বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০১৫

দুনিয়ার বিনিময়ে আখেরাত ক্রয়

সাঈদ ইবনে আমের আল জুমাহী (রাঃ)
এমন মহান ব্যক্তি, যিনি দুনিয়ার বিনিময়ে আখেরাত ক্রয় করে নিয়েছেন । সমস্ত লোভ-লালসা এবং অন্য সবকিছুর চাইতে  তিনি আল্লাহ ও তার রাসুলকে অগ্রধিকার দিয়েছেন ।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম সাহাবী খুবাইব ইবনে আদী রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুকে মক্কার কুরাইশ নেতারা বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে বন্ধী করে তানঈম নামক স্থানে নিয়ে গিয়ে অত্যান্ত নির্মম ও অমানুষিক অত্যাচারের মাধ্যমে হত্যা করে । সাঈদ ইবনে আমের আল জুমাহী ছিলো মক্কার সেইসব যুবকদের অন্যতম, যারা কুরাইশ নেতাদের আহবানে এই নির্মম ফাঁসির দৃশ্য দেখতে গেয়েছিলো । খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর উপর কুরাইশ নেতৃবৃন্দ অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েও তাকে ইসলাম থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি । পরিশেষে তারা তাকে ফাসিতে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে বদর যুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহন করে ।
তারুন্য উচ্ছল সাঈদ ইবনে আমের আল জুমাহী নারী পুরুষের প্রচন্ড ভিড় ঠেলে আবু সুফিয়ান ও সাফওয়ান ইবনে  উমাইরের মতো কুরাইশ নেতৃবৃন্দের পাশে গিয়ে উপস্থিত হয় । খুবাইব ইবনে আদী রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর শাহাদাতের দৃশ্য ছিলো অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী । খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর হাত পা শিকলে বেধে ফাঁসির মঞ্চের দিকে অগ্রসর হওয়ারকালে মক্কার নারী পুরুষ শিশু ও যুবকদের দল তাকে ধাক্কা দিতে দিতে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যেতে থাকে । উপস্থিত জনতা করতালি দিয়ে এহত্যা কান্ডে উৎসাহ দিচ্ছিলো । সাঈদ ইবনে আমের আল জুমাহী একটি উচু টিলায় দাঁড়িয়ে এ নির্মম দৃশ্য দেখছিলো । জাহেল কুরাইশরা আজ এ হত্যার মাধ্যমে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাদের সীমাহীন হিংসা-জিঘাংসা চরিতার্থ করছে এবং বদরের যুদ্ধে তাদের নিহতদের হত্যার প্রতিশোধ নিচ্ছে ।
ইতোমধ্যেই তারা খুবাইব ইবনে আদী রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুকে ফাঁসির মঞ্চে উপস্থিত করেছে । কাফিরদের জিঘাংসার মন খুবাইবের খুনের নেশায় উম্মাদ হয়ে উঠলো । চারদিকে কাফিররা তুমুল হর্ষধ্বনী দিয়ে হিংস্র ও বর্বর উল্লাসে ফেটে পড়লো । আল্লাহর রাহে নিবেদিত, মজবুত ঈমানী চেতনায় বলীয়ান খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠলেন । কাফিরদের এ নির্মম নির্যাতনে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি । প্রচন্ড শোরগোলের মঝে হঠাৎ সাঈদ ইবনে আমের আল জুমাহী শুনলো যে, খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর কন্ঠ থেকে একটি শান্ত ও ধীরস্থির, খোদায়ী শক্তিতে বলিয়ান এক তেজোদীপ্ত আওয়াজ বের হলোঃ
"তোমরা অনুমতি দিলে ফাসি দেওয়ার আগে দু'রাকায়াত নফল নামায আদায় করতে চাই"
সাঈদ এ আওয়াজ শোনা মাত্রই প্রবল আগ্রহে ফাঁসির মঞ্চের দিকে তাকালো এবং দেখতে পেলো খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু কিবলামুখী হয়ে দু'রাকায়াত নামাজ আদায় করছেন । কী সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক তার সেই নামায ! ধীর স্থীরভাবে স্বল্প পরিসরে তিনি দু'রাকায়াত নামায আদায় করে উপস্থিত নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্যকরে বলেনঃ 
"আল্লাহর শপথ ! আমি মৃত্যুর ভয়ে নামায দীর্ঘায়িত করছি, তোমরা এ ধারনা করবে বলে মনে না হলে আমি আমার নামায আরো দীর্ঘ করে পড়তাম" ।
খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর এই দীপ্ত ঘোষণার পরই কালবিলম্ব না করে মক্কার কাফিরেরা তার ওপর সেই পৈশাচিক ও অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে দিলো । মানুষতো দুরের কথা, একটি নির্বোধ পশুকেও কোনো নির্মম পাষণ্ড জীবিত অবস্থায় তার দেহ থেকে প্রতিটি অঙ্গ -প্রত্যঙ্গ একের পর এক কেটে কেটে বিচ্ছিন্ন করার মতো নির্মমতা প্রদর্শন করতে সাহস পাবে না । অথচ তৎকালীন মানুষরুপী সেই ইসলামের দুষমনেরা জীবিত অবস্থায়ই খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর শরীর থেকে তার অঙ্গ -প্রত্যঙ্গ একের পর এক কেটে কেটে বিচ্ছিন্ন  করতে থাকে আর প্রিয়নবী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য বলতে থাকেঃ
তুমি কি রাজি আছো ? যদি তোমাকে ছেড়ে দিয়ে তোমারই উপস্থিতিতে তোমার পরিবর্তে মুহাম্মাদকে হত্যা করি ?
রাসুল প্রমিক খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর শরীর থেকে তখন ভীষণভাবে রক্তপাত হচ্ছিলো; কিন্তু শত পৈশাচিক নির্যাতন ও নিপীড়ন সত্ত্বেও আল্লাহর নির্ভীক সৈনিক, রাসুল প্রেমিক মর্দে মুজাহিদ খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু  ঈমানী দীপ্ত চেতনায় অনড় এবং অটল । তিনি বলিষ্ঠ কন্ঠে উত্তর দিলেনঃ
"আল্লাহর শপথ ! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার বিনিময়ে আমি মুক্তি পেয়ে আমার পরিবার পরিজনের নিকট নিরাপদে ফিরে যাওয়াতো দুরের কথা, পথে হেটে যেতে তাঁর পায়ে একটি কাঁটার আঁচড় লাগুক তাও আমি সহ্য করতে পারবো না । মুনাফিকী জীবন থেকে শহীদি মৃত্যু আমার কাছে অনেক উত্তম" ।
তাঁর এই ঈমানী চেতনাদীপ্ত দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা শুনে আগুনে ঘৃতাহুতি দিলে যেমন হয় তেমনি উচ্ছৃঙ্খল কাফিরেরা ক্রোধে উম্মাত্ত হয়ে উঠলো এবং চিৎকার করে বলতে শুরু করলো; তাকে হত্যা করো । তাকে হত্যা করো ।
সাথে সাথে ফাসিকাষ্ঠে দন্ডায়মান জান্নাতের পথযাত্রী খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর ওপরে হিংস্র হায়েনার মতো সদলবলে ঝাপিয়ে পড়লো কাফিরেরা । তীর বর্ষা আর খঞ্জরের আঘাতে তাঁর গোটা দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেললো । এদিকে আল্লাহর পথযাত্রী খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু আকাশের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে কালেমায়ে শাহাদাত উচ্চারন করছেন এবং ফাকে ফাকে বলছেনঃ
"হে আল্লাহ ! তুমি এদের দেখে রেখো, এদের শক্তি ও প্রতিপত্তিকে ধ্বংশ করে দাও । কাউকে ক্ষমা করো না । এক এক করে এদের সবাইকে শেষ করো"
একথা গুলো বলতে বলতে তিনি শাহাদাতের পাক পেয়ালা পান করে মহান প্রভুর দরবারে চলে গেলেন ।
খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর ঈমানী চেতনা, আল্লাহর প্রতি তাঁর দৃঢ় মনোবল, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি প্রানাধিক ভালোবাসা এবং শাহাদাতের এই নির্মম দৃশ্য কাফিরদের পাষাণ হৃদয়ে কোনো রেখাপাত করেনি; বরং তারা আত্ম-অহংকার ও খোদাদ্রোহিতার পথেই ইসলামের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার জন্য অন্ধভাবে অপচেষ্টা চালাচ্ছিলো । কিন্তু খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর শাহাদাতের নির্মম দৃশ্য যুবক সাঈদের অন্তরে অত্যন্ত গভীরভাবে রেখাপাত করে । মুহূর্তের জন্যেও সে তা ভুলতে পারেনি । সে ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নে এবং জাগ্রত অবস্থায় কল্পনার চোখে তাকে দেখতে থাকে । সে যেন দেখতে পায় তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে ধীর ও প্রশান্তচিত্তে ফাঁসি কাষ্ঠের সামনে খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু দু'রাকায়াত নামায আদায় করছেন । কুরাইশদের বিরুদ্ধে যে বদদোয়া তিনি করেছিলেন তা যেন তাঁর কর্ণকুহরে ভেসে আসছে । তাঁর মনে হতো যেন আসমান থেকে কোনো বিকট বজ্রধ্বনি কিংবা প্রকান্ড পাথর তাঁর ওপর নিক্ষিপ্ত হচ্ছে । তাই সে মাঝে মাঝে ভঁয়ে আঁতকে উঠতো ।
খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর শাহাদাতের ঘটনা সাঈদের হৃদয়ে এমন একটি বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলো, যা ইতঃপূর্বে সে কখনো অনুভব করেনি । সে বুঝতে পেরেছিলো, যেন শাহাদাত বরনের মাধ্যমে তিনি সাঈদকে এ শিক্ষাই দিয়ে গেলেন যে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি অগাধ প্রেম ও ভালোবাসাই হলো মুমিন জীবনের প্রকৃত সার্থকতা । সে খুবাইব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর কুরবানী থেকে এটাই বুঝতে পারলো যে, মজবুত ঈমানী চেতনাই মু'মীন জীবনে অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক ঘটনা সংঘঠিত করতে সক্ষম করে তোলে । তাঁর অন্তর বার বার এও সাক্ষ্য দিচ্ছিলো যে, যার অনুসারীগন নিজেদের জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও তাদের নবীকে ভালোবাসে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সত্যিকার রাসুল না হয়ে পারেন না ।
সাঈদের হৃদয়ে যখন এসব চিন্তা বিপ্লবী ঝড় সৃষ্টি করছিলো তখন আল্লাহ তাকে ইসলামের জন্য কবুল করলেন । সাঈদ মুশরিকী জিন্দেগীতে আর এক মুহূর্তও অতিবাহিত করা পছন্দ করলো না । সাথে সাথে ছুটে গেলো কুরাইশদের অনুষ্ঠানে । তাদের সামনে দাঁড়িয়ে সে মানুষের হাতে গড়া মূর্তি, দেবতা আর কুরাইশদের পৌত্তলিকতার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা করে ইসলাম কবুলের কথা দৃপ্তকণ্ঠে জানিয়ে দিলো ।
ইসলাম গ্রহন করার কারনে সাঈদ  রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর ওপর নেমে এলো জুলুম নির্যাতন । কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি অন্যান্য সাহাবীদের ন্যায় মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হন । মদীনায় এসে সাঈদ ইবনে আমের আল জুমাহী রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে নিজেকে কুরবান করেন । তিনি সর্বদাই প্রিয়নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন । খায়বার থেকে শুরু করে সকল জিহাদে তিনি আখেরীনবীর সাথে সাথে ছিলেন । আহমাদ মুস্তফা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সাঈদ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন । সাইয়েদুল মুরসালীন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরও সাঈদ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু আমীরুল মু'মিনীন আবু বকর সিদ্দীক রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু ও উমর ফারুক রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর খিলাফত আমলে সার্বক্ষণিক জিহাদে রত ছিলেন । খালীফাতুল মুসলিমীনদয় তাঁর তাকওয়া ও খোদাভীতি সম্পর্কে খুব ভালো করে জ্ঞাত ছিলেন এবং তাঁর পরামর্শদি গুরত্ব সহকারে গ্রহন করতেন । 
উমর ফারুক রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু যখন খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তিনি তাকে পরামর্শ দেনঃ
"হে আমীরুল মু'মিনীন ! আমি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি যে, মানুষের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করাকে ভয় করুন । আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে গিয়ে কাউকে ভয় করবেন না । সাবধান ! কথা ও কাজে বৈপরীত্য রাখবেন না । কথা অনুযায়ী যে কাজ করা হয়, তা-ই উত্তম কাজ । আমীরুল মু'মিনীন ! মানুষের কল্যানের জন্য খলীফা নিযুক্ত করা হয়েছে তাই তাদের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য নিজেকে কুরবান করুন । আপনি ও আপনার পরিবারের জন্য যা পছন্দ করেন তাদের জন্যও তা পছন্দ করুন । আর নিজের জন্য যা অপছন্দ করেন, তাদের জন্যও তা অপছন্দ করুন । বাধার পাহাড় অতিক্রম করতে হলেও সত্যের পথে প্রতিষ্ঠিত থাকুন । আল্লাহর জন্য কারও সমালোচনাকে ভয় করবেন না" । -----চলবে--------























কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন