সোমবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৫

কামারুজ্জামানের দন্ড মিডিয়ার উল্লাস ও বিপরীত চিত্র


ফাঁসি কার্যকরের আগে মুহাম্মদ কামারুজ্জামান কতগুলো উক্তি করে গেছেন। উক্তি গুলোতে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অনেক বার্তা রয়েছে। প্রাণ ভিক্ষার ব্যাপারে তিনি সুস্পস্ট বলেছেন জীবনের মালিক একমাত্র আল্লাহ। মানুষের জীবনের মালিক অন্য কেউ নয়। তিনি জানতেন ফাঁসি নিশ্চিত। কয়েক ঘন্টা পরই কার্যকর হবে সেই দন্ড। সেটা জানার পরও তিনি স্পস্ট ভাষায় পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে দিলেন আল্লাহ ছাড়া জীবনের মালিক আর কেউ নয়। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে পরিবারের সদস্যদের বরং তিনি ধৈর্য্য ধারনের পরামর্শ দিলেন। অন্যায় অবিচারের কাছে মাথানত না করে তিনি হাসিমুখে ফাঁসি আলিঙ্গন করলেন। আপসের চোরাবালিতে নিজেকে সপে না দিয়ে শাহাদাতের রাস্তা খুজলেন। 
বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী তাঁর স্ত্রীকেও কিছু পরামর্শ দিলেন। বিশেষ করে স্ত্রীকে শান্তনা দিয়ে তিনি বললেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যেতে পারতেন। কোন অসুস্থতা জনিত কারনে তাঁর মৃত্যু হতে পারত। বা অন্য যে কোন কারনেই জীবন চলে যেতে পারে। কিন্তু আল্লাহর দ্বীন কায়েম করতে গিয়ে ফাঁসি আলিঙ্গন করা অত্যন্ত মর্যাদার। স্ত্রীকে তিনি আরো বলেছেন তিনি জানতেন ইসলামী আন্দোলনের পথ অনেক বন্ধুর। এই পথে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়। এসব জেনে বুঝেই তিনি ইসলামী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর প্রণাপ্রিয় সংগঠনের কর্মীদের তিনি ধৈর্য্য ধারণ এবং জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার পরামর্শ দিয়েছেন। 
এর আগে একই সংগঠনের নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তিনিও সর্বশেষ আইনি সুযোগ রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা বা প্রাণ ভিক্ষা চাননি। তিনিও অবিচল আস্থার প্রমান রেখে বলেছিলেন জীবনের মালিক হলেন একমাত্র আল্লাহ। আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর তাঁর মামলার মূল সাক্ষী মোমেনা বেগমকে নিয়ে কিছু আলোকপাত করেছিলাম। অর্থাৎ মোমেনা বেগমের সাক্ষীর উপর ভিত্তি করেই আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসির আদেশ দেয় আপিল বিভাগ। মোমেনার জবানী ৩ জায়গায় ৩ রকমের ছিল। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর বহু আগেই মোমেনার একটি জবানবন্দি রেকর্ড করেছিল। সেটা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত ছিল। মামলার ডিফেন্স পক্ষ এটা সংগ্রহ করে আদালতের কাছে পেশ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের সংরক্ষিত জবানবন্দিতে মোমেনার উক্তি হচ্ছে তাঁর পরিবারের হত্যাকান্ডের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন না। স্বামীর বাড়িতে ছিলেন। যে কারনে পরিবারের সদস্যদের হত্যাকান্ডের বিষয়ে অন্যদের নিকট থেকে শুনেছেন। ট্রাইব্যুনালের মামলার তদন্তকারী সংস্থার কাছে মোমেনার জবানবন্দি একটু ভিন্ন। তবে সেই জবানবন্দিতেও তিনি আবদুল কাদের মোল্লার নাম বলেননি। আর সর্বশেষ ট্রাইব্যুনালের ক্যামেরা ট্রাইয়ালে এসে মোমেনা আবদুল কাদের মোল্লার নাম বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে তাঁর বর্ণনা এবং ট্রাইব্যুনালের কাছে বর্ণনা সম্পুর্ন বিপরীত। কোনটা সঠিক বক্তব্য সেটা নির্ধারনের মাপকাটি আসলে কি সেই সূত্র আমার জানা নেই। আমি যতটুকু জানি কাউকে ফাঁসি দিতে হলে সন্দেহাতীত প্রমাণ থাকতে হয়। একই ঘটনায় সাক্ষী মোমেনার ৩ জায়গায় ৩ রকমের বক্তব্যে ঘটনার সন্দেহাতীত প্রমাণ হয় না- এটাই স্বাভাবিক। তারপরও আপিল বিভাগে এই প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছিল। বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা রিভিউ শুনানীতে এ প্রেক্ষিতে বলেছিলেন আমাদের বিশ্বাস হয়েছে বলেই ফাঁসির আদেশ দিয়েছি। 
মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা হয়েছিল একটা দিবালোকের মতই সত্য। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কতৃক মা-বোনদের ইজ্জত হরণ হয়েছে এটাও সত্য। রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু সংগঠন তখন পাকিস্তানের অখন্ডতার পক্ষে ছিল এটাও সত্য। এজন্য দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামী কখনো ক্ষমা চায়নি, এটাও স্পস্ট। বাংলাদেশের আপামর মানুষের আকাঙ্খা অনুযায়ী স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত করতে একটি তদন্ত হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে এই তদন্তের পর চিহ্নিত হয়েছিল ১৯৫ জন। এই ১৯৫ জনকে শিমলা চুক্তির অধীনে মুক্তি দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান নিজে। তারা নিরাপদে পাকিস্তানে চলে গেছেন। দালাল আইন অনুযায়ী কিছু লোকের বিচার হয়েছিল। গ্রেফতার হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার নাগরিক। কিন্তু তখন আবদুল কাদের মোল্লা বা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়নি কেন? এটাই হচ্ছে প্রশ্ন। তারা যদি এতবড় অপরাধী হয়ে থাকেন তখন তাদের নাম উঠে আসলা না কেন! ৪৫ বছর পর কেন শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা এতবড় অপরাধী হয়ে গেলেন! 
এই বিচারের মানদন্ড নিয়ে আমি কোন প্রশ্ন রাখতে চাই না। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবিষয়ে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছে। আমি শুধু বলতে চাই বিচারের কিছু প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য নিয়ে। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা চালাকালে সেইফ হাউস নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংবাদের প্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনালে একটি আবেদন হয়েছিল। সেইফ হাউজের তথ্য নিয়ে প্রকাশিত সংবাদে সংশ্লিস্ট কয়েজন পুলিশ সদস্যের নাম উঠে এসেছিল। এই পুলিশ সদস্যদের তলব করা হয়েছিল ট্রাইব্যুনালে। ক্যামেরা ট্রাইয়ালে তাদের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। এই সংবাদটির অনুসন্ধানী প্রতিবেদক হিসাবে ভাবছিলাম আমাকেও তলব করা হবে। ডিফেন্স পক্ষের আইনজীবীরা আবেদন করেছিলেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল আমাকে তলব করেননি। সেইফ হাউজের জালিয়াতি প্রমাণ করে বিচারের নামে অভ্যন্তরে আসলে কি ঘটেছে। 
শুধু সেইফ হাইজের জালিয়াতি নয়। এর কিছুদিন পরই ট্রাইব্যুনালের গেইট থেকে আল্লামা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষী দিতে আসা সূখরঞ্জন বালী নামে একজনকে অপহরণ করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। দিনের আলোতে তাঁকে উচ্চ আদালত প্রাঙ্গন থেকে অপহরণ করা হল। অকপটে অস্বীকার করা হল তাঁর অপহরনের ঘটনা। পরবর্তিতে সূখরঞ্জন বালীর অস্থিত্ব পাওয়া গেল ইন্ডিয়ার একটি কারাগারে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী তাঁকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী আটক করে তাঁকে সেই দেশের কারাগারে পাঠায়। সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী সুখরঞ্জন বালী ইন্ডিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। 
পরবর্তি ঘটনা আরো ভয়াবহ। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রকাশ হল বিচারপতির স্কাইপ সংলাপ। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় টানা ৫দিন ধারাবাহিক প্রকাশিত হল। ৫ম দিনে ট্রাইব্যুনাল এবং হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ নির্দেশনা দিয়ে পরবর্তি প্রকাশনীতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর পর বাকী কথোপকথন আর প্রকাশ হয়নি। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ সংলাপে উঠে এসেছে বিচারের নামে অভ্যন্তরে আসলে কি ঘটেছে। প্রকাশিত কথোপকথনে দেখা যায় বিচার নিয়ে সরকার, প্রসিকিউশন এবং ট্রাইব্যুনালের মধ্যে এক ধরনের সখ্যতা বিরাজমান। এমনকি সর্বোচ্চ আদালতও এই সখ্যতার বাইরে নয়। ২০১২ সালের কথোপকথনের একটি উক্তিতে দেখা যায় বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেন-‘সিনহা বাবু কইছে ডিসেম্বরের মধ্যে তিনডা দিয়া লন, তারপরে আমরা আপনারে এহানে নিয়া আসি।’ বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের উক্তিতে উল্লেখিত সিনহা বাবুই কামরুজ্জামানের রিভিউ পিটিশনের রায় দিয়েছেন। আপিল বিভাগে বিচারের আগে তাঁর প্রতি অনাস্থা জানিয়েছিলেন আল্লামা সাঈদী এবং আবদুল কাদের মোল্লা। এই অনাস্থা অগ্রাহ্য হয়েছে তাদের বিচারে। যার উপর অনাস্থা ছিল তিনিই বরং মূল রায়টি রচনা করেছেন। 
যে রায় মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় সেই বিচার প্রশ্নাতীত থাকা উচিত ছিল। প্রাণ কেড়ে নেয়ার আগে কামারুজ্জামান তাঁর স্ত্রী সন্তানদের বলে গেছেন যেই ঘটনায় তাঁকে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে তার সাথে কোনভাবেই সম্পৃক্ত নন। যারা এই ঘটনা সাজিয়ে তাঁকে ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত করেছেন তাদের বিচার চেয়েছেন আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের কাছে। 
এদিকে রায় কার্যকরের পর কিছু লোকের উল্লাস প্রচারে মরিয়া মিডিয়াগুলো। উল্লাসের বিপরীতেও একটি চিত্র রয়েছে। সেই চিত্রটিকে বরং ঢেকে রাখতেই তাদের যত প্রচেস্টা। সেই বিপরীত চিত্রকে যারা প্রকাশ করার চেস্টা করছে তাদেরকেই বরং দলীয় মিডিয়া হিসাবে চিহ্নিত করার প্রয়াস চালানো হয়। জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের পর তাঁর গ্রামের বাড়িতে হাজারো মানুষের ভিড় হয়েছে। তাঁর কবরের পাশে হাজারো মানুষের আকুতি দেখা গেছে সোস্যাল মিডিয়ায়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন উপজেলা ও জেলা সদরে কামারুজ্জামানের জন্য গায়েবানা জানাযা হয়েছে। গায়েবানা জানাযা হয়েছে দুনিয়ার বিভিন্ন জনপদে যেখানে মুসলমানের বসতি রয়েছে। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো এই খবর প্রকাশ করে না। তারা শুধু এক চোখ দিয়ে দেখে। মিডিয়ার দায়িত্ব ফাঁসি দিতে উস্কে দেয়া নয়। মিডিয়ার দায়িত্ব হচ্ছে যেসব ঘটনায় ফাঁসি দেয়া হচ্ছে সেই ঘটনা গুলোর সত্যতা উদঘাটন করা। মিডিয়ার দায়িত্ব হচ্ছে আসল ঘটনা আঙ্গুল দিয়ে মানুষকে দেখিয়ে দেয়া। কিন্তু সত্য চেপে যাওয়াই হচ্ছে যেন বাংলাদেশের এক চোখা মিডিয়াগুলোর মূল কাজ। 
লেখক: অলিউল্লাহ নোমানঃ দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত । 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন