তারাবির পরিচয়ঃ হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন: তারাবিহ শব্দটি তারবিহাতুন এর বহুবচন । তারবিহাতুন অর্থ একবার বিশ্রাম গ্রহণ করা। যেমন: তাসলিমাতুন অর্থ একবার সালাম দেয়া। মাহে রামাযানের বরকতময় রজনীতে জামাতের সঙ্গে যে নামায পড়া হয় তাকে তারাবি বলে। (ফাতহুল বারী, কিতাবু সালাতিত তারাবি ৪/২৯৪) আল মানার প্রণেতা বলেন: তারাবিহ বহুবচন; একবচন তারবিহাতুন, অর্থ বসা, তারাবির নামাযে প্রতি চার রাকাত অন্তর বসা। তারাবির আভিধানিক অর্থঃ তারাবি আরবী শব্দ। মূলধাতু রা-হাতুন; অর্থ প্রশান্তি অন্যতম ধাতু রাওহুন। সন্ধারাতের প্রশান্তি বা প্রশান্তির বৈঠক; যা রামাযান মাসে তারাবীহর নামাযে প্রতি চার রাকাত পরপর করা হয়ে থাকে। বহুবচন:‘তারাবি’ প্রশান্তির বৈঠক সমূহ। (আল মুনজিদ)নামকরণ: যখন থেকে সাহাবায়ে কেরাম এ নামায সম্মিলিতভাবে আদায় করতে আরম্ভ করেন তখন থেকেই তারা প্রতি দু’সালামের পর (চার রাকাতের পর) বিশ্রাম নিতেন ।
তাই এ নামাযের নাম তারাবি বলে করা হয়েছে । (ফাতহুল বারী)তারাবির গুরুত্ব ও ফযিলতহাদিসের ভাষ্যানুযায়ী আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য অর্জনের প্রধান মাধ্যম হল ফরয ইবাদত ও ফরয দায়িত্ব সমূহের ব্যাপারে যন্তবান হওয়া। অতঃপর সুন্নত ও নফলের মাধ্যমে যে পর্যায়ের নৈকট্য লাভের কথা হাদিসে এসেছে তাও অন্তরকে জাগ্রত করার জন্য এবং মানবাত্মাকে ব্যাকুল করার জন্য যথেষ্ট। যার সারাংশ হল ইখলাসে নিয়তের সাথে সুন্নত ও নফলের প্রতি মনোযোগি হলে বান্দার রুচি ও স্বভাব দুরস্ত হয়ে যায় । ফলে রেজায়ে খোদাওন্দীই হয় তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য। তার প্রতিটি আমাল হয় প্রভু সন্তুষ্টির অনুগামী। তার প্রতি থাকে খোদায়ী মহব্বত ।
এ ব্যাপারে ইরশাদ হচ্ছে- ‘কেউ যদি আমার ওলী (বন্ধুর) সাথে দুশমনি করে তবে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা দিচ্ছি। (সহিহ বুখারী: ১১/৩৪০-৩৪১ ফাতহুল বারী, মাজমাউল ফাতাওয়া: ১৮/১২৯-১৩১)রামাযানুল মুবারক হচ্ছে রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের বসন্তকাল। এর বাস্তবাবস্থা শব্দ ও বাক্যের কথা মালায় প্রকাশ করা অসম্ভব। মহান রাব্বুল আলামিন কোরআনে কারিমে দ্বারা রামাযানে রোযা রাখার ফরযিয়াত ঘোষণা করেছেন এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)’র পবিত্র যবানে ‘কিয়াম’ যাকে কিয়ামে রামাযান বা তারাবি বলে। সুন্নত বানিয়েছেন। বিভিন্ন হেকমত এর ভিত্তিতে সুন্নতে মুআক্কাদাহ রাখা হয়েছে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই যে, রামাযানের পূর্ণ বরকতের সাগরে গা ভেজাতে হলে তারাবির ব্যাপারে অবশ্যই যন্তবান হতে হবে।
এ কারণেই মুমিন বান্দা রামাযান ও কোরআনের হক আদায়ের জন্য, রোযার মাধ্যমে তাক্বওয়া হাসিলের জন্য, আল্লাহর অফুরন্ত রহমত ও মাগফিরাতের রারিধারায় সিক্ত হওয়ার জন্য, খোদায়ী মহব্বতের হক আদায়ের জন্য, সর্বোপরি আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সালাতুত তারাবিতে মগ্ন হয়ে থাকে। পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে ও পূণ্যতা লাভের আশায় এবং বিনয় ও নম্রতার সাথে রামাযানের রাত সমূহে (নামাযে) দাঁড়ানো ও সেজদায় মাথা অবনত রেখে সময় কাটাতে থাকে এবং এর মাধ্যমে মহান প্রভুর সাথে দীর্ঘক্ষণ একান্ত আলাপচারিতায় প্রভু প্রেমের তৃঞ্চা নিবারণ করে ক্বলবের পরিতৃপ্তি লাভে সক্ষম হয়।
এ থেকে তারাবির গুরুত্ব দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, সুন্নত ও নফলের সাধারণ নিয়মের বাইরে ফরয নামাযের মত জামাত হয়েছে। তবে রাসূলে মাক্ববুল (সা.) নিজে জামাতের ব্যবস্থা এ জন্য করেননি যে, তা যদি আবার উম্মতের উপর ফরয হয়ে যায়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, সালাতুত তারাবির মাকাম সাধারণ নফল ও অন্যান্য সুন্নত থেকে উর্ধ্বে। মোটকথা অনেক দলীল ও প্রমাণাধীর ভিত্তিতে মুফতিগণ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, তা সুন্নতে মুআক্কাদাহ। হাল যামানায় কিছু লোক ইসলামের লেবেল গায়ে ঝুলিয়ে সাধারণ মুসলমানদেরকে এ কথার সবক শেখাচ্ছে যে, তা সাধারণ নফলের মত। না পড়লে কোন গুনাহ নেই। দোহাই লাগে এসব মিথ্যা আর প্রোপ্রাগান্ডার শিকার হয়ে নিজের আমালকে ধ্বংস করবেন না। রামাযানে আমালের পাল্লা ভারী করতে আসুন নিজে সচেতন হই।
প্রিয় পাঠক বৃন্দ! আমরা সবাই এ কথা জানি যে সালাতুত তারাবি হচ্ছে ২০ রাকাত। শুধু জানাতেই শেষ নয়, বরং আমরা ২০ রাকাত তারাবি আদায়ে খুব অভ্যস্ত বটে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গত দুয়েক বছর ধরে আমাদের শাহজালালের পূণ্যভূমির প্রায় সবকটি পাড়া-মহল্লার মসজিদে ‘আহলে হাদিস’ নামধারী মহল তাদের নিজ অর্থায়নে সাধারণ মুসলমানদের ঈমান-আকিদা নষ্ট করার জন্য তারাবি নামায ৮ রাকাত বলে লিফলেট, বই, প্রকাশ করে তা বিনামূল্যে হাতে তুলে দিচ্ছে।
আসুন সহীহ হাদিসের আলোকে জেনে নেই সালাতুত্ তারাবিহ রাকাত সংখ্যা কত?
রাকাআতে তারাবিঃ একটি সন্ধানী পর্যালোচনাশাসনের নামে শোষক ইংরেজদের পদার্পণ এ জমিনে ঘটার পূর্বে কিছু বলার বা লিখার প্রয়োজন ছিল না। কেননা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত এমনকি গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে প্রতিটি অলিগলির বাসিন্দাদের কাছে মুতাওয়াতির তরিকায় ২০ রাকাত তারাবি আদায়ের কথা পৌঁছেছে। আর আজও আদায় হচ্ছে বিশ্বের সবকটি মসজিদে। সে যুগে কোন কোন মসজিদে বিশ রাকাতের অধিক ও পড়া হত; তবে বিশ রাকাতের কম পড়া হত কেউ দেখাতে পারবেনা। মুখস্ত আর শিখিয়ে দেয়া বুলি ছোঁড়ে নিজেকে ‘হাদীস অনুসারী’ দাবী করা নিতান্তই বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। এই জামাতের নাম ‘আহলে হাদীস’।
মুসলমানদের ঐক্যে ফাঁটল সৃষ্টি করাই হচ্ছে এই দলের মূল লক্ষ্য। তাদেরই একজন তারাবি সংক্রান্ত মাসআলায় লিখেছে বিশরাকাত। (গোলাম রাসূল রচিত ‘রেসালায়ে তারাবি)ভারতবর্ষের পরে এ নিয়ে কথার্বাতা শুরু হয় আরবজাহানে। আহলে হাদীস তথা লা-মাযহাবিরা শায়খ আলবানিকে গুরু হিসেবে সম্মান করে থাকেন। তার রচিত গ্রন্থকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। সেই আলবানিও আট রাকাতের পক্ষে কোন সাহবী, তাবেঈ, ফক্বীহ বা ইমাম এর নাম উল্লেখ করতে পারেন নি। তবে ইলমের আমানতদারীতে খেয়ানত করে এ ক্ষেত্রে ইমাম মালিক (রাহ.) এর নাম উল্লেখ করে বলেন যে, তিনি নাকি বিশ রাকাত তারাবি পড়তে বাধা দিতেন। ইন্নালিল্লাহ! অথচ ইমাম মালিক (রাহ.) র মাযহাবের মৌলিকগ্রন্থ ‘আল্-মুদাওওনা’ গ্রন্থে স্পষ্ট বর্ণিত আছে তিনি তারাবির নামায বিতর তিন রাকাতসহ মোট ৩৯ রাকাত পড়তেন। মদীনার তখনকার আমির কমাতে চাইলে তিনি নিষেধ করেন। (আল্-মুদাওওয়ানাতুল কুবরা: ১/১৯৩)হিন্দুস্থানের সবচেয়ে বড় মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা হাবিবুর রহমান আজমি (রাহ.) ‘রাকাআতে তারাবি’ নামক একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থে সাহাবী যুগ থেকে শুরু করে লা-মাযহাবী ফিৎনার জন্ম হওয়ার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে ১২০০ শত বছরের ‘আমালে মুতাওয়াররাস’ উম্মতের সম্মিলিত, অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা এক এক শতাব্দি করে দেখিয়েছেন যে, আট রাকাতে সীমাবদ্ধ রাখা এবং বিশ রাকাতের উপর আপত্তি করা কোন পূর্বের শতাব্দিগুলোতে ছিল না। হাদীসবিরোধী আহলে হাদিস তথা লা-মাযহাবিদের আবিস্কার। আল্লামা হাবিবুর রহমান আজমি (রাহ.)’র এই গ্রন্থ ১৩৭৭ হিজরিতে প্রথম প্রকাশিত। এই গ্রন্থে যে দলিল প্রমাণ দেখানো হয়েছে তা খন্ডন করার তো দূরের কথা। অর্ধ শতাব্দি পেরিয়ে গেছে এই গ্রন্থের জবাবে টু শব্দ করেননি কেউ।
তারাবির নামাযঃ ২০ রাকাত হওয়ার দলীলসহিহ হাদিসে রাসূলে কারিম (সা.) নিজ সুন্নতের পাশাপাশি খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে অনুসরণ করার এবং তা মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে- মনে রেখো! আমার পরে তোমাদের যারা জীবিত থাকবে, তারা বহু মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন আমার সুন্নত ও আমার খলিফাগণের সুন্নতকে আঁকড়ে ধরে রাখবে। একে অবলম্বন করবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে রাখবে ...। (সুনানে আবুদাউদ, হাদীস নং ৪৬০৭, জামে তিরমিযী ৫/৪৩হাদিস নং ২৬৭৬; সুনানে ইবনে মাজা হাদিস নং ৪২)জামে তিরমিযির ২২২৬ নং হাদিসে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’র ইন্তেকালের পর খেলাফতের মেয়াদ ত্রিশ বছর হওয়ার ঘোষণা স্বয়ং নবীজি দিয়েছেন। সে হিসেবে খুলাফায়ে রাশেদীন চারজন ১. সিদ্দিকে আকবর (রা.) ২. ফারুকে আযম (রা.) ৩. উসমান (রা.) ৪. আলী (রা.)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন