বাংলাদেশে ৭ নভেম্বর জাতীয়তাবাদীদের সৃষ্ট কোন দিন না হলেও এই দিবসটি নিয়ে জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে এক ধরনের চেতনা বিরাজ করছে দীর্ঘদিন ধরেই । এই দিনটিকে জাতীয়তাবাদীরা স্মরণ করে সিপাহী জনতার বিপ্লবের দিন হিসেবে । জাতীয়তাবাদীদের মত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরাও এই দিনটিকে পালন করছেন । ইতিহাসের খেলায় জেনারেল জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বরের নায়ক হলেন । অথচ তিনি ৭ নভেম্বরের উদ্যোক্তা ছিলেন না । মূলতঃ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের দীর্ঘ পরিকল্পনার ফসল ৭ নভেম্বর । কিন্তু এটি তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় । কিন্তু কেনো ? কেনইবা ৭ নভেম্বর আজ জাতীয়তাবাদী তথা ভারত বিরোধী জনগোষ্ঠীর এক বিজয়ের দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে ?
ইতিহাস সবসময়েই বিজয়ীর পক্ষে এবং বিজয়ীর গুনগাথা ছাড়া কিছুই নয় । এটাই সত্য যে ৭ নভেম্বর জাতীয়তাবাদীদের সৃষ্ট কোন দিন নয় । ৭ নভেম্বরে জাতীয়তাবাদীদের অবদান কোথায় ? সেই তথ্য নতুন প্রজন্মের সামনে কেউ তুলে ধরছেন না । স্রোতে গা ভাসানোর মত করেই সবাই এই দিবসটিকে পালন করে যাচ্ছেন । আমি এই দিবসটি নিয়ে বিশাল কোন ব্যাখ্যায় যাবো না । দিবসটির প্রকৃত তথ্য তুলে ধরবো । এক পক্ষকে আমি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী বলছি এই কারনে যে এই আদর্শের দল ‘জাসদ’ আজ বহুধা বিভক্ত একটি দল । এক সময়ে বিপ্লবের চেতনার নামে লাখো দেশপ্রেমিক তরুনের স্বপ্নকে ঐক্যবদ্ধ করে কয়েকটি জেনারেশনকে ধ্বংস করে দেয়া এই জাসদের সৃষ্ট ৭ নভেম্বরের চেতনাও আজ অন্যের দখলে । কিন্তু কেন এটি জানতে হলে জানতে হবে জাসদের জন্ম ইতিহাস । সেই সাথে বাংলাদেশের সৃষ্টির চেপে যাওয়া ইতিহাস; যা ইতিহাসের ইতিহাস ।
জাসদ জন্মের প্রক্রিয়ার সাথে বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রক্রিয়া জড়িত । আর এর মূল নায়ক হলেন জাসদের প্রতিষ্ঠাতা ‘সিরাজুল আলম খান’; যিনি ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদকে নিয়ে ছাত্রলীগের ভেতরেই ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর সহায়তায় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে ছোট একটা সেল বা চক্র তৈরি করেন । পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে গড়তে বুর্জোয়া সংগঠনের ভেতরে বিপ্লবী চেতনা প্রদানে ‘র’ চিত্তরঞ্জন সূতার ও কালিদাস বৈদ্যের মাধ্যমে পুর্ব-পাকিস্তানে সিরাজুল আলম খানকে দিয়ে এই চক্রটি তৈরি করে ।
ইতিহাসের পরিক্রমায় ভারতীয় এই চক্রান্ত টের পেয়ে চীন বিপ্লবী সিরাজ সিকদারকে সহায়তা দিলে তিনি প্রথম ”পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার’ দলিল প্রণয়ন করেন যাতে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হলে তা হবে ভারতীয় আধিপত্যে নিষ্পেষিত স্বাধীনতাকামী জাতি সমুহের স্বাধীনতার ভুল ভিত্তি ভূমি । এই দলিলের পরেই ভারতীয়রা তাদের পরিকল্পনা ভিন্ন ধারায় এগিয়ে নেয় । বিপ্লবী চেতনার পরিবর্তে বুর্জোয়া নেতৃত্বকে মূল শক্তিতে পরিনত করে। পরিকল্পনায় যুক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার একটি ডেস্ক । তাদের লক্ষ্য ছিল চীনের বিপক্ষে ভারতকে শক্তিশালী করতে ভারতের একটি সীমান্তকে নিরাপদ করা ।
যাই হোক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো । বুর্জোয়া নেতৃত্বরা গা ঢাকা দিলেন, শেখ মুজিবর রহমান নিজেই পাকিস্তানীদের হাতে ধরা দিলেন । ঠিক তখনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাংলাভাষী সেনারা বিদ্রোহ করে এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান (তৎকালীন মেজর) স্বাধীনতা যুদ্ধের অফিসিয়াল ঘোষণা প্রদান করেন । তাকে এই যুদ্ধ ঘোষণা দেয়ার মত চ্যালেঞ্জিং কাজটি করতে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সহায়তা দেয়া হয়েছিল বলেও অনেক তথ্য পাওয়া যায় । তবে যাই হোক না কেন জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা তাকে ইতিহাসে অমর করে দিয়েছে । জেনারেল জিয়া সেদিন এই যুদ্ধ ঘোষণার কাজটি না করলে বুর্জোয়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনোই স্বাধীনতা যুদ্ধকে বাস্তব রুপ দিতে পারতো না এবং ধীরে ধীরে স্বাধীনতা যুদ্ধটি কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের হস্তগত হয়ে এক দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধে পরিনত হতো আর তার সকল প্রাপ্তি ও ফসল যেতো চীন ও তার বন্ধুদের পক্ষে; যা ভারতের অখণ্ডতাকে অনেক আগেই ধ্বংস করে দিতো ।
রাজনীতিতে এই খেলাগুলো এমন জটিল যে সকলের পক্ষে এটি বোঝা সম্ভব নয়; জানাও সম্ভব না । কোন ঘটনার সাথে কোন দেশ কিভাবে যুক্ত হয় তা সবার পক্ষে জানাও সম্ভব নয় । তাই অনেকের কাছে সত্য ইতিহাস, ইতিহাসের ইতিহাসকে গাঁজাখুরি মনে হয় । এমনকি অনেক বিদ্বান পিএইচডি ডিগ্রিধারীরাও এসব বিষয়ে অজ্ঞতাকেই জাহির করেন ।
যুক্তরাষ্ট্র- ভারত বনাম চীনের এই দ্বন্দ্বের ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সহায়তায় ভারত বাংলাদেশকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয় ঘটিয়ে দিতে সক্ষম হলেও পাকিস্তান সৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখা সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের এই জনগোষ্ঠীকে ভারত বিরোধিতার ক্ষেত্রে বিশ্বাস করতে না পারার কারনেই বাংলাদেশ সৃষ্টির ৩ মাসের মধ্যেই ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি ১৯৭২’ নামে একটি ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তি করিয়ে নেয় ১৯৭২ এর ১৯শে মার্চ তারিখে ঢাকায় । এই চুক্তির অনুচ্ছেদ ৮-এ বলা হয়, “কোন দেশ অপর দেশের বিরুদ্ধে কোনরূপ সামরিক জোটে যোগ দিতে পারবে না এবং অপর দেশের বিরুদ্ধে কোন রকম সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে পারবে না এবং তার সীমানাধীন স্থল, জল এবং আকাশ অপর রাষ্ট্রের সামরিক ক্ষতি অথবা অপর রাষ্ট্রের সংহতির প্রতি হুমকিস্বরূপ কোন কাজে ব্যবহার করতে দিতে পারবে না ।” অনুচ্ছেদ ৯-এ বর্ণিত রয়েছে, “একপক্ষ অন্য পক্ষের বিপক্ষে কোন তৃতীয় পক্ষকে যে কোন সামরিক সংঘর্ষে কোন প্রকার সাহায্য দিতে পারবে না । যদি কোন পক্ষ আক্রমণের শিকার হয় কিংবা আগ্রাসনের হুমকির মুখাপেক্ষি হয়, তবে অনতিবিলম্বে দুই পক্ষই পারষ্পরিক আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সেই আক্রমণ কিংবা আগ্রাসনের হুমকির মোকাবেলা করার জন্য । এভাবেই দুই দেশের শান্তি ও সংহতি বজিয়ে রাখা হবে ।” অনুচ্ছেদ ১০-এ বর্ণিত আছে, “এই চুক্তির পরিপন্থী কোন প্রকার অঙ্গীকার কোন পক্ষই অন্য কোন দেশ বা একাধিক দেশের সাথে খোলাভাবে কিংবা গোপনে করতে পারবে না ।”
এমন একটি চুক্তি করেও ভারত নিজেকে নিরাপদ ভাবতে ব্যর্থ হয় । কারন তাদের সমর্থিত আওয়ামী লীগ ও তার রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারে ভারত বিরোধী জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে । মুসলিম এই জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম এমনিতেই পাকিস্তান আমল থেকে বিপ্লবী চেতনায় সমৃদ্ধ হতে শুরু করেছে । ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে চীনপন্থি বিপ্লবী দলগুলোর পক্ষে নতুন প্রজন্মের ব্যপক আকাঙ্ক্ষাকে ধ্বংস করতে ভারতের ‘র’ দুটো উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নিজেরাই একটি বিপ্লবী গোপন সংগঠন দাড় করিয়ে দেয়। গণবাহিনী নামের ঐ সশস্ত্র সংগঠনের গণ সংগঠন হিসেবে থাকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। চীনপন্থি বিপ্লবীদের প্রকাশ্য সংগঠন না থাকার কারনে জাসদের ও গণবাহিনীর পক্ষে গণজাগরণ বাড়তে থাকে। বুর্জোয়া ও সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার জনগোষ্ঠী জাসদকে নির্বাচনী সংগঠন ধরেই আগাতে থাকে। এর মধ্য দিয়ে ভারত বাংলাদেশের ভারত বিরোধী জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করতে সমর্থ হয়। বিপ্লবের নামে ভারত বিরোধী জনগোষ্ঠীর কয়েকটি জেনারেশন ধ্বংস করে দেয় জাসদ রাজনীতির নামে। আর এই ধ্বংসটি করায় আওয়ামী লীগকে দিয়ে।
এরপরেও যখন বিপ্লবের তাণ্ডব কমাতে ব্যর্থতা দেখা যায় কৌশলে তখন ভারত বুর্জোয়া সংগঠন আওয়ামী লীগকে সমাজতান্ত্রিক সংগঠনে পরিনত করার ব্যবস্থা হাতে নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নকে সাথে নিয়ে কৌশলে সোভিয়েত পন্থীদের সাথে সংযোগ ঘটিয়ে ‘বাকশাল’ নামের সমাজতান্ত্রিক দল ও রাষ্ট্র গঠন করে দেয়। এতে করে তারা বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে চীনপন্থি শিক্ষিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে। আর মাঠে থাকে জাসদ ও সশস্ত্র গণবাহিনী। এরই মাঝে গড়ে তোলা হয় ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’; লক্ষ্য বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়া। কারন ইতিমধ্যেই পাকিস্তান ফেরত হাজার হাজার সেনা অফিসার ও সদস্য বাংলাদেশে ফিরে ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে’ যোগ দেন। এই বাহিনীর সবাই এমন এক প্রশিক্ষনের আওতায় গড়ে ওঠা যাদের কাছে ভারত হলো একমাত্র শত্রু রাষ্ট্র। তাই সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে দায়িত্ব আসে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লে কর্নেল তাহেরে কাছে। বিপ্লবের মন্ত্রে তিনি এগিয়ে যান একটি ৭ নভেম্বর গড়তে ।
লেখকঃ শেখ মহিউদ্দিন আহমেদ (রাজনীতিবিদ এবং স্ট্র্যাটেজিক এনালিস্ট)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন