বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬

মুহাররম ও আশুরা

আরবী বছর শুরুর প্রথম মাস মহররম । 
মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও হাদীস শরীফে এ মাস সম্পর্কে যা এসেছে তা হল, এটা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ মাস । কুরআনের ভাষায় এটি ‘আরবাআতুন হুরুম’-অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম ।
এ মাসে রোযা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘রমযানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা হল সর্বশ্রেষ্ঠ ।’
أفضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم
-সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮; জামে তিরমিযী ১/১৫৭
এর মধ্যে আশুরার রোযার ফযীলত আরও বেশি ।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেনঃ ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি ।’
ما رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يتحرى صيام يوم فضله على غيره إلا هذا اليوم يوم عاشوراء وهذا الشهر يعني رمضان
-সহীহ বুখারী ১/২১৮
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমযানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন ? তিনি বললেনঃ এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম । উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ‘রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ । কারণ, এটি আল্লাহর মাস । এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তা'আলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন ।’-জামে তিরমিযী ১/১৫৭
অন্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোযার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন ।’
صيام يوم عاشوراء أحتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله  -সহীহ মুসলিম ১/৩৬৭; জামে তিরমিযী ১/১৫৮
আশুরার রোযা সম্পর্কে এক হাদীসে আছে যে, ‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ ।’
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোযা রাখব ।’-সহীহ মুসলিম ১/৩৫৯
মহররম ও আশুরা কেন্দ্রিক নানা কুসংস্কার যেমন আছে তেমনি এ মাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ।
আশুরাকে কেন্দ্র করে এ মাসে যেসব অনৈসলামিক কাজকর্ম ঘটতে দেখা যায় তার মধ্যে শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র‌্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত । এসব রসম-রেওয়াজের কারণে এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করার একটা প্রবণতা অনেক মুসলমানের মধ্যেও লক্ষ করা যায় । এজন্য আবার অনেকে এ মাসে বিয়ে-শাদী থেকেও বিরত থাকে । বলাবাহুল্য এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার । মোটকথা, এ মাসের করণীয় বিষয়গুলো যখা, তওবা- ইস্তেগফার, নফল রোযা এবং অন্যান্য নেক আমল । এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়া এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক চলাই মুসলমানের একান্ত কর্তব্য । আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন ।
এ মাসের একটি ঘটনা শাহাদাতে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু । বলাবাহুল্য যে, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয় । কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই তো শিক্ষা-‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করিনা যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয় ।’ অতএব শাহাদাতে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলী রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য ।
পবিত্র আশুরা
আশুরা হলো মুহররম মাসের দশম দিবস । আরবীতে "আশারা" মানে ১০ আর সে কারণে দিনটিকে "আশুরা" বলে অভিহিত করা হয় । ইসলামের ইতিহাসে এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত কারণ বহু ঐতিহাসিক ঘটনা এই তারিখে সংঘটিত হয়েছিল । এই দিনে আখেরী নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৌহিত্র ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইসলামের তৎকালীন শাসনকর্তা এজিদের সৈন্য বাহিনীর হাতে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেছেন । 
হিজরী ৬০ সনে এজিদ বিন মুয়াবিয়া পিতার মৃত্যুর পর নিজেকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসাবে ঘোষণা করে । সে প্রকৃত মুসলমান ছিল না, সে ছিল মোনাফেক । সে এমনই পথভ্রষ্ট ছিল যে সে মদ্যপানকে বৈধ ঘোষণা করেছিল । অধিকন্তু সে একই সঙ্গে দুই সহোদরাকে বিয়ে করাকেও বৈধ ঘোষণা করেছিল । শাসক হিসাবে সে ছিল স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী । হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এজিদের আনুগত্য করতে অস্বীকৃত হন এবং ইসলামের সংস্কারের লক্ষ্যে মদীনা ছেড়ে মক্কা চলে আসেন । উল্লেখযোগ্য যে, উমাইয়া শাসনামলে ইসলাম পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিল । মক্কা থেকে তিনি কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন । শেষ পর্যন্ত তিনি কারবালার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন । এ সময় উমর ইবনে সাদ আবি ওক্কাসের নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্য কারবালায় প্রবেশ করে । কয়েক ঘণ্টা পর শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদির নেতৃত্বে আরো বহু নতুন সৈন্য এসে তার সাথে যোগ দেয় ৷ কারবালায় দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয় । নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় । এই অসম যুদ্ধে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং তাঁর ৭২ জন সঙ্গী শাহাদৎ বরণ করেন । শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদি নিজে কণ্ঠদেশে ছুরি চালিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে অত্যান্ত নির্মমভাবে হত্যা করে । ওইদিন ছিল হিজরী ৬১ সনের ১০ মুহররম ।
এদিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের জন্য কুদরত প্রকাশ করেছেন । 

এইদিন নবী মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমুদ্রে রাস্তা বের  নিরাপদে পার করে দিয়েছেন অপরদিকে শত্রু ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে নীল নদে  ডুবিয়ে মেরেছেন।-সহীহ বুখারী ১/৪৮১ ডুবিয়ে দেয়া হয় ।   
صوموا عاشوراء وخالفوا فيه اليهود، صوموا قبله يوما أو بعده يوما -মুসনাদে আহমদ ১/২৪১
ইসলামের ইতিহাস অনুসারে এই দিনটি আরো অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ । জনশ্রুত রয়েছে ১০ মুহররম তারিখে আসমান ও যমিন সৃষ্টি করা হয়েছে । এই দিনে পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদিপিতা হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করা হয়েছিল ।  এই দিন  নূহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিস্তি ঝড়ের কবল হতে রক্ষা পেয়েছিলো এবং তিনি জুডি পর্বতশৃংগে নোঙ্গর ফেলেছিলেন । এই দিনে দাউদ আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাওবা কবুল হয়েছিলো । নমরূদের অগ্নিকুণ্ড থেকে হযরত খলিলুল্লাহ ইব্রাহীম আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্ধার পেয়েছিলেন । হযরত আইয়ুব আলাইহি ওয়াসাল্লাম দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত ও সুস্থতা লাভ করেছিলেন । এদিনে আল্লাহ তা'আলা হযরত ঈসা ইবনে মারিয়ম আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উর্দ্ধাকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন । এই তারিখেই কেয়ামত সংঘটিত হবে ।


২টি মন্তব্য:

  1. মাশা'অাল্লাহ।
    ধন্যবাদ ভাই।
    মহররম এর ব্যাপারে সুন্দর একটি ধারণা পেলাম।
    শুকরান।

    উত্তরমুছুন
  2. মাশা'অাল্লাহ।
    ধন্যবাদ ভাই।
    মহররম এর ব্যাপারে সুন্দর একটি ধারণা পেলাম।
    শুকরান।

    উত্তরমুছুন