***রোহিঙ্গা শব্দের উৎসঃ
রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি গল্প রয়েছে, সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি । আর এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা ।
রোহিঙ্গাদেরকে আবার ‘রুইঙ্গা’ ও বলা হয়ে থাকেঃ
১৭৯৯ সালে প্রকাশিত "বার্মা সাম্রাজ্য"তে ব্রিটিশ ফ্রাঞ্চিজ বুচানন-হ্যামিল্টন উল্লেখ করেন, "মুহাম্মদ (সঃ) - এর অনুসারীরা", যারা অনেকদিন ধরে আরাকানে বাস করছে, তাদেরকে "রুইঙ্গা" বা "আরাকানের অধিবাসী" বলা হয় ।
***রোহিঙ্গাঃ মিয়ানমারে এক ঘৃণিত নাম
জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী । মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী 'কালা' নামে পরিচিত । বাঙালিদেরও তারা 'কালা' বলে । ভারতীয়দেরও একই পরিচিতি । এ পরিচয়ে প্রকাশ পায় সীমাহীন ঘৃণা ।
***আরাকানে ইসলামঃ
রোহিঙ্গারা পশ্চিম মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের একটি উলেখযোগ্য মজলুম মুসলিম জনগোষ্ঠী ।
আরাকানের মুসলিম ঐতিহ্যের রয়েছে সুপ্রাচীন এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস । সর্বপ্রথম হজরত আবু ওয়াক্কাস ইবনে ওয়াইব (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় (৬১৭-৬২৭ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে) আরাকান অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আসেন । ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.)-এর শাসনামলে আরাকানের শাসকদের সঙ্গে আরবীয় মুসলমানদের যোগাযোগের বিষয়টিও প্রমাণিত । তবে দশম ও একাদশ শতাব্দীতে আরব বণিক ও সুফি-সাধকদের ব্যাপক আগমনের ফলে আরাকান অঞ্চলে দ্রুত ইসলামের প্রচার হতে থাকে ।
***ইংরেজদের রোষানলে রোহিঙ্গাঃ
১৬৬৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে চার হাজার বছর আরাকান ছিল একটি সার্বভৌম ও মুসলিম প্রধান দেশ । ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে আরাকান ব্রিটিশের অধীনে চলে যায় । আর এর পর থেকে শুরু হয় তাদের রক্তভেজা ইতিহাস । তবে মাসিক ইতিহাস অন্বেষা নামক একটি সাময়িকী তে বলা হয়েছে- ১৬৬৬ সালের কথা । এতে আরো বলা হয়েছে- ১৭৮৫ সাল থেকে ১৮২৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে বার্মার শাসন ছিল । তার মানে ব্রিটিশ শাসনের আগেও রোহিঙ্গারা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছিল ।
***ধোঁকাবাজির শিকারঃ
ইংরেজরা স্বভাবগত ভাবে বরাবরই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছে । স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি পেয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আরাকানের মুসলমানরা ইংরেজদের পক্ষাবলম্বন করেছিল । কিন্তু ব্রিটিশরা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি । সেই যে শুরু হয়েছিল, রোহিঙ্গাদের রক্তভেজা ইতিহাস আজো রচিত হচ্ছে । বরং রচনার সে গতি আজ তীব্র থেকে তীব্রতর । চারদিক থেকে ধেয়ে এসেছে তাদের উপর আজ জুলুমের তুফান । আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে তাদের বুকফাটা কান্নায় । মানবতা লাথি খাচ্ছে আরাকানে । দেখবার,শুনবার কেউ নেই । শিশুদের চাপা কান্নায় কাঁপছে না মুসলমান, কাঁপছে না বিশ্ব বিবেক । তবে মজলুমের ফরিয়াদ বৃথা যায় না । হয়তো কোন একদিন এমন আসবে, এ রক্তের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের জীবনের আকাশে হেসে উঠবে ভোরের সূর্য ।
আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর ইতিহাসের বর্বর, অমানবিক ও রোমহর্ষক নির্যাতনের ঘটনা এখন ‘টক অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’। মানবতাবিরোধী এমন কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিবেক আজ স্তব্ধ ও হতবাক ! এ যেন আধুনিক জাহেলিয়াতের আরেক নমুনা । মুসলিম নর-নারী আর শিশু-কিশোরদের আর্তনাদে আল্লাহর আরশ কাঁপছে ! কিন্তু ইয়াজিদের মতো মন গলছে না এ সমাজের নব্য ফেরাউন আর নমরুদের উত্তরসূরিদের । কারণ একটাই—নির্যাতিত, বঞ্চিত আর অবহেলিত ওরা তো মানুষ নয়, ওরা মুসলমান ! এখানে জাতিসংঘ, বিশ্বমানবাধিকার সংস্থা আর বিশ্ব মোড়লদের বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়া ছাড়া যেন আর কিছুই করার নেই । অথচ রোহিঙ্গা আজ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা । শাসকদের অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে মানুষ আজ সাগরে মরতে রাজী তবুও নিজ দেশে যেতে রাজি না ।
খ্রিস্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ অব্দ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আরাকান ছিল বাঙালি মুসলমানদের গড়া এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এখানে মগ এবং মুসলমানের মধ্যে অতীত ইতিহাসে সম্প্রীতির কোনো অভাব ছিল না। ম্রোহং (রোহাং) শহর ছিল আরাকানের রাজধানী। মহানবী (সা.)-এর জীবিতকালেই আরবদের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে আরব বণিকদের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলগুলোর বাণিজ্যিক যোগাযোগের মাধ্যমে আরবীয় দ্বীপগুলোতে মুসলমানরা আলাদা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ রাজ্যের শাসকের উপাধি ছিল ‘সুলতান’। আরাকান মূলত ইসলামী রাষ্ট্রের আদলে গড়ে ওঠা প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি শহর। কিন্তু আজ নিজ মাটিতেই মুসলমানরা পরাধীন ।
কথিত আছে, এ বংশের রাজা মহত ইং চন্দ্রের রাজত্বকালে (৭৮৮-৮১০) মুসলমানদের কয়েকটি বাণিজ্য বহর রামব্রী দ্বীপের তীরে এক সংঘর্ষে ভেঙে পড়ে । জাহাজের আরবীয় আরোহীরা তীরে এসে ভিড়লে রাজা তাদের উন্নততর আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে আরাকানে বসতি স্থাপন করান । আরবীয় মুসলমানরা স্থানীয় রমণীদের বিয়ে করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন । আরবীয় মুসলমানরা ভাসতে ভাসতে কূলে ভিড়লে পর রহম, রহম ধ্বনি তুলে স্থানীয় জনগণের সাহায্য কামনা করতে থাকে । বলাবাহুল্য রহম একটি আরবি শব্দ—যার অর্থ দয়া করা । কিন্তু জনগণ মনে করে, এরা রহম জাতীয় লোক । রহম শব্দই বিকৃত হয়ে রোয়াং হয়েছে বলে রোহিঙ্গারা মনে করে থাকেন । এভাবেই আরাকানের গোড়াপত্তন ।
বঙ্গদেশের করদরাজ্য হিসেবে আরাকানকে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে সূচিত হয় এক মহাযুগের, কিন্তু অষ্টাদশ শতকে বার্মার অধীন একটি প্রদেশ হিসেবে শাসিত হয়ে আরাকানিদের যেমন লাভ করার কিছুই ছিল না, তেমনি আরাকানিদের মতো এমন এক জাতিকে শেখানোর মতো বর্মীদেরও কিছুই ছিল না । কারণ আরাকানি জাতি কয়েক শতাব্দী ধরে জ্ঞান-গরিমার উচ্চশিখরে আরোহণকারী মুসলিম সমাজের ঘনিষ্ঠ সংশ্রবে ছিল । এ সময় বর্মীরা ছিল বিচ্ছিন্ন ও পশ্চাত্পদ একটি জাতি । ভোদাপায়া আরাকান দখল করে এ স্বাধীন অবস্থার বিলুপ্তি ঘটান । অথচ ঘা-থানডির সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ছিল, ভোদাপায়া আরাকানের স্বাধীন অবস্থা অক্ষুণ্ন রাখবেন আর বিনিময়ে আরাকান বার্মার রাজাকে বার্ষিক কর প্রদান করবে—যেমনটি করেছিল ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের গৌড়ের সুলতান জালালউদ্দিন শাহ । যা হোক, ভোদাপায়া ১৭৮৪ সালে আরাকান দখল করে বার্মাকে একটি প্রাদেশিক রাজ্যে পরিণত করলেন এবং ঘা-থানডিকে নিয়োজিত করলেন প্রাদেশিক গভর্নর হিসেবে ।
ভোদাপায়ার আরাকানের ক্ষমতা দখলের মাত্র এক বছরের মধ্যেই ঘা-থানডির ওপর এসে যায় আরেক প্রবল অথনৈতিক আঘাত। ভোদাপায়া শ্যাম রাজ্য (বর্তমান থাইল্যান্ড) আক্রমণের জন্য চল্লিশ হাজার সৈন্য ও চল্লিশ হাজার মুদ্রা চেয়ে ঘা-থানডির ওপর প্রজ্ঞাপন জারি করলেন । প্রকৃতপক্ষে প্রকট দারিদ্র্যের সর্বনিম্ন অবস্থানে নিপতিত আরাকানের জনগণের পক্ষে এর শতাংশ ভাগ পূরণও সম্ভব ছিল না । চাপের মুখে ঘা-থানডির দাবির অর্ধেক কোনোভাবে পূরণে রাজি হলে ভোদাপায়া রাগান্বিত হয়ে ঘা-থানডির এক ছেলেকে হত্যা করেন। পুরো দাবি আদায় না হলে পরিবারের সবাইকে অনুরূপ হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেন ।
এতে ভীত হয়ে ঘা-থানডি কয়েক হাজার অনুচর নিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধিকৃত সীমান্তবর্তী কক্সবাজার জেলার গভীর পার্বত্য অঞ্চলে । আর এরই সঙ্গে শুরু হয় আরাকানিদের মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রাম । অদৃষ্টের পরিহাস—যার অনুপ্রেরণায় ভোদাপায়া আরাকান দখল করলেন, তারই নেতৃত্বে মাত্র এক বছরের মধ্যে শুরু হলো একটি স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস । মূলত দীর্ঘদিনের স্বাধীনতা হারিয়ে এবং আরাকানিদের ওপর বর্মী সৈন্যদের চরম নির্যাতন এবং জনগণের ওপর ভোদাপায়ার অতিরিক্ত কর আরোপ প্রভৃতিতে আরাকানের জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে । আরাকান থেকে লুণ্ঠিত মাল ও বিশাল মহামুনি মূর্তি দুর্গম পার্বত্য পথ দিয়ে বার্মার মান্দালয়ে স্থানান্তর করতে হাজার হাজার মগ-মুসলিম আরাকানিদের জোর করে নিয়োগ করা হয়। দুর্গম গিরিপথ দিয়ে এ স্থানান্তরের কাজ ম্রোহং থেকে মানাদলয় পর্যন্ত পথ আরাকানিদের লাশে ভরে গিয়েছিল । এখনও ম্রোহং আন গিরিপথ পর্যন্ত এলাকা জনবসতি বিরল ।
আজ রোহিঙ্গাদের জন্য যেন কোনো আইনকানুন নেই । আইন যেন আজ নীরবে নিভৃতে কাঁদে । কারণ মুসলমানদের জন্য আইন নয় ! আইন এখানে অকেজো, বিবেক এখানে ভোঁতা । মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব দৃশ্য আর মানুষের বোবা কান্না যেন মানব সভ্যতাকে ভাবিয়ে তুলছে ! প্রতিটি রোহিঙ্গা মুসলমানের কান্নার আওয়াজ আমাদের আধুনিক সভ্যতার গালে এক-একটি চপেটাঘাত করে বলছে—হে আধুনিক পৃথিবীর মানবসমাজ! তুমি মুসলমানদের জন্য বড়ই অমানবিক। হে সভ্যতা! তুমি এখনও মুসলমানদের জন্য অনেক বর্বর । অথচ এই পৃথিবীতে মানবিকতা, ইনসাফ আর মজলুমের অধিকার আমরাই নিশ্চিত করেছি । প্রশ্ন হচ্ছে, আরাকানের নির্যাতিত, নিপীড়িত আর বঞ্চিত মুসলমানদের জন্য বিশ্বের ঘুমন্ত বিবেক জাগবে কবে ? কবে ফিরে পাবে আরাকানের মুসলমানরা তাদের হারানো স্বাধীনতা ?
কিন্তু কতদিন পর ? একমাত্র আল্লাহই ভাল জানেন । আমাদের মুসলিমদের উপর কেন এত অত্যাচার কেন এত নির্যাতন তা একমাত্র আমরা মুসলিমরা একতা মাঝে নেই বলে ।
হে আল্লাহ আমাদের সবাইকে এক করে দাও । মায়ানমারের মুসলমান ভাই বোনেরা আমাদের ক্ষমা কোরো । ভয়ংকর এই বিপদের দিনেও তোমাদের পাশে আমরা থাকতে পারছি না । ইয়া আল্লাহ ! মায়ানমারের মুসলিম ভাই ও বোনদের হেফাযত কর । _আমীন_** সুত্রঃ উইকিপিডিয়া, উইকিপিডিয়া মুক্তবিশ্বকোষ, কালের কন্ঠ, দৈনিক সোনার বাংলাদেশ (ঢাকা থেকে প্রকাশিত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন