মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৬

ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালা কি বাদ

কারবালার ইতিহাস আর আমাদের শিক্ষা

বলাবাহুল্য যে, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয় এবং মহররম মাস ও আশুরার (১০ই মুহররম) দিনটা মুসলিম জাহানের উপর চেপে বসা রাজা-বাদশাহ শেখ ও আমির শাসিত রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্যে একটা চরম বিব্রতকর দিন । রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারনে স্বৈরাচারী শাসক ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে ৬১ হিজরীতে এদিন মহানবীর দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু শাহাদাত বরন করেছিলেন । ইসলামের ইতিহাসে অনেক নবী রসুলসহ খলিফা হযরত উসমান, হযরত আলীসহ হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর চাইতেও বেশী মর্যাদাপূর্ণ আরো অনেক বড় বড় মহান ব্যক্তির হত্যাকান্ডের ঘটনা থাকলেও ৬১ হিজরীর কারবালার ঘটনা এতোটাই পৈচাশিক ও নির্মমতম ছিল যে এটা যুগে যুগে কঠিন হৃদয়কেও নাড়া দিয়েছে, এখনো দেয় এবং নিঃসন্দেহ তা কেয়ামত পর্যন্ত জালিমদের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাতে ও ইসলামী শক্তির পক্ষে মুমীনদের উদ্ভূদ্ধ করায় নিয়ামক ভূমিকা পালন করবে ।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকাল পূর্বে কাউকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাননি । তিনি জনগনের উপর তার উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ভার ছেড়ে দিয়ে যান । সেইমতে প্রথম চারজন উত্তরাধিকারী তথা খোলাফায়ে রাশেদীন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগন কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন । কিন্তু উমাইয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুয়াবিয়া খিলাফত লাভের সাথে সাথে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন । ৬৭৬ খ্রীষ্টাব্দে বসরার শাসনকর্তা হযরত মুগিরার প্ররোচনায় তিনি তার জ্যৈষ্ট পুত্র ইয়াজিদকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার মর্মমুলে চরম কুঠারাঘাত করেন । হযরত মুয়াবিয়া এবং হযরত মুগীরা উভয়েই সম্মানিত সাহাবী ছিলেন । যেহেতু তারা কোন নবী বা রসুল ছিলেন না, স্বাভাবিক কারনেই তারা ভুলের উর্ধ্বে ছিলেন না । কিন্তু তাদের এই ভুল ইসলামের ইতিহাসকে ক্ষত বিক্ষত, রক্তাক্ত ও কলঙ্কিত করে । ইসলামের শাসন পদ্ধতির মুলে চরম কুঠারাঘাত করে । ঐতিহাসিক আল-ফাখরী, ফন ক্রেমার এবং ইবনুত তিকতাকার মতে ইয়াজিদের রাজত্বকাল তিনটি দুষ্কর্মের জন্য বিখ্যাত-প্রথম বছরে সে মহানবীর আদরের দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে হত্যা করে, দ্বিতীয় বছরে মদীনাকে লুন্ঠন করে এবং তৃতীয় বছরে সে কাবার উপর হামলা করে । এই ইয়াজিদ-এর খলিফা হিসাবে মনোনয়ন অন্যরা মেনে নিলেও, ইসলামের ব্যত্যয় মহানবীর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু মেনে নিলেন না । হুসাইনের এই ন্যায্য দাবীকে আবদুল্লাহ-ইবনে যুবাইর, আবদুল্লাহ-ইবনে ওমর, আবদুর রহমান-ইবনে আবু বকর সমর্থন করেন । 

ইয়াজিদ ইসলামী শাসন ব্যবস্থার ব্যত্যয় ঘটানোয় ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর মত মুমীন ব্যক্তির পক্ষে সেটা মেনে নেয়া কোনভাবেই সম্ভব ছিল না । খিলাফত ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনই ছিল ইমাম হোসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর সংগ্রামের মূল লক্ষ্য । মুসলিম জাহানের বিপুল মানুষের সমর্থনও ছিল তার পক্ষে ।

ইরাকের লোকেরা তার কাছে চিঠি/দূত পাঠিয়ে জানাল তারা তাকে খলিফা হিসেবে চায়, ইয়াজিদকে নয় । সমর্থকদের চিঠি পেয়ে হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকীলকে কুফায় পাঠালেন অবস্থা দেখার জন্য । মুসলিম দেখলেন যে আসলেই অনেক মানুষ হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে খলিফা হিসেবে চাচ্ছে । তিনি হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে সেটা জানিয়েও দিলেন । ইতমধ্যে কিছু অত্যুৎসাহী লোকেরা হানী বিন উরওয়ার ঘরে মুসলিমের হাতে হুসাইনের পক্ষে বায়াত নেওয়া শুরু করল । সিরিয়াতে ইয়াজিদের কাছে এ খবর পৌছালে সে বসরার গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে পাঠাল কুফাবাসীর বিদ্রোহ দমন করতে ।

উবাইদুল্লাহ কুফায় গিয়ে দেখে ঘটনা সত্যি । মুসলিম বিন আকীল চার হাজার সমর্থক নিয়ে উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের প্রাসাদ ঘেরাও করলেন । এ সময় উবাইদুল্লাহ দাঁড়িয়ে এক ভাষণ দিয়ে মানুষকে ইয়াজিদের সেনা বাহিনীর ভয় দেখাল । কুফাবাসীরা ইয়াজিদের শাস্তির ভয়ে আস্তে আস্তে সরে পড়তে লাগল । সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মুসলিম বিন আকীল দেখলেন, তথাকথিত হুসাইন  রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু সমর্থকদের কেউই অবশিষ্ট নেই । তাকে গ্রেপ্তার করে হত্যার আদেশ দিল উবাইদুল্লাহ । মুসলিম মৃত্যুর আগে হুসাইনের কাছে একটি চিঠি পাঠান –
 “হুসাইন ! পরিবার-পরিজন নিয়ে ফেরত যাও । কুফা বাসীদের ধোঁকায় পড়ো না । কেননা তারা তোমার সাথে মিথ্যা বলেছে । আমার সাথেও তারা সত্য বলেনি ।”



এদিকে মুসলিম বিন আকীলের মৃত্যু হলেও তার প্রথম চিঠির উপর ভিত্তি করে যিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখে হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা দেন । অনেক সাহাবী তাকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন । তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর, আব্দুল্লাহ বিন আমর এবং তাঁর ভাই মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফীয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

সুফীয়ান আস সাওরী ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবনে আব্বাস (রা:) হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে বলেছিলেনঃ মানুষের দোষারোপের ভয় না থাকলে আমি তোমার ঘাড়ে ধরে বিরত রাখতাম । আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা:) হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে বলেনঃ  হুসাইন ! কোথায় যাও ? এমন লোকদের কাছে, যারা তোমার পিতাকে হত্যা করেছে এবং তোমার ভাইকে আঘাত করেছে ?

যাত্রা পথে হুসাইনের কাছে মুসলিমের সেই চিঠি এসে পৌঁছুলো । চিঠি পড়ে তিনি কুফার পথ পরিহার করে ইয়াজিদের কাছে যাওয়ার জন্য সিরিয়ার পথে অগ্রসর হতে থাকলেন । পথিমধ্যে ইয়াজিদের সৈন্যরা আমর বিন সাদ, সীমার বিন যুল জাওশান এবং হুসাইন বিন তামীমের নেতৃত্বে কারবালার প্রান্তরে হুসাইনের রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর গতিরোধ করল । তিনি আগত সৈন্যদলকে আল্লাহর দোহাই এবং নিজের মর্যাদার কথা উল্লেখ করে তিনটি প্রস্তাব দেন –

১. তাকে ইয়াজিদের দরবারে যেতে দেয়া হোক । 

২. অথবা তাঁকে মদিনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক ।

৩. অথবা তাঁকে কোন ইসলামী অঞ্চলের সীমান্তের দিকে চলে যেতে দেয়া হোক । সেখানে তিনি জিহাদ করবেন এবং ইসলামী রাজ্যের সীমানা পাহারা দেবেন ।

ইয়াজিদের সৈন্যরা উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের ফয়সালা ছাড়া কোন প্রস্তাবই মানতে রাজী হল না । এ কথা শুনে উবাইদুল্লাহর এক সেনাপতি হুর বিন ইয়াজিদ বললেনঃ  এরা তোমাদের কাছে যেই প্রস্তাব পেশ করছে তা কি তোমরা মানবে না ? আল্লাহর কসম ! তুর্কী এবং দায়লামের লোকেরাও যদি তোমাদের কাছে এই প্রার্থনাটি করত, তাহলে তা ফেরত দেয়া তোমাদের জন্য বৈধ হত না । এরপরও তারা খুব যৌক্তিক এই প্রস্তাবগুলো মেনে নেয়নি। 

অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইবেন যিয়াদের ৪ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হোসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে  অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয় । মাত্র ২০০ মানুষের বিপক্ষে ৪০০০ সৈন্য । পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয়ায় ইমামের কচি সন্তানেরা প্রচণ্ড তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লে হযরত আব্বাস ফোরাতে যান পানি আনতে । নিজেও তিনি ভীষণ তৃষ্ণার্ত ছিলেন । আঁজলা ভরে পানি তুলে খেতে যাবেন এমন সময় তাঁর মনে পড়ে যায় ইমাম হোসেন এর তৃষ্ণার্ত শিশু সন্তানের কথা । পানি ফেলে দিয়ে মশক ভর্তি করে তাঁবুর উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই শত্রুপক্ষের তীরে তাঁর এক হাত কেটে যায় । মশকটাকে তিনি অপর হাতে নিয়ে ইমামের তাঁবুর দিকে ছুটলেন । এবার অপর হাতটিও কাটা পড়ে । মশকটাকে এবার তিনি মুখে নিয়ে তাঁবুর দিকে যেতে চাইলেন । শত্রুর তীর এবার সরাসরি তার দেহে আঘাত হানে । এভাবে শহীদ হয়ে যান তিনি ।  এরপর অসম এই যুদ্ধে আলী আকবর শহীদ হয়ে যান । কারবালায় ৭২ জন সঙ্গী শাহাদৎ বরণ করেন, তাদেঁর মধ্যে রাসূলের প্রিয় সাহাবা হাবিব ইবনে মাজাহের, তাঁর প্রাচীন বন্ধু মুসলিম ইবনে আওসাজা, নওমুসলিম ওহাবসহ আরো অনেকেই ।

নিরুপায় হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু শেষবারের মত অনুরোধ করলেও, পাষান্ডদের মন গলেনি । ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর কারবালার প্রান্তরে এক অসম যুদ্ধ শুরু হলো । হুসাইনের ভ্রাতুষ্পুত্র কাশিম সর্বপ্রথম শত্রুর আঘাতে শাহাদাত বরন করলেন । তৃষ্ণার্ত হুসাইন শিশুপুত্র আসগরকে কোলে নিয়ে ফোরাত নদীর দিকে অগ্রসর হলেন কিন্তু ইয়াজিদ বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তীর শিশুপুত্রের শরীরে বিদ্ধ হয়ে শিশুপুত্রটি শাহাদাত বরন করলে একাকী অবসন্ন হুসাইন  রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু তাবুর সামনে বসে পড়লেন । এমন সময় এক মহিলা তাকে এক পেয়ালা পানি এনে দিলো । কিন্তু শত্রুর তীর তার মুখ বিদীর্ণ করে দিলো ।



শিমার বিন যুল জাওশান নামের এক নরপশু বর্শা দিয়ে হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর শরীরে আঘাত করে ধরাশায়ী করে ফেললো ।  শেষে ইয়াজিদ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে নির্ভীক এই বীর আল্লাহর লিখে রাখা ভাগ্যানুযায়ী শহীদ হলেন । শিমার বিন যুল জাওশান মুরাদি নিজে কণ্ঠদেশে ছুরি চালিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে অত্যান্ত নির্মমভাবে হত্যা করে । ওইদিন ছিল হিজরী ৬১ সনের ১০ মুহররম । হযরর ঈমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু অন্যায় কিছু বলেন নি, অন্যায় কিছু করেন নি । তার হত্যাকারী ও হত্যায় সাহায্যকারীদের আল্লাহর ক্রোধ ঘেরাও করুক, এরা ধ্বংস হোক ! আল্লাহ্‌ তায়ালা শহীদ হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু এবং তাঁর সাথীদেরকে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রহমত ও সন্তুষ্টি দ্বারা আচ্ছাদিত করুন ।

ইতিহাসের পরবর্তী বিশ্লেষণঃ

ইয়াজিদ বেঁচে নেই । কিন্তু ইয়াজিদের প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র এখনো শীর্ষ মুসলিম দেশগুলো কব্জা করে রেখেছে । স্বৈরাচাররা মুসলমানদের বুকে চেপে বসে আছে । মুসলমানদের বোকা বানাবার জন্যে তাদেরও কিছু গৃহপালিত আলেম ইমাম পীর জাতীয় লোক আছেন । এরা চেষ্টা করছে কারবালার ইতিহাসকে ম্লান করে এর গুরুত্বকে খাটো করার । তারা ইনিয়ে বিনিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কায়দা করে বলতে চায়, ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু ক্ষমতার লোভেই নাকি কুফায় গমন করেছিলেন । তার এই যাওয়াতে নাকি ইসলামের কোন কল্যাণ ছিল না । এটা নাকি হক আর বাতিলের যুদ্ধ ছিল না । (নাউজুবিল্লাহ)। আল্লাহর লানত এইসব দরবারীর উপর । তারা ইয়াজিদের নৃশংসতাকে এবং ফোরাত নদীর পানি সরবরাহ বন্ধকে সহি নয় মর্মে প্রতিপন্ন করতে তৎপর । কেউ কেউ কারবালার এ ঘটনাকে কেচ্ছা কাহিনী বলতেও দ্বিধা করেনি । ইনিয়ে বিনিয়ে তারা দলীল পেশ করে কেবল দরবারী আলেমদের । তারা বুঝাতে চান, কারবালার ঘটনা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় । এ নিয়ে মাতামাতি করে লাভ নেই । ইয়াজিদ হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর হত্যাকারী নয় । ইমাম হুসাইন  রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু মুসলিম জাতির নির্বাচিত আমীর বা খলীফা ছিলেন না । তাকে হত্যা করা জায়েজ ছিল বলেও তারা কৌশলে মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেন । কোন কোন আলেম তো ইয়াজিদের প্রতি অতিরিক্ত লিখতে গিয়ে তাকে ‘রাহমতুল্লাহ’বলতেও কুন্ঠিত হননি । তবে এইসব দরবারী আলেমরা বড়ই ধূর্ত । তারা প্রথমেই হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু-এর পক্ষে এমনভাবে বন্দনা করেন যে পড়ে মনে হবে তারা হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু-এর খুবই ভক্ত এবং পক্ষের লোক । প্রথমেই বোঝাতে চেষ্টা করেন ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর মহব্বতে তাদের কলিজা ভরপুর । কিন্তু ধূর্তামীর আশ্রয়ে 'প্রকৃত ইতিহাস' শেখাবার নামে এবং বড়ই চাতুর্য্যপূর্ণভাবে তারা ইয়াজিদের সাফাই গায় । তারা হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে হত্যার জন্য হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকেই দায়ী করেন । কেউ কেউ শীয়াদের দায়ী করেন । অথচ ঐসময় শীয়া মতবাদের সৃষ্টিই হয়নি । মোট কথা, যে কোনভাবেই যেন ইয়াজিদকে দায়ী করা না হয় । ইমাম হুসাইনের হত্যার দায় কুফাবাসীর উপরও চাপাতে চান । তারা বোঝাতে চান, ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু  কুফাবাসীর ফাঁদে পড়ে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন । অথচ কুফাবাসীদের প্ররোচনায় হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু ইয়াজিদের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন-এমনটা কোন মুসলমান মনে করতে পারে না । বরং ইমাম হুসাইন  রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু ইসলামী খেলাফতের পক্ষে এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন । এটা ঠিক কুফাবাসীরা কথা দিয়ে কথা রাখেনি । তারা ইমাম পরিবারের সাথে চরম গাদ্দারী করেছে । দরবারী আলেমরা চরম ধূর্ততার আশ্রয়ে ইয়াজিদকে ভাল শাসক, ইসলামের খেদমতগার বলেও প্রতিপন্ন করতে চান । তাদের মতে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো নাকি সহি নয় । তারা মানুষকে বোঝাতে চান, ইয়াজিদ হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দিলেও হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে হত্যার নির্দেশ দেয়নি । পাঠক খেয়াল করুন ফাঁকিবাজিটা কোথায় । ইয়াজিদ যখন হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে হত্যার ঘটনা শুনলো তখন ইয়াজিদ ব্যথিত হয়েছিল বা হত্যাকারীকে শাস্তি দিয়েছিল এমন কোন দলীল তো পাওয়া যায় না । দরবারীরা বলে বেড়ান যে, হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর ছিন্ন মস্তক ইয়াজিদের দরবারে এলে সেখানে নাকি কান্নার রোল পড়ে যায় । কিন্তু হত্যাকারীকে তো ক্ষমতা থেকে সরিয়েও দেয়নি এবং কোন শাস্তিও দেয়নি । গর্ভনর ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ তো তার স্বপদে বহাল তবিয়তেই ছিল । তাহলে কি বোঝা গেলো ? দরবারীরা আরো বুঝাতে চান রাজতন্ত্র তেমন খারাপ কিছু নয় । যুগে যুগে এইসব দরবারীরা নানাভাবে মুসলমানদের সত্য ইতিহাস শেখাবার নামে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করেছে । 


সম্মানীত সাহাবীরা কেন ইমামকে কুফা যা্ওয়া রুখতে চেয়েছিলেন ?

ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু যখন কুফাবাসীর পত্র পেয়ে কুফায় যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন অনেক সম্মানীত সাহাবী তাকে যেতে নিষেধ করেছিলেন । তারা কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি আগে থেকেই অনুমান করেছিলেন বলেই হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে যেতে নিষেধ করেছিলেন । কোনভাবেই ইয়াজিদকে সমর্থণ করে নয় । 

হুসাইন (রাঃ)-কে কেন ইমাম বলা হয় ?

পুরো মুসলিম বিশ্ব এক কথায় তাকে ইমাম বা নেতা মেনে নিয়েছেন । ইয়াজিদ জনতার উপর চেপে বসেছিল । ইয়াজিদ মুসলিম বিশ্বের নির্বাচিত নেতা ছিল না । সেই সময় থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানেরা ইয়াজিদকে ইমাম বা নেতা হিসাবে মেনে নেয়নি নেবেও না । হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে ইমাম বলার অর্থ ইয়াজিদকে স্বীকার না করা । ইমাম বা নেতা হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুই । সেকারনে তখন থেকেই যুগে যুগে হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নাম নেয়ার আগে 'ইমাম' বলা হয় । ইমাম হাসান রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকেও বিষ প্রয়োগে অত্যন্ত কৌশলে হত্যা করা হয়েছিল । তিনিও মুসলিম জাতির ইমাম । ইয়াজিদের বংশধরদের যতই গা জ্বলুক, কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানেরা হাসান রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে ‘ইমাম’ হিসাবেই ঘোষনা দেবেন । 

আশুরার দিন যা বর্জনীয়

সুন্নি নামধারী কিছু লোক এদিন নানা জাতের খানাপিনা করেন, মহরম-এর বাদ্য বাজান, এদিনটাকে খুশীর আমেজে পালন করেন । আবার শীয়া নামধারী কিছু কুলাঙ্গার এদিন নানা জাতের মাতম করেন, বুকে পিঠে ছুরি মারেন, তাজিয়া মিছিল করেন । এসব কাজ অবশ্যই বর্জনীয় । এসব কখনোই ইসলাম অনুমোদন করেনি । কাজেই এগুলো বিদআত । এদের কিছু কিছু কর্মকান্ড শির্কের পর্যায়ভূক্ত । মুসলমানদেরকে অবশ্যই এসব বর্জণ করতে হবে । 

যা করনীয়

১। রোজা রাখুন । কেননা কারবালার এই মর্মান্তিক ঘটনা ছাড়াও এদিনটি ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ । হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘রমযানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা হল সর্বশ্রেষ্ঠ ।’
أفضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم
-সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮; জামে তিরমিযী ১/১৫৭ 
ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই আশুরার দিনের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে এত গুরুত্বসহকারে অন্য কোন দিন রোযা পালন করতে দেখিনি । (অর্থাৎ রামাযান মাস ছাড়া) (বুখারী)।

২। কারবালার এ বিয়োগান্ত ঘটনা স্মরন করে ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু ও তার পরিবার বর্গের জন্যে দোয়া করুন । আল্লাহপাক বলেছেন, ‘যাঁরা আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় শহীদ হন তাঁদেরকে কখনও মৃত মনে করো না । বরং তাঁরা নিজেদের রব তায়ালার নিকট জীবিত ও রিযিকপ্রাপ্ত।’ (সূরা আলে ইমরান-১৬৯)

৩। কারবালার ঘটনার চেতনায় উদ্ভূদ্ধ হয়ে রাজতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, পীরবাদ, জালিম শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে মনেপ্রাণে ঘৃণা প্রকাশ করুন, 'ইসলাম' প্রতিষ্ঠায় নিজ করনীয় ঠিক করুন এবং তা পালনের দৃঢ় শপথ নিন । 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন