ইসলাম-মুসলমান বনাম সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ
আল্লাহ সুবহানাহু তা'য়ালা তাঁর অনুসরণের ক্ষেত্রে দুই ধরনের পদ্ধতি দিয়েছেন । মানুষ ব্যতীত অন্যান্য সমগ্র সৃষ্টির জন্য তাঁর আইন পালন বাধ্যতামুলক করেছেন । চিন্তাবিদগণ সাধারন দৃষ্টিতে যা বুঝে তা হলো, তিনি যদি অন্যান্য সকল সৃষ্টির জন্য তাঁর আইন অনুসরন বাধ্যতামুলক না করতেন, তাহলে মানুষসহ সমগে সৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হতো, যেমন মহাশুন্যে গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, নিহারীকাপুঞ্জ, ব্লাকহোল ও অন্যান্য যা কিছুই রয়েছে, এসব কিছুর পরিভ্রমনের জন্য গতিপথ বা পরিভ্রমনের পথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, এসব পথে ওগুলো চলতে বাধ্য । ওসব সৃষ্টিসমুহের পরিভ্রমনের পথে আল্লাহ তায়ালা যদি স্বধীনতা দিতেন, তাহলে পরিভ্রমনের পথে একটির সাথে আরেকটির সংঘর্ষ ছিলো অবশ্যম্ভাবী এবং সেগুলো স্বয়ং যেমন ধ্বংস হতো তেমনি অন্যান্য সৃষ্টির জন্যও মারাত্মক ক্ষতির কারন হতো ।
অপরদিকে আল্লাহ সুবহানাহু তা'য়ালা তাঁর আইন পালনের ক্ষেত্রে একমাত্র মানুষকেই স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং সতর্ক করে দিয়ে পবিত্র কুরআনে এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে, "আলো-অন্ধকারের পথ বা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে সুস্পস্ট পার্থক্য করে দেয়া হয়েছে" । কেউ ইচ্ছা করলে আলোর পথ বা সত্যপথ অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির পথে এগিয়ে যেতে পারে, এস্বাধীনতা যেমন মানুষের রয়েছে তেমনি সে অন্ধকার পথ অনুসরণ করে পৃথিবী ও আখিরাতে নিজেকে ধ্বংসও করে দিতে পারে, এ স্বাধীনতাও মানুষের রয়েছে । একই সাথে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে মানব মন্ডলীকে এ কথাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, "ইসলামই মানুষের জন্য একমাত্র মনোনীত জীবন ব্যবস্থা" ।
সমগ্র সৃষ্টি জগতের মালিক এ কথাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, "ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো আদর্শ কেউ যদি অনুসরণ করে, তাহলে সে নিশ্চিতভাবে পৃথিবী ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে" । যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবি করবে, শান্তি, স্বস্তি ও সার্বিক নিরাপত্তার লক্ষে তাঁর জন্য আল্লাহর বিধান অনুসরণ করা অবশ্যই বাধ্যতামুলক । আল্লাহর বিধান অনুসরণ না করে কেউ যদি নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবি করে, আল্লাহ তা'য়ালার কাছে তাঁর এই দাবির কানাকড়িও মুল্য নেই । কারন 'মুসলিম ও ইসলাম' এই শব্দ দুটো একটির সাথে আরেকটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত, পরস্পর সম্পুরক এবং অবিচ্ছিন্ন । এই শব্দ দুটোর মুলেই নিহিত রয়েছে মানুষের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি, উন্নতি, প্রগতি, স্বস্তি, নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিভীষিকামুক্ত শঙ্কাহীন এক উন্নত জীবন যাপনের পরিবেশ ।
'ছিলমুন' শব্দ থেকে 'ইসলাম' শব্দের উৎপত্তি এবং এর অর্থ হলো শান্তি । আর মুসলিম শব্দের অর্থ হলো 'আত্মসমর্পণকারী' । আল্লাহ তা'য়ালা মানবমন্ডলীর শান্তি, সমৃদ্ধি, উন্নতি, প্রগতি, স্বস্তি, শঙ্কামুক্ত নিরাপত্তাপূর্ণ যে বিধানাবলী দান করেছেন, এর সমষ্টির নামই হলো ইসলাম এবং এই বিধানাবলীর নিকট যে মানুষ আত্মসমর্পণ করেছে, সে-ই হলো মুসলমান ।
সহজ কথায় সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিপরীতে শান্তি, সমৃদ্ধি, প্রগতি, স্বস্তি, উন্নতি ও নিরাপত্তা দানের নিশ্চয়তামুলক বিধানের নিকট যে মানুষ তাঁর সমগ্র সত্তাকে সমর্পণ করেছে, সেই হলো মুসলমান । এ কারনেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেনঃ 'যে ব্যক্তির হাত ও মুখের কথা থেকে অন্য মানুষ নিরাপদ নয়, সে ব্যক্তি মুসলমান নয়' ।
যে আল্লাহ তা'য়ালা মানুষের নিরাপত্তার প্রতীক ও শান্তির নিশ্চয়তামুলক জীবন বিধান ইসলামকেই মানুষের জন্য একমাত্র জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করেছেন, সেই আল্লাহ তায়ালার নিরানব্বইটি নামের মধ্যে গুনবাচক নামসমুহের একটি নাম হলো 'সালাম' অর্থাৎ শান্তিদাতা । অপরদিকে রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে 'সালাম' নামের অধিকারী আল্লাহ তা'য়ালা স্বয়ং পবিত্র কুরআনে সুরা আম্বিয়ায় ঘোষণা করেছেনঃ 'হে নবী ! আপনাকে আমি সমগ্র জগতের জন্য করুণার প্রতীক হিসেবেই প্রেরণ করেছি' ।
অর্থাৎ মহান আল্লাহ বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে 'করুণার প্রতীক তথা নবীয়ে রহমত' উপাধি দান করেছেন । তাহলে বিষয়টি এভাবেই স্পস্ট হয়ে গেলো যে, 'শান্তিদাতা' সালাম আল্লাহ তা'য়ালা সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিপরীতে শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা, সুখ- সমৃদ্ধি, উন্নতি-প্রগতি ও শঙ্কামুক্ত জীবন বিধান শান্তির আদর্শ ইসলামকে করুণার মূর্তপ্রতীক নবীয়ে রহমতের কাছে প্রেরণ করেছেন এবং তিনি এ সর্বোত্তম আদর্শ পৃথিবীতে বাস্তবায়ন করেও দেখিয়েছেন ।
আল্লাহ সুবহানাহু তা'য়ালা, নবী-রাসুলের মাধ্যমে তাঁর বান্দাদেরকে নামাজ শেষ করার আদেশও দিয়েছেন শান্তি কামনা করার মাধ্যমে । অর্থাৎ নামাজের শেষ বৈঠকে 'আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ' মুখে উচ্চারন করেই নামাজ শেষ করতে হবে । নামাজ শেষ করেই মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে যে দোয়া করতেন সে দোয়ার অর্থ হলোঃ "হে আল্লাহ ! তুমি শান্তিময় আর তোমার নিকট থেকেই শান্তির আগমন, তুমি কল্যানময়, হে মর্যাদাবান কল্যাণময় ! তোমার কাছেই আমি শান্তির শেষ আশ্রয়স্থল জান্নাত কামনা করছি" । আল্লাহর রাসুলের শিখানো এই দোয়া অধিকাংশ আলেমগন নামাজ শেষ করেই তেলাওয়াত করেন এবং মুসলমানদের মধ্যে যারা এই দোয়া মুখস্ত করেছেন তারাও করে থাকেন ।
এরপর মুসলমানদের পরস্পরের দেখা-সাক্ষাত হলেও শান্তি কামনা করার আদেশ দেয়া হয়েছে অর্থাৎ 'আসসালামু আলাইকুম' 'তোমার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক' প্রথমে বলে তারপর অন্যান্য কুশলাদি জানতে হবে । শিশুর বাক শক্তি নেই, সে জবাব দিতে পারবে না তবুও তাকে সালাম জানাতে হবে অর্থাৎ তাঁর জন্য শান্তি কামনা করতে হবে । মানুষ ইন্তেকাল করলে জানাযা আদায় করার সকল দোয়া সমুহেও মৃতের জন্য শান্তি কামনা করতে হয় । মুসলমানদের কবর দেখলে বা জিয়ারত করার সময় কবরবাসীকে আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর অর্থাৎ কবরবাসীর জন্য শান্তি কামনা করতে হবে ।
মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম পবিত্র কা'বার দোয়া কবুলের স্থানে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন । সুরা বাকারার ১২৬ আয়াতে আছে, ইব্রাহীম যখন বলেছিলো, হে মালিক ! এ শহরকে তুমি শান্তিময় ও নিরাপত্তার নগর বানিয়ে দাও ।
যে জাতির পিতা স্বয়ং সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহর শাহী দরবারে ধরনা ধরেন, সেই জাতি কি সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদে নিজেদেরকে জড়াতে পারে ? ইসলাম মানুষকে আল্লাহ তা'য়ালার কাছে সহজ-সরল শান্তির পথ কামনা করতে শিক্ষা দিয়েছে । নামাজ আদায়কারী ব্যক্তিগন প্রত্যেকদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে বারবার সুরা ফাতিহা তেলাওয়াত করে থাকেন । এই সুরার মাধ্যমে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে থাকেনঃ 'তুমি আমাদের সহজ-সরল ও অবিচল পথটি দেখিয়ে দাও' ।
যে মুসলমান প্রত্যেকদিন ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাত নামাজেই সুরা ফাতুহার মাধ্যমে ৩২বার মহান আল্লাহর কাছে কাঁতর কন্ঠে আবেদন করে "আমাদের সহজ-সরল ও অবিচল পথটি দেখাও" সেই মুসলমানের পক্ষে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী বা জঙ্গিবাদী তৎপরতার পথে অগ্রসর হওয়া কি সম্ভব ? প্রকৃত মুসলমানদের সাথে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের ঐ দুরত্ব রয়েছে, যে দুরত্ব পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে রয়েছে । ইসলামের নামে যে বা যারা সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী তৎপরতা চালাচ্ছে, তারা না জেনে অথবা ইসলামের দুশমনদের হাতের পুতুল হিসেবেই চালাচ্ছে । বলাবাহুল্য ইসলাম ও ইসলামপন্থিদের বদনাম করার লক্ষেই শত্রুপক্ষ মুসলিম নামধারী এসব লোককে ব্যবহার করছে ।
ইসলামের ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর প্রত্যেক পরিসরে ও মুসলিম জীবনের সুচনা এবং সমাপ্তি তথা দুনিয়া-আখিরাতের সবস্থানে শধু শান্তি কামনা ও প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে । সেই ইসলামে সন্ত্রাসবাদ আর জঙ্গিবাদের গন্ধ অনুসন্ধান করা, আল্লাহর আইন চালুর নামে মানুষ হত্যা করা, দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করা, একমাত্র মূর্খ, জাহিল, জ্ঞানপাপী, ইসলাম-মুসলমান ও দেশের শত্রুদেরই কাজ হতে পারে । আর যারা নিজেকে মুসলমান দাবি কোরে ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের পথ অনুসরণ কোরে দেশে বিশৃঙ্খল ও বিপর্যয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, তারা স্পষ্টতই ভ্রান্ত পথের অনুসারী এবং এ পথ গিয়েছে জাহান্নামে । বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এসব লোকদের জন্য আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ "তাদেরকে যখনই বলা হয়েছে 'তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না' তখনই তারা বলেছে ' আমরা তো সংশোধনকারী মাত্র । (সুরা বাকারা -১১)
সন্রাস আর জঙ্গিবাদ নির্ভর পথ অনুসরণ করে বোমা বিস্ফোরন ঘটিয়ে মানুষ হত্যাকারীদের যখন বলা হচ্ছে, 'তোমরা কেনো এই বিপর্যয় সৃষ্টি করছো ? তারা জবাব দিচ্ছে, আমরা আল্লাহর আইন কায়েমের জন্য এই কাজ করছি' । অর্থাৎ অশান্তি সৃষ্টিকারী অন্য সকল আইন বাতিল করে আল্লাহর শান্তিময় আইন কায়েমের লক্ষে এসব করছি । এসব মূর্খ জাহিলরাই যে প্রকৃত অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী, এই চেতনাই এদের মধ্যে নাই । এসব চেতনাহীন দুষ্কৃতিদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ১২ আয়াতে বলেনঃ "সাবধান ! প্রকৃতপক্ষে এরাই বিপর্যয় সৃষ্টিকারী, কিন্তু এর কোনো চেতনাই তাদের নেই" ।
ইসলামের দুশমন কর্তৃক বিভ্রান্ত হয়ে বোমাবাজ মানুষ হত্যাকারী সন্ত্রাসীরা ইসলামের নামে দেশে যে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে এবং নিজেকে যে নবীর উম্মত তথা অনুসারী হিসেবে দাবি করছে, সেই নবীয়ে রহমত সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ "রাসুলের জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ" । নিশ্চয় তুমি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী । তুমিই সবথেকে সহজ-সরল পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত ।
যে মহামানবকে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বোত্তম আদর্শের অধিকারী ও করুণার মূর্তপ্রতীক হিসেবে সনদ দিয়েছেন, সেই মহামানব রহমাতুল্লিল আলামীনের অনুসারী হিসেবে নিজেকে দাবি করে বোমা বিস্ফোরন ঘটিয়ে কিংবা মানুষের গলা কেটে হত্যা করে এবং নিজেকে হত্যা করে 'জান্নাতে যাবার' প্রলোভন যারা দেখাচ্ছে, তাদের পরিচয়, তারা ইসলাম-মুসলমান, দেশ-জাতি ও সমগ্র মানবতার দুশমন । সচেতন মহলের চোখগুলোকে সিসি টিভিতে পরিণত করে এদেরকে ধরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দিতে হবে এবং এদের ওপর কুরআন ঘোষিত বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের সাথে সম্পর্কিত সর্বোচ্চ দন্ড প্রয়োগ করাই বর্তমান সময়ের দাবি । ***** চলবে *****
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন