অদম্য প্রত্যয় সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে শক্তি জোগায়। মূলত শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে একটি দেশের গোটা জাতীয় সত্তার কাঠামো। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত না হওয়ায় আমাদের জাতীয় জীবনে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট আদর্শিক শূন্যতা, নৈতিক দুর্বলতা, ব্যক্তিত্বের মধ্যে বিভাজন, আগামী প্রজন্মের মধ্যে হতাশা, জাতীয় উন্নতিতে স্থবিরতা, জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা ইত্যাদি ইত্যাদি। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে এবং ভবিষ্যতে এর সুদূরপ্রসারী আরো নেতিবাচক প্রভাবের কথা চিন্তা করে দেশের সামগ্রিক স্বার্থে সেদিন শহীদ আবদুল মালেক ইসলামী শিক্ষার পক্ষে তার যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
ইসলামী শিক্ষার সুদূরপ্রসারী প্রভাব
শিক্ষাকে বলা হয় একটি জাতির মেরুদন্ড, যা জাতিকে খাড়া রাখে কিংবা পড়ন্ত অবস্থা থেকে উঠিয়ে দাঁড় করায়। এটা তখনই সম্ভব হয় যখন ঐ জাতির শিক্ষাব্যবস্থা হয় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশিত পথ ও পদ্ধতি অনুযায়ী। মিশরীয় দার্শনিক Professor Muhammad Kutub Zuvi ÒThe Concept of Islamic Education” প্রবন্ধে বলেছেন, “শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামের কাজ হলো পরিপূর্ণ মানবসত্তাকে লালন করা, গড়ে তোলা এমন একটি কর্মসূচি যা মানুষের দেহ, তার বুদ্ধিবৃত্তি এবং আত্মা, তার বস্তুগত ও আত্মিক জীবন এবং পার্থিব জীবনের প্রতিটি কার্যকলাপের একটিকেও পরিত্যাগ করে না, আর কোন একটির প্রতি অবহেলাও প্রদর্শন করে না।”
ইসলামী শিক্ষার ভিত্তি হলো তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাত। যা সর্বস্তরে উচ্চ নৈতিকতাসম্পন্ন, নির্লোভ, সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক মানুষ তৈরি করে। মানুষের হাত-পা, মনন ও মস্তিষ্ক সবকিছুকে আল্লাহর অনুগত বানিয়ে থাকে। মানুষের ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনকে আল্লাহর রঙে রঞ্জিত করে। ফলে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে শয়তানের বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধ চলে। কেননা শয়তান সর্বদা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়। এমতাবস্থায় ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি শয়তানের যাবতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সর্বদা পৃথিবীকে সুন্দরভাবে আবাদ করতে চায়। ফলে পৃথিবীর জীবনপদ্ধতি অনেক সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়।

অপর দিকে শিক্ষাব্যবস্থা যদি এর বিপরীত হয়, তাহলে ঘুণে ধরা বাঁশের মত জাতির মেরুদন্ড ভেঙে পড়ে। আজকের পৃথিবীতে বড় বড় অশান্তির মূল কারণ হলো অনকে ক্ষেত্রেই শিক্ষিত নেতৃবৃন্দ। যাদের শিক্ষায় আল্লাহভীরুতা নেই, আখেরাতে জবাবদিহিতা নেই, রয়েছে দুনিয়াসর্বস্বতা। ফলে শিক্ষিত মানুষগুলোর মধ্যে মানবীয় গুণাবলির বিপরীতে দানবীয় গুণাবলি সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার কোন ঘাটতি না থাকলেও, সততা ও নৈতিকতার দিক থেকে তাদের অবস্থান অনেকটাই শূন্যের কোটায়। এই শ্রেণীর মানুষগুলোই দুনিয়াতে ভদ্রবেশে সকল প্রকার শয়তানি অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। একটি দেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করতে কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক একক ও পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালুর বিকল্প নেই। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের কোন সরকারের জন্য তা অপরিহার্যও বটে।
শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদতের প্রভাব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সম্ভবত আবদুল মালেক ভাইয়ের মত মেধাবী ছাত্র নেতার শাহাদত এর আগে ঘটেনি। ফলে আবদুল মালেক ভাইয়ের শাহাদতে গোটা দেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। সর্বমহলে এই ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে আসে। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের বিদায়ে কেঁদেছে গোটা জাতি। দলমত নির্বিশেষে সবাই এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সে সময়ের সংবাদপত্র তার সাক্ষী। আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সভাপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানও বিবৃতি দিয়ে ঘটনার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিভাবান ছাত্রনেতা আবদুল মালেকের শাহাদতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও সকল জাতীয় নেতারা নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছিলেন। এ থেকেই বুঝা যায়, শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদত কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

শহীদ আবদুল মালেকের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। আওলাদে রাসূল সা: সাইয়েদ মোস্তফা আল মাদানী জানাজার ইমামতি করেন। জানাজার আগে আবেগাপ্লুতকণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, “শহীদ আবদুল মালেকের পরিবর্তে আল্লাহ যদি আমাকে শহীদ করতেন তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম। বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী রহ. তার শোকবাণীতে মন্তব্য করেন, “এক মালেকের রক্ত থেকে লক্ষ মালেক জন্ম নেবে।” তার এ মন্তব্য অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছিল।
সাবেক আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম আবদুল মালেক ভাইয়ের শাহাদতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন, “আবদুল মালেকের মতো একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব শহীদ হবার ফলে গোটা আন্দোলনের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি না হলে এতটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতো না। আবদুল মালেকের শাহাদত আর পরবর্তী শাহাদতের তুলনা করলে এটাই দেখি একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির শাহাদতের ফলে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, ঐ ধরনের প্রতিক্রিয়া পরবর্তীদের ক্ষেত্রে হয়নি। আন্দোলন যখন শক্তি সঞ্চয় করেছে মাত্র তখন একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির শাহাদত আন্দোলনের শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।” তিনি আরো লিখেছেন, “আবদুল মালেক জীবিত থেকে এই আন্দোলনের জন্য যে অবদান রাখতে পারতেন শহীদ হয়ে যেন তার চাইতে বেশি অবদান রেখে গেলেন। তা এ শাহাদতের প্রেরণায় আন্দোলন যতদূর অগ্রসর হয়েছে, যত লোকের মধ্যে শাহাদতের জযবা সৃষ্টি হয়েছে তার মতো যোগ্য কর্মী বেঁচে থাকলেও তিনি যতো যোগ্যই হোন না কেন তার একার জীবনে এতো বড় প্রভাব এবং আন্দোলনে এতটা গতি দিতে পারতেন কিনা সন্দেহ।” শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদতের সংবাদ শুনে সেদিন বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রহ. বলেছিলেন, ‘‘আবদুল মালেক এ দেশের ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ তবে শেষ নয়।”

আবদুল মালেক ভাইকে শহীদ করার মাধ্যমে সেদিন সেকুলারপন্থীরা ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের পক্ষে আওয়াজ তোলাকে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল কিন্তু তাদের সে পরিকল্পনা সাময়িক বাস্তবায়িত হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী তাদের জন্য বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যে কোন আন্দোলনের কোন ব্যক্তিত্ব বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য কোন ব্যক্তি যখন শহীদ হন তখন সে আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়া সম্ভব হয় না বরং উল্টো সে আন্দোলনের তীব্রতা বেড়ে যায় এবং আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে যারা ভীরু এবং কাপুরুষ তারা পিছিয়ে যায়। আর যারা এ আন্দোলনকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করে এবং ইসলামী আন্দোলনের স্পিরিটকে যারা বুঝে আগের চাইতে তারা আরো দ্রুত এগিয়ে যায়। তা ছাড়া এ অবস্থায় আন্দোলনে নতুন নতুন লোকও এগিয়ে আসে। বাস্তবে এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। এক আবদুল মালেককে শহীদ করে শত্রুরা শত শত আবদুল মালেক সাপ্লাই করেছে আন্দোলনে। এক আবদুল মালেকের শাহাদতের ফলে আন্দোলন শত শত আবদুল মালেককে পেয়েছে যারা তার মতো মনে-প্রাণে শাহাদত কামনা করে। এটা যে কোন আন্দোলনের জন্য সত্য আর ইসলামী আন্দোলনের জন্য বেশি সত্য। শহীদ আবদুল মালেককে হত্যা করে ইসলামী আদর্শকে স্তব্ধ করা যায়নি। বরং এক মালেকের রক্ত বাংলার ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে ছড়িয়ে একটি আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। লক্ষ-কোটি মালেক আজ একই আদর্শের ছায়াতলে সমবেত।
 “প্রেরণায় ভাস্বর এক কিংবদন্তি
শহীদ আবদুল মালেক”

একজন মানুষ এ ভুবনে স্ব-মহিমায়, জ্ঞানে, ধ্যানে, চিন্তা-চেতনায় কত উজ্জ্বল ভাস্বর হতে পারেন শহীদ আবদুল মালেক তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবেন অনাগত পৃথিবীর কাছে। শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের ব্যক্তিগত জীবন, ছাত্রজীবন, সাংগঠনিক জীবন, তাঁর লেখনী, চিঠিপত্রের আদান-প্রদান, দায়িত্বশীলদের সাথে মেলামেশা, সহপাঠী ও বন্ধুদের প্রকাশিত লেখার মাধ্যমে যতটুকু জানার সুযোগ হয়েছে তাতে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, শহীদ আবদুল মালেক হচ্ছেন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য প্রেরণায় ভাস্বর এক কিংবদন্তি, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য এক অনুপম আদর্শ। তাইতো শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের শাহাদতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাবেক আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম লিখেছেন, “শহীদ আবদুল মালেক তরুণ বয়সেই এমন এক উজ্জ্বল নজির রেখে গেছেন যা এদেশে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে চিরদিন প্রেরণা জোগাবে। এতগুলো গুণ একজন ছাত্রের মধ্যে এক সাথে থাকা অত্যন্ত বিরল। একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষক ও ছাত্রমহলে তার সুখ্যাতি সত্ত্বেও তার নিকট ছাত্রজীবন থেকে আন্দোলনের জীবনই বেশি প্রিয় ছিল। যথাসম্ভব নিয়মিত ক্লাসে হাজির হওয়াই যেন তার জন্য যথেষ্ট ছিল। পরীক্ষায় ভালো করার জন্য তার মধ্যে কোনো ব্যস্ততা ছিল না। ওটা যেন অতি সহজ ব্যাপার ছিল। ক্লাসের বাইরে তাঁকে ইসলামী আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো চিন্তাধারা বা আলাপ-আলোচনা করতে বড় একটা দেখা যেত না। তার সহপাঠী ও সহকর্মীরা তাকে পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করার দিকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিলে মৃদু হেসে বলতেন, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ডিগ্রি নিতে হবে যাতে আয়-রোজগারের একটা পথ হয়। কিন্তু ওটাকে জীবনের চরম লক্ষ্য বানিয়ে নিতে চাই না। খুব ভালো রেজাল্টের ধান্ধা করলে ক্যারিয়ার গড়ে তুলবার নেশায় পেয়ে বসবার আশঙ্কা আছে।

ইসলামী আন্দোলনের বর্তমান প্রজন্মের কর্মীদের অনুপ্রেরণার জন্য শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের জীবনের কিছু খন্ডচিত্র নিম্নে উপস্থাপন করা হলো :

১. অদম্য মেধাঃ
বাড়ির পাশের খোকসাবাড়ির প্রাইমারি স্কুল থেকে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। আবদুল জলিল সাহেব ছিলেন খোকশাবাড়ি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় শিশু আবদুল মালেককে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। সব কটি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে তিনি এতই অভিভূত হলেন যে আবদুল মালেককে তিনি সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে নিলেন। বাড়ি থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে গোসাইবাড়ি হাইস্কুল। এলাকার মধ্যে এ স্কুলটির বেশ সুনাম থাকায় শিশু আবদুল মালেক সে স্কুলে পড়ার আগ্রহ পোষণ করেন। অতঃপর চতুর্থ শ্রেণীতে তাকে সে স্কুলে ভর্তি করা হলো। ১৯৬০ সালে আবদুল মালেক জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। আবদুল মালেক চাচ্ছিলেন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিতে। কিন্তু গোসাইবাড়ি হাইস্কুলে তখনও বিজ্ঞান বিভাগ ছিল না। আবদুুল মালেকের প্রত্যাশা অনুযায়ী তাকে বগুড়া জেলা স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি করা হলো। সেখান থেকে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে মেধাতালিকায় ত্রয়োদশ স্থান অর্জন করেন। এ সময় তার পিতা ইন্তেকাল করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন রাজশাহী সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে। সেখানেও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে মেধাতালিকায় চতুর্থ স্থান অধিকারের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে ভর্তি হন এবং ডিপার্টমেন্টের মেধাবী ছাত্র হিসেবে প্রথম স্থান অধিকার করেন। স্কুলজীবন থেকে শহীদ আবদুল মালেক মৌলভী মহিউদ্দিন সাহেবের মাধ্যমে ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর খুব দ্রুত সংগঠনে এগিয়ে এসে সর্বোচ্চ মান সদস্যে উন্নীত হন। একপর্যায়ে ঢাকা মহানগরী এবং নিখিল পাকিস্তান ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মজলিস-উশ-শূরার সদস্য নির্বাচিত হন।

২. সাদাসিধে জীবনযাপনঃ
শহীদ আবদুল মালেক অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। পোশাক বলতে ছিল একটি কমদামি সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবি যাতে ইস্ত্রির দাগ কেউ কখনো দেখেছে বলে জানা যায় না। রাতের বেলায় নিজ হাতে তিনি তা পরিষ্কার করতেন। যেন পরের দিনের সূচনায় তা আবার পরা যায়। অনেকের মত নূর মুহাম্মদ মল্লিকও লিখেছেন, “সারাদিন কাজ করে রাতের বেলায় তাঁর নিজের হাতে ক্লান্ত শরীরে সেই একমাত্র পাজামা পাঞ্জাবি ধোয়া রুটিন কাজের কথা। কোন এক রাতে সেটি ধোয়া সম্ভব হয়নি বলে সকালে ধোয়া পাঞ্জাবি আধা ভেজা অবস্থায় গায়ে জড়িয়ে মালেক ভাই গিয়েছিলেন মজলিসে শূরার বৈঠকে যোগ দিতে। মালেক ভাইয়ের পোশাক যেমন সাদাসিধে ছিল, দিলটাও তেমন সাদাসিধে শুভ্র মুক্তার মত ছিল। প্রাণখোলা ব্যবহার তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
শহীদ আবদুল মালেক ভাই সম্পর্কে তাঁর এক হলমেট লিখেছেন, শহীদ আবদুল মালেকের পোশাকাদি ও স্যান্ডেল দেখে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে কেউ তাঁকে টহফবৎবংঃরসধঃব করতে পারতো। কিন্তু তার সাথে কথা বলার স্কোপ হলে ৫ মিনিটের মধ্যে এই ভুল বিশ্বাস অবশ্যই ভেঙে যেতে বাধ্য হতো।
শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের সহকর্মী আবু শহীদ মোহাম্মদ রুহুল সাক্ষাৎকারে আবদুল মালেক ভাই সম্পর্কে বলেছেন- “একদা আমরা একসাথে চকবাজারে কালেকশনে যাই। তখন তাঁর অতি সাধারণ ইস্ত্রিবিহীন পাঞ্জাবি-পায়জামা এবং চপ্পল দেখে এক সুধী মালেক ভাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয় বলে মনে করেন। এতে সহকর্মীরা ক্ষুব্ধ হলে মালেক ভাই আমাদেরকে এ বলে সান্ত¡না দেন যে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কি না তা আল্লাহই ভালো জানেন। আমি আমার জন্য যে মানের পোশাক প্রয়োজন মনে করেছি সে মানের পোশাকই পরিধান করেছি। কে আমার পোশাক দেখে কী ভাবল তাতে আমার কোন ভাবনা নেই।”
শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের সাথে মারাত্মক আহত হওয়া মাওলানা মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী শহীদ আবদুল মালেক ভাই সম্পর্কে সাক্ষাৎকারে বলেন, মালেক ভাই খুব সাদাসিধে থাকতেন। অনেক সময় পাজামা-পাঞ্জাবির সাথে ইংলিশ সু পরতেন। আমরা বলতাম, মালেক ভাই এটাতো মিলল না। উনি বলতেন, এত কিছু দেখার সময় আছে নাকি? মালেক ভাই প্রায়ই বলতেন, পড়াশুনা করে শুধু বড় ডিগ্রি নিয়ে কি লাভ যদি আল্লাহর কাছে ক্ষমা না পাওয়া যায়। ডিগ্রি তো নেয়া শুধু বাঁচার তাকিদে।

৩. সংগ্রামী জীবনঃ
ইসলামী নেতৃত্ব সংগ্রাম, সংঘাত ও কঠিন অগ্নি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। শহীদ আবদুল মালেক তাঁর সংগ্রামী জীবনের পদে পদে সেই পরীক্ষাই দিয়ে গেছেন। সারাটা জীবন কষ্ট করেছেন। আর্থিকভাবে খুবই অসচ্ছল একটি পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। তাই জীবনযাপনের অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ থেকেও তিনি ছিলেন বঞ্চিত। সেই কচি বয়সে যখন তাঁর মায়ের কোলে থাকার কথা, তিনি থেকেছেন বাড়ি থেকে অনেক দূরে লজিং বাড়িতে। দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে হয়েছে তাকে। ক্ষুধার যন্ত্রণা, অমানুষিক পরিশ্রম কিংবা দুঃখ-কষ্টের দিনযাপন কোন কিছুই পিচ্ছিল করতে পারেনি তাঁর চলার পথ। সামান্য বৃত্তির টাকা সম্বল করে নিজের জীবন এবং বিধবা মায়ের সংসার চালাতে হতো তাকে। জনাব নূর মোহাম্মদ মল্লিক এক সময়ে কোন এক কারণে বেশ কিছু দিনের জন্য মালেক ভাইয়ের মেহমান হয়ে ছিলেন। তাকে মেহমানদারি করতে গিয়ে নীরবে নিভৃতে শহীদ আবদুল মালেক কিভাবে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটিয়েছেন তার চোখ ভেজানো বর্ণনা দিয়েছেন তিনি তার ‘চিরভাস্বর একটি নাম’ শীর্ষক স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে : “স্কলারশিপের টাকায় তাঁর সবকিছু চলতো। কিছু টাকা মায়ের কাছেও পাঠাতেন। বাকি টাকা খাওয়া-পরা ও আন্দোলনের জন্য খরচ করতেন। বেশ কয়েকদিন থাকার পর আমি লক্ষ্য করলাম মালেক ভাই ডাইনিং হলে খাচ্ছেন না। মনে করলাম মজলিশে শূরার বৈঠকের জন্য হয়তো তাঁদের সকলে একসঙ্গে খান সময় বাঁচানোর জন্য। শূরার বৈঠক শেষ হলো। এরপরও তাকে দেখি না। এরপর একদিন দেখলাম তিনি রুটি খাচ্ছেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে বললেন, শরীর খারাপ। আমার সন্দেহ হলো, আমার জন্যই বোধ হয় তাকে কষ্ট করতে হচ্ছে। সামান্য ক’টি টাকাতে হয়তো তিনি কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না এবং এ জন্য বিশেষ করে আমার ভার বহনের জন্যই তাকে অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে হচ্ছে বুঝতে পেরে তাঁর কাছ থেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম।’’

৪. জ্ঞানপিপাসুঃ
শহীদ আবদুল মালেক ছিলেন অসম্ভব জ্ঞানপিপাসু। জানতে হলে পড়তে হয়। অধ্যয়নের কোনো বিকল্প নেই। শহীদ আবদুল মালেক এ বিষয়ে আমাদের সকলের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। আন্দোলনী কর্মকান্ডের শত ব্যস্ততা মালেক ভাইয়ের জ্ঞানার্জনের পথে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এমনকি আর্থিক সঙ্কট সত্ত্বেও তিনি নাশতার পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনতেন, সংগঠনের এয়ানত দিতেন। অথচ তাঁর রেখে যাওয়া এই দেশের ইসলামী আন্দোলনের অধিকাংশ নেতা-কর্মীই এক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে অনেকটা পিছিয়ে আছেন।
শ্রদ্ধেয় কৃতী শিক্ষাবিদ ড. কাজী দীন মুহম্মদের স্মৃতিচারণ থেকে আমরা জানতে পারি, শত ব্যস্ততার মাঝেও জ্ঞানপিপাসু আবদুল মালেক দীন মুহম্মদ স্যারের কাছে মাঝে মধ্যেই ছুটে যেতেন জ্ঞানের অন্বেষায়। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ইসলামী আন্দোলন করতে হলে কুরআন-হাদিস, অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং-বীমা, সমাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় জানতে হয় কিংবা জ্ঞান থাকতে হয়।
মরহুম আব্বাস আলী খান এ প্রসঙ্গে এক স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে বলেন : “বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর পাকা হাতের লেখা পড়তাম মাসিক পৃথিবীতে। বয়স তখন তাঁর উনিশ-বিশ বছর। একেবারে নওজোয়ান। কিন্তু তার লেখার ভাষা ও ভঙ্গি বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর তীক্ষè ও গভীর জ্ঞান তাঁর প্রতি এক আকর্ষণ সৃষ্টি করে।”
শহীদ মোহাম্মদ কামারুজ্জমান আবদুল মালেক ভাই সম্পর্কে লিখেছেন- “রাতে ঘুমানোর আগে দেখতাম মালেক ভাই ইংরেজি একটি ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছেন। আবার কিছু কিছু নোট করছেন। তিনি মাসিক পৃথিবীতে চলমান বিশ্ব পরিস্থিতির ওপর লিখতেন। বুঝলাম সেই লেখার জন্য মালেক ভাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তখন থেকেই বিদেশী ম্যাগাজিন পড়ার ব্যাপারে আমার মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। মালেক ভাইয়ের অনেক স্মৃতি আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।”
শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের হলম্যাট ড. এ জামান আবদুল মালেক ভাইকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণমূলক লেখায় লিখেছেন, “শহীদ আবদুল মালেকের বৃত্তির একটা বড় অংশ ব্যয় হতো বই কেনার পেছনে। ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইসলামী আন্দোলন সংক্রান্ত বহুবিধ পুস্তক তাঁর ব্যক্তিগত পাঠাগারে সংগৃহীত ছিল।

৫. আন্দোলনের কর্মীদের সাথে আচরণঃ
শহীদ আবদুল মালেক প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন তাঁর কর্মীদের। সে ভালোবাসা ছিল নিখাদ নিঃস্বার্থ। তাঁর জীবনালেখ্য রচয়িতা ইবনে মাসুম লিখেছেন : “কর্মীদের তিনি ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন তাদের দুঃখ-বেদনার সাথী। তাঁর এই আন্তরিকতার জন্য অনেক কর্মীর কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবকের মত। কর্মীদের সাথে দেখা হলেই কুশল আলাপ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে তাঁর রুম ছিল কর্মীদের জন্য তীর্থস্থান। কর্মীদের সাথে আন্তরিকতার সাথে মিশে জেনে নিতেন তার দুঃখ-বেদনা, তার দুর্বলতা, যোগ্যতা সবকিছু। দুঃখে জানাতেন সহানুভূতি। দুর্বলতাকে ইঙ্গিত করে উপদেশ দিতেন তা শুধরে নিতে। সাধারণ কর্মীদের অত্যন্ত কাছাকাছি ছিল তাঁর অবস্থান। সকলের সমস্যা শুনতেন অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে, অনুভব করতেন নিজের মতো করে এবং সমাধান দিতেন একান্ত আপনজন হিসেবে। কর্মীর যোগ্যতাকে সামনে রেখে উপদেশ দিতেন, অনুপ্রেরণা জোগাতেন প্রতিভা বিকাশে। ভাবতে অবাক লাগে, প্রতিটি কর্মী সম্পর্কে তিনি নোট রাখতেন। প্রতিটি কর্মীর ব্যাপারে নিজের ধারণা লেখা থাকতো তাঁর ডায়েরিতে। এমনিভাবে ভাবতেন তিনি কর্মীদের নিয়ে। ফলে কর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় মালেক ভাই, একজন অভিভাবক, একজন নেতা।”

৬. আন্দোলনের প্রতি কমিটমেন্টঃ
শহীদ আবদুল মালেক বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বের অধিকারী হলেও আন্দোলনের প্রতি তাঁর কমিটমেন্ট ছিল প্রবল। তাঁর এই কমিটমেন্ট শুধু যে সদস্য হওয়ার শপথ বাক্যে উচ্চারিত হয়েছে তা নয়, সাবেক লজিং মাস্টার জনাব মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে লেখা চিঠির ভাষাও তাঁর সেই কমিটমেন্টের প্রমাণ পাওয়া যায়- ‘‘জানি আমার দুঃসংবাদ পেলে মা কাঁদবেন, কিন্তু উপায় কি বলুন? বিশ্বের সমস্ত শক্তি আল্লাহর দেয়া জীবনবিধানকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। আমরা মুসলমান যুবকেরা বেঁচে থাকতে তা হতে পারে না। হয় বাতিল উৎখাত করে সত্যের প্রতিষ্ঠা করবো নচেৎ সে প্রচেষ্টায় আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। আপনারা আমায় প্রাণভরে দোয়া করুন জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও যেন বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারি। কারাগারের অন্ধকার, সরকারি যাঁতাকলের নিষ্পেষণ যেন আমাকে ভড়কে দিতে না পারে।”

৭. দায়িত্বানুভূতি ও স্বতঃস্ফূর্ততাঃ
দায়িত্বানুভূতি ও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল শহীদ আবদুল মালেকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক। এ ব্যাপারে আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী শহীদ আবদুল মালেক ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘আমার প্রিয় সাথী’তে লিখেছেন- ‘‘সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে একদিন ঢাকায় প্রবল বৃষ্টি হয়ে গেল। আগামসি লেনস্থ সংঘের পূর্ব পাক দফতর থেকে বেরোবার উপায় ছিল না আমাদের। বস্তির লোকেরা বিশ্ববিদ্যালয় পুরাতন কলাভবন, হোসেনী দালান ও সিটি ল’ কলেজে আশ্রয় নিয়েছে। আমি কোনোমতে ফজলুল হক হলে গেলাম। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে আমরা কী করতে পারি সে সম্পর্কে পরামর্শ করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। এ প্রসঙ্গে কথা ওঠার আগেই আবদুল মালেকের মুখে খবর পেলাম ঢাকা শহর অফিসে পানি উঠেছে। বৃষ্টি একটু থেমে যেতেই তিনি অফিসে গিয়ে সব দেখে এসেছেন। অধিক পানি ওঠায় কাগজপত্রাদি সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবদুল মালেক ওগুলো সব ঠিকঠাক করে এসেছেন। তাঁর দায়িত্ব সচেতনতার এ চাক্ষুষ প্রমাণটুকু আমার পক্ষে কোনোদিনই ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তারপর কর্মী বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে একদিন নিউমার্কেট ও আরেক দিন জিন্নাহ এভিনিউয়ে রোড কালেকশন করা হলো। অল্প সময়ে কর্মীদেরকে জমায়েত করে এত বড় কাজ আঞ্জাম দেয়ার মতো আর কোন কর্মীই ছিল না। আমারতো কাজ ছিল শুধু কাগজের টুকরায় কিছু নোট লিখে অথবা আধঘণ্টা পনের মিনিটের আলাপে মোটামুটি কিছু বুঝিয়ে দেয়া। আবদুল মালেকের সুদক্ষ পরিচালনায় সংগৃহীত অর্থের নিখুঁত হিসাব পেলাম। সিকি, আধুলি, পাই পয়সা থেকে নিয়ে কত টাকার নোট কতটি, তার হিসেবের ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছিলেন। এরপর তিন দিন তিন রাত একটানা পরিশ্রম করে আবদুল মালেক অল্প সংখ্যক কর্মী নিয়ে চাল বন্টনের কাজ সমাধান করে ফেললেন। সেদিন আবদুল মালেককে স্বচক্ষে অমানুষিক পরিশ্রম করতে দেখেছি। আর আমি মুরুব্বি সেজে পরামর্শ দিয়েছি কাজটা আর একটু সহজে কিভাবে করা যায়। এই ভাগ্যবান ব্যক্তির পরিশ্রমকে লাঘব করার জন্য সেদিন তার সাথে মিলে নিজ হাতে কিছু করতে পারলে আজ মনকে কিছু সান্ত¡না দিতে পারতাম।”

৮. দায়িত্বশীলতা ও দায়িত্বসচেতনতাঃ
সাধারণত একজন নেতার যে সকল গুণাবলি থাকা দরকার শহীদ আবদুল মালেকের মধ্যে তার পুরোটাই ছিল। ১৯৬৮-৬৯-এর সেশন শুরু হয়েছে। আবদুল মালেক ঢাকা শহর শাখার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের নিখিল পাকিস্তান ভিত্তিতে নির্বাচিত তিনজন সদস্যের মধ্যে তিনি অন্যতম। ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপসহীন, নির্ভীক। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ইসলামী আন্দোলনের কাজ অনেকটা গতিশীল হলো। তিনি ছিলেন কর্মীদের একজন আস্থাবান দায়িত্বশীল। এত বড় একজন দায়িত্বশীল হয়েও তিনি কর্মীদের খোঁজ-খবর নিতে ভুলতেন না।
একটি শিক্ষা শিবির পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। এক সময় জরুরি প্রয়োজনে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ তাকে দেখা গেল শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহৃত ল্যাট্রিনের পাশে। তবে ল্যাট্রিন ব্যবহারের জন্য নয়। এক বুক পানিতে নেমে তিনি ল্যাট্রিন মেরামতের কাজে মগ্ন। এ অবস্থা দেখে তো চোখ ছানাবড়া। অথচ এ কাজটি তিনি অন্যকে দিয়েও করাতে পারতেন। কতটুকু দায়িত্ব সচেতনতা তাঁর মধ্যে ছিল এ থেকে তা অনুমান করা যায়। শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের একটা চিরাচরিত অভ্যাস ছিল চিঠির মাধ্যমে কর্মীদের প্রেরণা জোগানো। তিনি নিয়মিতই বিভিন্ন কর্মীকে চিঠি লিখতেন। এমনি একজন কর্মী বেলালকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, ‘সৃষ্টির আদি থেকে একটি শাশ্বত নিয়মের মতো এ সত্য চলে এসেছে যে, মহাপুরুষরা সত্যের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজের মন-প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন। নির্মম সমাজ সেই মহাপুরুষকেই কঠিন ও নির্দয়ভাবে আঘাতের পর আঘাত হেনেছে। বি‌‌‌দ্রুপ, লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার এই ইতিহাস নতুন কিছু নয়। আরবের বালুকতা ও প্রস্তর কাদের তাজা খুনে রঞ্জিত হয়েছিল? হযরত ওমর, ওসমান, আলী আর হাসান হোসাইন-এর জীবন নাশের জন্য কারা দায়ী? ওমর ইবনে আবদুল আজিজ, মুহাম্মদ ইবনে কাশিম, কোতায়বা কাদের চক্রান্তে নিহত হয়েছিলেন? ইসলামের ইতিহাস পড়ে দেখ, রক্তের লাল স্রোত শুধু কারবালাতেই শেষ হয়ে যায়নি। আজও পৃথিবীর বুকে সহস্র কারবালা সৃষ্টি হচ্ছে। আজো মুসলমান ফাঁসির মঞ্চে নিজের জীবন বিলিয়ে দিচ্ছেন খোদার দ্বীনকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তোমরাতো পৃথিবী দেখনি, দেখনি মুসলমানদের ওপর নির্যাতন, শোননি তাদের হাহাকার। যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য দুনিয়ার শ্রেষ্ঠমানব নিজের জীবন তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেন, যার জন্য হাজারো মুজাহিদের তপ্ত রক্ত পৃথিবীর মাটি লাল করে দিয়েছে, সেই ইসলামই লাঞ্ছিত হচ্ছে মুসলমানদের হাতে।”

৯. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাঃ
ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলদের জন্য সংগঠন পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। শহীদ আবদুল মালেক ভাই ছিলেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অগ্রপথিক। তৎকালীন সময়ে ঢাকা মহানগরীর সভাপতি অধ্যাপক ফজলুর রহমান মালেক ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “আমি যখন ঢাকা মহানগরীর সভাপতি, মালের ভাই তখন ছিলেন শাখা সেক্রেটারি। একদিন রাতের বেলায় অফিসে গিয়ে দেখলাম মালেক ভাই মোম জ্বালিয়ে খাতা কলম নিয়ে হিসেব করছেন। আমি ঢুকে সাংগঠনিক কথা শুরু করলে তিনি হঠাৎ মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলেন। মোমবাতি নেভানোর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, বন্যার্ত মানুষের জন্য সংগৃহীত রিলিফের টাকা দিয়ে মোমটি কেনা হয়েছে। রিলিফের টাকায় কেনা মোম দিয়ে সাংগঠনিক কাজ করা ঠিক নয়। পরে তিনি সংগঠনের টাকায় কেনা মোম জ্বালালেন। বন্যাটি ছিল ১৯৬৭ সালের। এ থেকে তার অত্যধিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিচয় পাওয়া যায়।” মালেক ভাইয়ের সেদিনের স্মৃতি আজও আমাকে অনেক বেশি নাড়া দিয়ে থাকে।

১০. আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বঃ
শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান রহ. আবদুল মালেক ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, “আমি যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখন জিঞ্জিরা (কেরানীগঞ্জ) পিএম হাইস্কুলে আয়োজিত এক শিক্ষা শিবিরে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন মালেক ভাই। আমিও যোগদান করেছিলাম সেই শিক্ষা শিবিরে। আমার মনে হয় সেখানে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ কর্মী। রাতে খাবার পর হাত ধৌত করার সময় মালেক ভাইকে দেখলাম তিনি নিজে থালা বাসন পরিষ্কার করছেন। এসএসসি পরীক্ষা শেষে আমি আরো একটি শিক্ষা শিবিরে অংশ নিয়েছিলাম। শহীদ আবদুল মালেক ভাই সেই শিক্ষা শিবিরের পরিচালক ছিলেন। রাতে মালেক ভাইয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের ১১২ নম্বর কক্ষে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হলো। আমার সাথে আমার এক সঙ্গীও সেখানে ছিল। রাতে প্রোগ্রাম শেষে আমরা শয়ন করলাম মালেক ভাইয়ের সিটে। লক্ষ্য করলাম অনেক রাতে তিনি শুতে এলেন। অতঃপর মাথায় পত্রিকার কাগজ দিয়ে ফ্লোরে একটি চাঁদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। এক রাতের ঘটনা। আমার সঙ্গীটি হঠাৎ বিছানা থেকে পড়ে গেলেন। আর মালেক ভাই নিচে থেকে তাকে পাঁজাকোলে ধরে ফেললেন। ফলে সেই ভাইটি কোন ব্যথা পায়নি। জামালপুরে আশেক মাহমুদ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকাকালীন একদিন সকালে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য উঠে দেখি ছাত্রাবাসে আমার কক্ষের সামনের বারান্দায় একটি হালকা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে মালেক ভাই। আবেগে অভিভূত হয়ে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। খুব অভিমানে জিজ্ঞেস করলাম কতক্ষণ দাঁড়িয়েছেন, ডাক দিলেন না কেন? তিনি জবাবে বললেন তিনটার দিকে পৌঁছেছি। ভাবলাম সকালে তো ফজরের নামাজ পড়তে উঠবেই। তা ছাড়া চিন্তা করলাম অনেক পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়েছ, তোমার ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে লাভ কি? দুইজনের বদলে একজন কষ্ট করাই ভালো। তাই এখানে দাঁড়ালাম। আমার কিছু অসুবিধা হয়নি।

১১. নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতাঃ
শহীদ আবদুল মালেক একজন নীরব ও নির্ভরযোগ্য কর্মী ছিলেন। অতুলনীয় প্রতিভার অধিকারী হয়েও তিনি কখনো গর্ব করে বেড়াতেন না। তিনি শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করেই সামনের দিকে এগোতে চাইতেন। শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের দায়িত্বশীল আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেছেন, ‘‘আবদুল মালেক ভাই ঢাকা শহর শাখার অফিস সম্পাদক থাকা অবস্থায় অল্প সময়ের মধ্যেই সেই অফিসের চেহারা পাল্টে দিলেন। আবদুল মালেকের সহযোগিতায় ঢাকা শহর শাখার পর পর তিনজন সভাপতি যত সহজে বিরাট দায়িত্ব পালন করেছেন তেমন আরামে ও সহজে গুরুদায়িত্ব পালনের সুযোগ কোনদিন কেউ পেয়েছে বলে আমার জানা নেই।’’
সেই স্মৃতিচারণে মালেক ভাইকে উদ্দেশ্য করে আরো লিখেছেন, ‘‘তুমি পরে এসে আগে চলে গেছো, আল্লাহর দরবারে অনেক বড় মর্যাদায় ভূষিত হয়েছ, তাই তোমাকে বড় ঈর্ষা হয়। শাহাদতের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তোমাকে বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে, একনিষ্ঠ সহকারী হিসেবে নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু আল্লাহর দরবারে শাহাদত কবুলের মুহূর্ত থেকে আমি তোমাকে নেতা মানছি। তোমার কর্মতৎপরতা, আত্মগঠনে নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের প্রশ্নে সতর্কতা ও ন্যায়নিষ্ঠার যে উদাহরণ তোমার জীবন থেকে আমি পেয়েছি তা সাধ্যমত নিজে অনুসরণ করা ও অন্যকে অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করাকে আমার নৈতিক দায়িত্ব মনে করছি।”

১২. মানবদরদিঃ
ইসলামী আন্দোলনের একজন উদীয়মান কর্মী হিসেবে তাঁর মন ছিল মানবতার দরদে ভরপুর। দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের অবস্থা জানাও ছিল তাঁর অন্যতম কর্মসূচি। আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী লিখেছেন, ‘‘ঈদুল আজহা উপলক্ষে কর্মীরা বাড়িতে যাচ্ছে। রাতের ট্রেনে আবদুল মালেক বাড়ি যাবেন শুনেছি। দু’একদিনের মধ্যে দেখা হয়নি। সময় মতো স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম। আবদুল মালেককে খুঁজে পেতে বেশ সময় লেগেছে। কারণ তিনি মধ্যম শ্রেণীতে ওঠেননি। আমাকে দেখে তিনি বেশ অপ্রস্তুত হলেন। আমার স্টেশনে যাওয়া তাঁর কাছে কেমন যেন লেগেছে। বেশ একটু জড়সড় হয়ে বলতে লাগলেন, আপনি স্টেশনে আসবেন জানলে আমি যে করেই হোক দেখা করেই আসতাম। অবশ্য একবার খোঁজ করেছি আপনাকে পাইনি। আমি কথাগুলোর দিকে কান না দিয়ে কামরাটার দিকে ভালো করে দেখছিলাম। তিল ধারণের জায়গা নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে সারারাত। আমি চেষ্টা করলাম ইন্টারে জায়গা করে দেয়ার। টিকিটের ঝামেলাও চুকিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু রাজি করানো সম্ভব হলো না। আবদুল মালেক অকপটে বলেই ফেললেন, এই লোকগুলোর সাথে আলাপ করলে আমার ভালো লাগবে। তখনো বুঝতে পারিনি কত মর্যাদাবান ব্যক্তির কাছে এই কথাগুলো শুনছি।’’

১৩. দৃঢ়তা ও আপসহীনতাঃ
শহীদ আবদুল মালেক জানতেন যে ইসলামী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া মানেই কঠিন পরীক্ষাকে মাথা পেতে নেয়া। সেটা জেনে পথ চলার কারণেই কোনো প্রতিবন্ধকতা তাঁর পথ আগলে রাখতে পারেনি। ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপসহীন, নির্ভীক। পাহাড়সম দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে ছিলেন সম্মুখ পানে। তাঁর বলিষ্ঠতা, আত্মবিশ্বাস এবং সংগ্রামী চেতনার পরিচয় মিলে নিম্নের এই বক্তব্যের মাধ্যমে-
শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা রহ. এক সময়ে শহীদ আবদুল মালেক ভাই সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন : ‘‘আমি যখন ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দিলাম তখন এক কর্মী শিক্ষা শিবিরে ঢাকায় এলাম। আবদুল মালেকের কথা শুনেছি কিন্তু তাঁকে তখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। তিনি ছিলেন সেই শিক্ষা শিবিরের ব্যবস্থাপক। কিন্তু প্রায় তাঁকে দেখা যেত না। শেষ দিনে এসে তিনি একটা ছোট্ট বক্তব্য দিলেন। তাঁর বক্তব্যটা ছিল এরকম- ‘‘আমরা তো জেনে বুঝেই এ পথে এসেছি। এই পথ থেকে ফিরে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। আমরা যদি পেছনের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে অনেক দূর পথ পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু সামনের দিকে তাকালে মনে হবে আমাদের আরও অনেক পথ চলতে হবে। এই পথে চলতে গিয়ে যদি আমরা দ্রুতগামী কোনো বাহন পাই তাহলে সেটাতে সওয়ার হয়েই মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছবো, যদি তেমনটা না পাই তাহলে শ্লোথ কোনো বাহনে করে হলেও আমরা সেই মঞ্জিলে পৌঁছার চেষ্টা করবো।”
সত্যিই আবদুল মালেককে কোনো কিছুই ভড়কে দিতে পারেনি। তিনি পাহাড়ের মতো অটল অবিচল থেকে দ্বীনের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে গেছেন।

১৪. দাওয়াতি চরিত্রঃ
দ্বীনের দাওয়াতি কাজে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন শহীদ আবদুল মালেক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের সেরা ছাত্র হয়েও তিনি কিভাবে দাওয়াতি তৎপরতায় শামিল ছিলেন এবং দাওয়াতি কাজের প্রতি তাঁর পেরেশানি কেমন ছিলো। এরূপ কয়েকটি ঘটনা :
* মাসের ১ তারিখেই তিনি লিস্ট করে ফেলতেন কোন কোন ছাত্রের কাছে তিনি দাওয়াত পৌঁছাবেন। লিস্ট অনুসারে বেরিয়ে পড়তেন কাজে। একদিন তার এক বন্ধু সন্ধ্যায় গিয়ে দেখলেন মালেক ভাইয়ের মন অনেক খারাপ। চোখে জল টলমল করছে। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, আগামীকাল থেকে ক্যাম্পাস দু’তিন দিনের জন্য বন্ধ থাকবে। তিনি তার লিস্ট অনুসারে সবার কাছে দাওয়াত পৌঁছাতে পারেননি বলে তার মন খারাপ। মন বেশি খারাপ হয়েছে তাদের জন্য যাদেরকে সবে দাওয়াত দিয়েছেন। এখন তাদের সাথে দু’তিন দিন দেখা সাক্ষাৎ না থাকা মানে তারা আবার নতুন হয়ে যাবে।
* আবদুল মালেক ভাই সবাইকেই সালাম দিতেন। এক নাস্তিক তাকে একদিন বলল, আমি সালাম নেই না তবুও আপনি আমাকে বারবার সালাম দেন কেন? তিনি বললেন, সালাম মানে তো শান্তি কামনা করা। আমি কেন আপনার শান্তি কামনা করব না? এভাবেই কথা শুরু। অবশেষে একদিন এই নাস্তিকটিও ইসলামী আন্দোলনের পথে এসেছিলেন আবদুল মালেক ভাইয়ের দাওয়াতি তৎপরতার কারণে। মালেক ভাইয়ের মতে, সালাম দিলে কথা বলার একটা সুযোগ এসে যায় আর তাতে দাওয়াতি কাজ করা সহজ হয়ে যায়।
* আবদুল মালেক ভাইয়ের দাওয়াতে একজন কর্মী হয়েছেন। কিন্তু সেই কর্মী কিছুতেই ফজরের নামাজ পড়তে পারে না। বারবার কাজা করে ফেলে। মালেক ভাই বিচলিত হয়ে পড়েন তার নামাজ কাজা বন্ধ নিয়ে। মালেক ভাই থাকতেন ফজলুল হক হলে আর সেই কর্মী থাকতো পুরনো ঢাকায়। তথাপিও মালেক ভাই প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়তেন সেই কর্মীর মেসের পাশের মসজিদে তাকে সাথে নিয়ে। এভাবে প্রায় কয়েক মাস। অবশেষে কর্মীটি সাথী শপথ নিতে সমর্থ হয়।
* আবদুল মালেক ভাই গভীর রাতে জায়নামাজে বসে কাঁদতেন নিজের গুনাহ মাফের জন্য, ইসলামী আন্দোলনের জন্য, বিশ্ব মুসলিমদের জন্য। আর একটি বিষয় নিয়েও কাঁদতেন। সেটি হলো তার দাওয়াতি কাজের সফলতার জন্য। যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছানোর চিন্তা করতেন তাদের নাম ধরে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে হেদায়েতের জন্য দোয়া করতেন।
* দাওয়াতি কাজ ছিল শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের প্রাণ। সে কারণেই তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার প্রিয় ক্যাম্পাসের ছাত্রদের ইসলামের দিকে ডাকব আমার ডান হাত দিয়ে, ইসলামের শত্রুরা যদি আমার ডান হাত কেটে ফেলে তাহলে বাম হাত দিয়ে ডাকব, ওরা যদি আমার বাম হাতও কেটে ফেলে দুটো পা দিয়ে হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে ইসলামের সুমহান আদর্শের দিকে ডাকব। ওরা যদি আমার দুটো পা-ও কেটে ফেলে তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি ছেলেকে ইসলামের দিকে ডাকব। ওরা যদি আমার চলার গতিকে স্তব্ধ করে দেয়, তাহলে আমার যে দু’টি চোখ বেঁচে থাকবে সে চোখ দিয়ে হলেও ছাত্রদের ইসলামের দিকে ডাকব, আমার চোখ দু’টিকে যদি উপড়ে ফেলে তাহলে আমার হৃদয়ের যে চোখ রয়েছে তা দিয়ে হলেও আমি আমার জীবনের শেষ গন্তব্য জান্নাতের দিকে তাকিয়ে থাকবো।’’

১৫. ইকামাতে দ্বীনের কাজকে অগ্রাধিকারঃ
পৃথিবীর সকল কাজের মধ্যে ইকামাতে দ্বীনের কাজকেই সবচেয়ে বেশি প্রিয় করে নিয়েছিলেন শহীদ আবদুল মালেক। দ্বীনকে তিনি অন্যতম নয় বরং একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। আর এ উদ্দেশ্য পূরণে বাধা হিসেবে যা কিছু সামনে এসেছে তা মাড়িয়ে এগিয়ে গেছেন। বগুড়া জিলা স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েই বাবার কাছে চিঠি লিখেছিলেন, পাক জনাবেষু, ‘বাড়ির কথা ভাবি না, আমার শুধু এক উদ্দেশ্য, খোদা যেন আমার উদ্দেশ্য সফল করেন। কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছি এবং কঠোর সংগ্রামে অবতীর্ণ, দোয়া করবেন খোদা যেন সহায় হন। আমি ধন-সম্পদ কিছুই চাই না, শুধুমাত্র যেন প্রকৃত মানুষরূপে জগতের বুকে বেঁচে থাকতে পারি’।
কলেজের গন্ডি পেরিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে প্রবেশ করলেন তখন তার এ সঙ্কল্প আরও দৃঢ় হলো। তাইতো ফজলুল হক হলের ১১২ রুমের দরজার ওপর লিখে রেখেছিলেন শহীদ সাইয়েদ কুতুবের সেই বিপ্লবী বাণী “আমরা ততদিন পর্যন্ত নিস্তব্ধ হবো না, নীরব হবো না, নিথর হবো না, যতদিন না কুরআনকে এক অমর শাসনতন্ত্র হিসেবে দেখতে পাবো। আমরা এ কাজে হয় সফলতা অর্জন করব নয় মৃত্যুবরণ করব।” এ মহান মঞ্জিলে পৌঁছার জন্য মায়ের বন্ধনও ছিন্ন করার দৃপ্তশপথ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর বাবার কাছে লেখা চিঠিতে লিখেছেন, “মায়ের বন্ধন ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। বৃহত্তর কল্যাণের পথে সে বন্ধনকে ছিঁড়তে হবে। কঠিন শপথ নিয়ে আমার পথে আমি চলতে চাই। আশীর্বাদ করবেন, সত্য প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামে যেন আমার জীবনকে আমি শহীদ করে দিতে পারি। আমার মা এবং ভাইয়েরা আশা করে আছেন, আমি একটা বড় কিছু হতে যাচ্ছি। কিন্তু মিথ্যা সেসব আশা। আমি চাইনে বড় হতে, আমি ছোট থেকেই সার্থকতা পেতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হয়ে বিলেত থেকে ফিরে যদি বাতিলপন্থীদের পেছনে ছুটতে হয়, তবে তাতে কী লাভ?

১৬. পরিশ্রমপ্রিয়তাঃ
শহীদ আবদুল মালেক ভাই ছিলেন অনেক বেশি পরিশ্রমী। নূর মুহাম্মদ মল্লিকের ভাষায়, ‘‘তাঁকে দেখতাম সারাদিন এবং অধিকাংশ রাতভর কত কাজ করতে। ক্লাস করছেন, সময় পেলে পড়ছেন। এরপর আন্দোলনের কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা করছেন। রাতে হয়তো পোস্টারও লাগাচ্ছেন কর্মীদের সাথে। মনে পড়ে মালেক ভাই অনেক সময় পোস্টার লাগাবার পর অন্যান্যদের কাজ শেষ করার পূর্ব পর্যন্ত একটু সময় পেতেন, তখন সিঁড়িতে ঠেস দিয়ে অথবা পিচঢালা নির্জন পথে একটু বসে বিশ্রাম নিতেন।”
১৯৬৯ সালের ৩১ মে প্রিয় বেলালকে আবদুল মালেক ভাই লিখেছেন, “মনের অবস্থাটা খুব বেশি ভালো নয়। এ কথাটা কাউকে বলতেও পারছি না। বিরাট আন্দোলনের নগণ্য এক কর্মী আমি। ঢাকা ইসলামী ছাত্রসংঘের মত বিরাট সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব আমায় হাঁপিয়ে তুলেছে। সবাই কর্মী আর এই কর্মীদের পরিচালনার গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধেই চেপেছে। তাই মন খারাপ থাকলেও কর্মীদের সামনে জোর করে হাসতে হয়। শরীর খারাপ থাকলেও জোর করে বাইরে বেরোতে হয়। কারণ আল্লাহর দ্বীনের এ আন্দোলনের সামান্যতম ক্ষতি হোক, এটা চিন্তা করাও মুশকিল। যখন একা থাকি, তখনই যত রাজ্যের চিন্তা এসে মাথায় জট পাকায়। জীবনের এক কঠিন দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে আমার প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে।”
আগামী ১৫ আগস্ট পালিত হবে শহীদ আবদুল মালেকের ৪৬তম শাহাদতবার্ষিকী এবং ইসলামী শিক্ষা দিবস। শহীদ আবদুল মালেক আজকে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া প্রেরণা চিরভাস্বর হয়ে আছে এবং থাকবে। শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদতের এতো বছর পরেও আরো বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তার কথা স্মরণ করার। তাঁর শিক্ষাকে, কোরবানিকে, আদর্শকে, চরিত্রকে বর্তমান ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করার, যাতে এ দেশের ছাত্রমহলে যারা ইসলামী আদর্শের দিকে এগোচ্ছে তারা এ মহান আদর্শ থেকে যাতে বিচ্যুত না হয় এবং শহীদ মালেক যেন তাদেরকে প্রেরণা জোগান। একজন আবদুল মালেকের জায়গায় আজ লাখ লাখ আবদুল মালেক ছুটে এসেছে এ আন্দোলনে। শহীদ আবদুল মালেক ইসলামী শিক্ষা বা ইসলামী আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠিত হিসেবে দেখে যেতে পারেননি ঠিকই কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য তাঁর উত্তরসূরিরা জানবাজ চেষ্টা করছে এবং করবে। পেছন থেকে প্রেরণা জোগাবেন লক্ষ কোটি শহীদের মিছিলে শামিল হওয়া শহীদ আবদুল মালেক। মরহুম কবি মতিউর রহমান মল্লিকের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বললে বলতে হয়-

‘‘শহীদ মালেক আজো আমায় ডাকে
সকল বাধা পেরিয়ে যেতে
সেই দিশারি আড়াল থেকে হাঁকে …।
লেখকঃ আতিকুর রহমান । সেক্রেটারী জেনারেলঃ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির

মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০১৫

কারাগারে আল্লামা সাঈদীকে যেমন দেখেছি



গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আসা আর নির্যাতনের শিকার হয়ে যে দুঃখ কষ্ট ও যাতনার শিকার হয়েছি তা অনেকাংশে লাঘব হয় রাজবন্দী জাতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ হয়ে। ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে বন্দী আছেন বিশ্ববরেণ্য মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ২০১১ সালে আমি যখন প্রথম কারাবন্দী হই তখন কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কোর্টে যাওয়ার পথে একদিন হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তাও কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাত্র। আমরা কোর্টে যাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম এ সময় সাঈদী সাহেবও ট্রাইব্যুনালে যাচ্ছিলেন। কারারক্ষীদের বাধার মুখেও তখন হুজুরের সাথে সালাম বিনিময় আর মোসাফাহ করার সুযোগ পাই। তখন কেন্দ্রীয় কারাগারে বেশি কড়াকড়ি থাকায় আর সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ হয়নি। আমাদের কারাবন্দী কিছু ভাই তখন ট্রাইব্যুনালে যাওয়া-আসার সময় মাওলানা নিজামী সাহেবসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎ লাভের আশায় কারা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বন্দীদের জন্য ব্যবস্থাকৃত “মৎস্য প্রশিক্ষণ কোর্সে” অংশ নেয়। উদ্দেশ্য একটাই, পাশ দিয়ে নেতৃবৃন্দ যখন যাবেন তখন সালাম ও দোয়া নেয়ার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। মৎস্য প্রশিক্ষণ কোর্সের কেন্দ্রটি ছিল কারাগারের মূল গেটে যাতায়াতের রাস্তার পাশেই। কিছুদিন পর বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষের নজরে এলে কারা কর্তৃপক্ষ মৎস্য প্রশিক্ষণ কোর্সে জামায়াত-শিবিরের বন্দীদের অংশগ্রহণ করা মাইকে ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করে দেয়। কয়েকজনের ওয়ার্ড কেটে শাস্তিস্বরূপ আমদানি ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়।

এত কিছুর মধ্যেও দমানো যেত না বন্দীদের। ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎ ও দোয়া লাভের প্রত্যাশায় সুযোগ খুঁজে বেড়াত তারা। শুধু যে জামায়াত-শিবিরের বন্দীদের মধ্যেই এই প্রবণতা ছিল তাই নয় বরং সাধারণ বন্দীরাও চাইত জামায়াত নেতৃবৃন্দের সাথে একটু হ্যান্ডশ্যাক করতে, একটু বুক মেলাতে।

২৫ মে ২০১৩ দ্বিতীয়বার বন্দী হওয়ার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ২১ অক্টোবর’১৩ চালানে কাশিমপুর-১ এ আমাকে পাঠানো হয়। তখন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী হুজুর কাশিমপুর-১ এর মেডিক্যাল এলাকায় ফাঁসির সেলের ৩ নম্বর কক্ষে বন্দী ছিলেন। আমার অবস্থান ছিল চিত্রা বিল্ডিংয়ের ১১ নম্বর কক্ষে। এখানে আসার পরও ব্যাকুল ছিলাম সাঈদী সাহেবের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ লাভের অপেক্ষায়। এখানেও কড়াকড়ি হুজুরের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে। চিত্রা বিল্ডিং থেকে দূরে ছিল মেডিক্যাল ওয়ার্ড এলাকা। এই এলাকায় মেডিক্যালের একটি ওয়ার্ডের পাশেই ফাঁসির সেলে বন্দী ছিলেন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।

অবশেষে কাশিমপুরে আসার প্রায় ১৫ দিন পর মেডিক্যালে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার সুযোগে হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ লাভ করি।
দুপুরে খাওয়ার পর তিনি একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হুজুরের অনুমতি নিয়েই ফাঁসির সেলে প্রবেশ করলাম। দেখলাম কয়েকটি কম্বল দিয়ে তৈরী মেঝেতে পাতা বিছানায় তিনি শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। হুজুরের সেলটির আয়তন ছিল প্রায় ১২/৫ ফিটের মতো মাত্র। আমি সালাম দিয়ে প্রবেশ করতেই তিনি উঠে বসলেন, আর আমি সামনে পাতা জায়নামাজে বসে পরিচয় দিয়ে কথা বললাম। কক্ষের ভেতরেই কোমর সমান দেয়ালে আড়াল করা টয়লেটে দেখলাম বাথ চেয়ার বসানো, কোমরে সমস্যার কারণে এই চেয়ার হুজুরকে ব্যবহার করতে হয়। মাথার পাশে কুরআনের তাফসির আর কিছু ইসলামী সাহিত্য, জামা-কাপড়গুলো দড়িতে ঝুলানো। ছোট্ট একটি কক্ষের ভেতরে বন্দী হয়ে আছেন বিশ্ববরেণ্য মুফাসসির, কোটি কোটি জনতার নয়নের মণি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠলো, নিজেকে সামলে নিলাম। 
তিনি আমাকে ভালোভাবেই চিনতে পারলেন, কারণ এর আগে কয়েকটি প্রোগ্রামে হুজুরের সাথে আমার দেখা ও কথা হয়েছিল। শহীদবাগে উনার বাসায় গিয়েও একবার দেখা করেছিলাম। তা ছাড়া ঢাকা আলিয়ার সেক্রেটারি থাকা অবস্থায় ৪ এপ্রিল ২০০৫ সালে ছাত্রদলের সাথে সংঘর্ষে মারাত্মক আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলে তিনি আমাকে দেখতে যান এবং আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে আমার সুস্থতা কামনায় দোয়া করেন। সেই দিনটির কথাও হুজুরের স্মরণে ছিল।

কাশিমপুরে বন্দী থাকা অবস্থায় এরপরও আরো কয়েকবার সাঈদী সাহেবের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়। ১৬ এপ্রিল ’১৪ কোর্টে যাওয়ার পথে দেখা হলে তিনি তার কক্ষ থেকে আমাদেরকে এক প্যাকেট বিস্কিট দেন কোর্টে অবস্থানকালীন খাওয়ার জন্য। কাশিমপুর-১ এর বন্দীদের কোর্টে নিয়ে যাওয়া উপলক্ষে ভোরে সবাইকে মেডিক্যাল এলাকায় নিয়ে আসা। এখানে গননা করে কিংবা কাউকে বেড়ি পরিয়ে কোর্ট পাঠানো হয় আর সেই সুবাদেই হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ। আর হুজুর সে সময়টাতে হাঁটতে বের হন।

কারা কতৃপক্ষের কড়াকড়ির কারণে হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করতে না পারা নেতাকর্মীরা নানানভাবে সুযোগ খুঁজতেন। একদিন শিবিরের এক কর্মী (মেঘনা ওয়ার্ডের) রাত ১১টার দিকে হঠাৎ বমি শুরু করে। তার অবস্থা বেগতিক দেখে রাত্রেই কারারক্ষীরা তাকে মেডিক্যাল ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়। পরদিন সুস্থ হয়ে দুপুর নাগাদ সে আবার মেঘনা ওয়ার্ডে ফিরে আসে। তার ওয়ার্ডের লোকজন কৌতূহলী হয়ে তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, সে মূলত অসুস্থ ছিল না, মুখের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বমির ভান করেছে মাত্র, কারণ অসুস্থতা দেখালে তাকে মেডিক্যাল ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হবে। আর পরদিন ভোরে সাঈদী হুজুর যখন হাঁটতে বের হবেন তখন হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করে দোয়া নেয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করে দোয়া নেয়ার সুযোগ তৈরির জন্যই সে অসুস্থতার ভান করেছিল মাত্র।

কারাবন্দী থাকা অবস্থায় কারা কর্তৃপক্ষের শৃঙ্খলার ব্যত্বয় সাঈদী হুজুর করতেন না। একদিন কোর্ট থেকে বিকেলে লোকজন ফেরত এলে সবাই হুজুরকে দেখে সালাম দেন। হুজুর তখন বিকেলে ফাঁসির সেলের বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। এ সময় একজন বলে উঠল হুজুর সবাই আপনার সাথে একটু হাত মেলাতে চায়, আপনি কি একটু গেটের বাইরে আসবেন? হুজুর তখন বিনয়ের সাথে জানালেন, আপনাদের আবেগকে আমি শ্রদ্ধা করি, আপনাদের প্রতি আমার সালাম ও দোয়া থাকল, কিন্তু এই মুহূর্তে গেটের বাইরে যাওয়ার অনুমতি আমার নেই এ জন্য দুঃখিত। বন্দী থাকা অবস্থায়ও কর্তৃপক্ষের নিয়মের প্রতি তিনি এমন শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

হুজুরের ছেলে মাসুদ বিন সাঈদী পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হলে পরদিন আমি হুজুরের কাছে মিষ্টি এবং খেজুর পাঠাই। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে হুজুরের সাথে যেদিন মাসুদ সাঈদী ভাই দেখা করতে আসেন সেদিন আমার সাথেও মাসুদ সাঈদী ভাইয়ের দেখা হয়। হুজুরের সাথে আমার সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয় ৭ জুন শনিবার বিকেল ৪টায়। ২৫ জুন জামিনে মুক্ত হয়ে বের হওয়ার আগে এটিই ছিল হুজুরের সাথে কারাবন্দী অবস্থায় আমার শেষ সাক্ষাৎ। হুজুর তখন সালাতুল আসরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমার জামিনের সংবাদটি হুজুরকে জানিয়ে সহি সালামতে মুক্তি পাওয়ার প্রত্যাশায় দোয়া চাইলাম। কারণ জেলগেটে রিঅ্যারেস্ট ছিল সাধারণ ঘটনা। সাথে সাথেই হুজুর দোয়া করলেন, আল্লাহ যেন আমাকে বিপদমুক্ত অবস্থায় বের করে দেন এবং মুক্তির ব্যবস্থা করে দেন। পাশাপাশি আমি গ্রেফতারের পর আমার বাবার স্ট্রোক করার বিষয়টি জানাই, আমার আম্মা জায়নামাজে বসে হুজুরের জন্য দোয়া করেন জানালে তিনি আব্বা এবং আম্মার জন্য আল্লাহর দরবারে উত্তম জাযাহ এবং নেক হায়াত কামনা করেন। আমি হুজুরের সাথে আমিন আমিন ধ্বনি তুলি।

গ্রেফতারের পর রেবের নির্যাতনে আমার আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার ঘটনা হুজুর প্রথম সাক্ষাতেই জেনেছিলেন তাই তিনি আমার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন, বিশেষ করে আমার কোমরের কী অবস্থা জানতে চান। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তরুণদের উদ্দেশে বিশেষ করে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে হুজুরকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করি যে কথাগুলো আমি মুক্ত হয়ে নেতাকর্মীদের বলতে পারবো। তিনি বলতে শুরু করলেন, হুজুর বলেন- “আমি নিজের জন্য কখনো চিন্তা করি না, কারণ আল্লাহ তায়ালা আমার নসিবে যা রেখেছেন তাই হবে- কিন্তু আমি সবসময় চিন্তা করি বৃহত্তর আন্দোলন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্রীসংস্থা ও মহিলা জামায়াতকে নিয়ে। তাদের ওপর বর্তমানে যে ভয়াবহ জুলুম-নির্যাতন চলছে তা নিয়ে টেনশন করি।তিনি বলেন- রাতের আঁধারে দড়িতে ঝুলে মিথ্যা অপবাদে নয়, বরং কুরআনের ময়দানে, জিহাদের ময়দানে আমি সরাসরি শাহাদাত বরণ করতে চাই। আমি সবসময় লক্ষ লক্ষ জনতাকে সাথে নিয়ে শহীদি মৃত্যু কামনা করেছি। আমার এ কামনায় আমি কখনো ভান করিনি বরং আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই শহীদি মৃত্যু চেয়েছি।

সাঈদী হুজুর আরো বলেন- কলিজার টুকরা সংগঠন ছাত্রশিবিরের যুবকদের জন্য আমি সবসময় দোয়া করি। যখন দেখি শিবিরের তরতাজা যুবকরা পঙ্গু হয়ে, চোখ হারিয়ে নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে একের পর এক জেলে আসছে, ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটছে, তখন আর নিজের অশ্রুকে সামলাতে পারি না। আমি দেখলাম এ কথা বলতে বলতে হুজুরের দু’চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝরছে। অশ্রুসিক্ত হয়ে তিনি বললেন- আমি সবসময় দোয়া করি হে আল্লাহ! তুমি বাংলাদেশকে রক্তাক্ত মিসর বানাইয়োনা, বাংলার সবুজ জমিনকে ধর্মনিরপেক্ষাতাবাদীদের করদরাজ্যে পরিণত করো না। হুজুরের এ কথার প্রত্যুত্তরে আমি আমিন আমিন বলছি আর আমার দু’চোখ দিয়েও তখন অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।

সাঈদী হুজুর আরো বলেন- তবে এ অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র আল্লাহ প্রেমিক যুবকরাই। তিনি রাসূল (সা)-এর একটি হাদিস উল্লেখ করে বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, যুবকরাই সমাজ পরিবর্তনের মূল হাতিয়ার। যুবকদেরকে নিয়েই তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠার লড়াই করেছেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ত্যাগ-তিতিক্ষার যুগে যারা ইসলাম কবুল করেছিল তাদের অধিকাংশই ছিল যুবক, তাদের অনেকেরই বয়স ছিল ৪০-এর নিচে। আর যারা ইসলামের বিরোধিতা করেছিল তারা ছিল বৃদ্ধ, ৪০-এর ঊর্ধ্বে বয়স।

সাঈদী হুজুর আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, যুবকরা যদি যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে তাহলে একদিন বাংলাদেশ হবে ইসলামের বাংলাদেশ। তিনি আরো বলেন, আমার দৃঢ়বিশ্বাস জেল জুলুম নির্যাতনের ফলে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন ৫০ বছর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের ওপর দমন, নিপীড়ন, জুলুম নির্যাতন দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ এখন মক্কি যুগের শেষ অধ্যায়ে উপনীত হয়েছে। আমরা যদি ধৈর্য ধারণ করে ঈমানী শক্তিকে মজবুত করে এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য সুদিন অপেক্ষা করছে। তিনি তার লেখা ‘নন্দিত জাতি নিন্দিত গন্তব্যে’ বইটি আমাকে উপহার দেন।

এরপর হুজুরের ইমামতিতে সালাতুল আসর আদায় করি। নামাজ শেষে হুজুর আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে দোয়া করেন। এরপর আমার কাঁধে ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে মেডিক্যাল এরিয়ার গেট পর্যন্ত এসে আমাকে বিদায় জানান আর বিদায় মুহূর্তে বলেন, ‘যাও, মুক্ত হয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়, আল্লাহ তোমাদের সহায় হবেন। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হুজুর সকাল-বিকাল দু-বেলা একজনের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করেন। তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেন। বিছানায় বসে লিখতে লিখতে ওনার কোমর ও হাঁটুর ব্যথা বেড়ে গেছে। আমাদের পক্ষ থেকে একটি টেবিলের ব্যবস্থা করা হলেও কারা কর্তৃপক্ষ ৩ মাস গেটে রেখে পরে ওনাকে দেয়া সম্ভব না জানিয়ে ফেরত দেয় টেবিলটি। শেষ দিন সাক্ষাতে ওনাকে আমি নিজ হাতে টেনে বিছানা থেকে উঠতে সাহায্য করি। তখন হুজুর আক্ষেপ করে বলছিলেন, টেবিল না থাকায় ওনার কোমর ও হাঁটু ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।

এই লেখাটি কারাগারে থাকা অবস্থায়ই লিখেছিলাম। জানি না এখন বিশ্ববরেণ্য মুফাসসিরে কুরআন, কোটি কোটি যুবকের হৃদয়স্পন্দন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কারাগারে কেমন আছেন। মহান প্রভুর দরবারে দোয়া করছি আল্লাহ যেন ওনাকে মুক্ত করে আবার কুরআনের মাহফিলে ফিরিয়ে দেন আমিন । 
লেখকঃ (Yasin Arafath)
see more at-
http://chhatrasangbadbd.com/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0…/