সোমবার, ৩১ জুলাই, ২০১৭

প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দিন আর নেই


মহান মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবন সাব সেক্টর কমান্ডার ও প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা পিরোজপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অবঃ) জিয়াউদ্দিন আহমেদ সিংগাপুর মাউন্ট এলিজাভেত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন । 
ইন্তানালিল্রলাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন । তাঁর দু’টি কিডনী অচল এবং লিভারের অবস্থাও খারাপ ছিলো । 
পরিবারের পক্ষ থেকে কামাল উদ্দিন দেশবাসীর কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধে এই অকুতোভয় সেনা নায়কের জন্য দোয়া কামনা করেছেন ।  
পিরোজপুরের অহংকার সুন্দরবনের মুকুটহীন সম্রাট মেজর (অব) জিয়াউদ্দিন সম্পর্কে কিছু তথ্য--
জন্ম:
পিরোজপুর জেলা শহরের তিনবারের নির্বাচিত পৌর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আফতাব উদ্দীন আহম্মেদের সন্তান।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা:
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ৯ নম্বর সেক্টরের সুন্দরবন সাব-সেক্টর কমান্ডার। তাঁকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অনন্য।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী :
জিয়াউদ্দিন আহমেদ ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুলাই মাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যোগ দেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। দায়িত্ব পান ৯ নম্বর সেক্টরের সুন্দরবন অঞ্চলের সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে রাখেন বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যারাকে ফিরে যান। পরে মেজর হিসেবে পদমর্যাদা পান। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে নিহত হন তখন তিনি ঢাকায় ডিজিএফআইতে কর্মরত ছিলেন। ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহি- জনতার বিপ্লবে তিনি অংশ নেন। এরপর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কর্নেল তাহেরের সৈনিক সংস্থার পক্ষে অবস্থান নিয়ে তার অনুসারীদের নিয়ে সুন্দরবনে আশ্রয় নেন। '৭৬ সালের জানুয়ারিতে সুন্দরবনে সেনা অভিযানে মেজর জিয়াউদ্দিন গ্রেফতার হন। সামরিক আদালতে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি ও আ স ম আবদুর রব, মেজরজলিল সহ অন্যদের সঙ্গে মেজর জিয়াউদ্দিনও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ নিয়ে তখন সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধারা আন্দোলন শুরু করলে আ স ম আবদুর রব, মেজর জলিলসহ অন্যদের সঙ্গে মেজর জিয়াউদ্দিনও ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি লাভ করেন। '৮৩ সালে জেনারেল এরশাদের সময় মেজর জিয়াউদ্দিন দেশ ছেড়ে আশ্রয় নেন সিঙ্গাপুরে।
কর্ম ও রাজনৈতিক জীবন:
'৮৪ সালের অক্টোবরে ছোট ভাই কামালউদ্দিন আহমেদ, ভাগ্নে শামীমসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে চলে যান সুন্দরবনের দুবলার চরে। বনদস্যু বাহিনীগুলোর হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত সুন্দরবনের জেলেদের সংগঠিত করে শুরু করেন শুঁটকি মাছের ব্যবসা। ৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুন্দরবনের মূর্তিমান আতঙ্ক ডাকাত দল কবিরাজ বাহিনীর সঙ্গে শ্যালারচরে সরাসরি বন্দুকযুদ্ধে জয়ী হন মেজর জিয়াউদ্দিন, নিহত হয় কবিরাজ বাহিনীর প্রধান। এরই মাঝে '৮৯ সালে পৌরবাসীর দাবির মুখে নির্বাচন করে তিনি পিরোজপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। গড়ে তুলেছেন সুন্দরবন বাঁচাও কর্মসূচি নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। এর চেয়ারম্যানও তিনি। কর্মজীবনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত দুলবার চর ফিসারমেন গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে আছেন। আর সংগত কারণে হাজার হাজার জেলের স্বার্থ রক্ষায় ডাকাতদের প্রতিরোধ করতে হয়েছে। কখনো জেলেদের নিয়ে, কখনো প্রশাসনকে সহায়তা দিয়ে ডাকাতদের নির্মুলের নায়কের ভূমিকা রেখেছেন। আর এ কারণেই অনেকশত্রু তার পিছু নিয়েছে। বিশেষ করে বন ও জল দস্যুদের দমনে তার ভূমিকা প্রশংসিত। আবার প্রশাসনের বনদস্যু নির্মুলে জনবল ও বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন। সুন্দরবনের একাধিক ডাকাত গ্রুপ বিভিন্ন সময় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এসব ডাকাত গ্রুপ জিয়াউদ্দিনকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। এর আগে তিনি একাধিকবার হামলার শিকার হয়েছেন।' এরপর দীর্ঘ সময় ধরে দুবলার চরসহ সুন্দরবনের শুঁটকিপলি্ল থেকে দূরে থেকেছে বনদস্যু বাহিনীগুলো। কয়েক বছর ধরে সুন্দরবনে জুলফিকার, গামা, রাজু, মোর্তজাসহ বেশ কয়েকটি শক্তিশালী বনদস্যু বাহিনী জেলে-বাওয়ালীদের মুক্তিপণের দাবিতে একের পর এক অপহরণ শুরু করে। এসব বাহিনী দুবলার চরসহ শুঁটকিপল্লিতে মাঝে মাঝে হানা দিতে থাকে। এসব বাহিনী দুবলার চর ফিশারমেন গ্রুপের কাছে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সর্বশেষ মোর্তজা বাহিনীর সদস্যরা পূর্ব সুন্দরবনের হারবাড়িয়া ও মেহেরালীর চর এলাকার মাঝামাঝি চরপুঁটিয়ায় মেজর জিয়াকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে। বন্দুকযুদ্ধে মোর্তজা বাহিনীর চার সদস্য নিহত ও মেজর জিয়া মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।

প্রকাশণা:
মুক্তিযুদ্ধে নিজের ও অন্যান্যদের অংশগ্রহণ এবং যুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি "সুন্দরবন সমরে ও সুষমায়" নামে একটি বই লিখেছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন