মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

জেলখানার চিঠিঃ ইতিহাসের দায় মিটিয়ে গেলেন মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান



জামায়াতের সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ কামারুজ্জামান জেলবন্দী অবস্থায় ২০১০ সালের শেষ নাগাদ একটি চিঠি লিখেন । আজ কামারুজ্জামানকে হত্যা করে শহীদ করা হয়েছে । কিন্তু তাঁর সেই চিঠিটি হয়ে আছে ঐতিহাসিক দলিল । বলা যায়, কামারুজ্জামান তাঁর শেষ দায়িত্বটুকুও পালন করে গেছেন সেই চিঠির মাধ্যমে ।
চিঠিতে তিনি সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতের ভবিষ্যৎ নিয়ে লিখেছেন । পেশ করেছেন সম্ভাব্য কর্মপন্থাও । দিয়ে গেছেন তাঁর সুপারিশ । আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর সবগুলো ভাবনাই একে একে সত্য প্রমাণিত হচ্ছে ।
সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে তিনি তাঁর চিঠির শিরোনাম দেন- পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল গ্রহণ সময়ের দাবি । যুদ্ধাপরাধ বিচার নাটকের প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অবস্থার দীর্ঘ বিশ্লেষণের এক পর্যায়ে তিনি বলেন–

জামায়াতের নেতৃবৃন্দকে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের মত স্পর্শকাতর ইস্যুতে বিচার করার পর জামায়াতকে সরকার নিষিদ্ধ না করলেও জামায়াতের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ হবে । দেশের ভিতরে ও বাইরে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী, বাংলাদেশ বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধীদের দল হিসাবে চিত্রিত করবে । ফলে জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে । জামায়াতের ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে পড়বে ।
জামায়াত বর্তমান সময়ে যে ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে গিয়েছে তাতে গা ছেড়ে বসে না থেকে বিকল্প পথের সন্ধান করা হিকমত ও দূরদৃষ্টির দাবী । এটা কোন ধরনের বিচ্যুতি নয়  । বরং আন্দোলনের ক্রম বিকাশের ধারাতেই নতুন কৌশল অবলম্বন করা ।


এই প্রেক্ষাপটে তিনি সম্ভাব্য তিনটি পন্থার কথা বলেন-
এক. যা হবার হবে । আমরা যেমন আছি তেমনি থাকবো ।
দুই : পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছনে থেকে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তুলবে । এই সংগঠন প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সাথে ধর্মহীন শক্তির মোকাবিলা করবে ।
তিন : আমাদের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে তারা জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াবো এবং সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেবো । অর্থাৎ একটা নিউ জেনারেশন জামায়াত হবে এটি ।

এই তিনটি পন্থার বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন-
আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় উপরোক্ত তিন অবস্থায় প্রথমটা হচ্ছে নেতৃত্ব আঁকড়ে থাকা, হতবুদ্ধিতা এবং হতাশাবাদিতা। একটি গতিশীল আন্দোলন এ ধরনের পশ্চাৎমুখী অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না।
এক নম্বর যে বিকল্প উল্লেখ করা হয়ছে সেভাবে হাল ছেড়ে দিলে আমরা অথর্ব প্রমাণিত হবো। তখন সময় চলে যাবে। সুতরাং সময় থাকতেই আমাদের সতর্ক হতে হবে।
তিন নম্বর যে বিকল্পের উল্লেখ করেছি সেটাও সমাধান নয়। শুধু স্থানীয় অধার্মিক শক্তি নয় বরং আন্তর্জাতিক ধর্মহীন শক্তিও আমাদের জন্য বড় অন্তরায়। তারাও ওৎ পেতে আছে কিভাবে আমাদের অগ্রযাত্রা রুখে দেয়া যায়। আর এ কারণেই এই বিকল্প পন্থা এখন আমাদের জন্য খুব সহায়ক হবে না। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জনের দিকটা সামনে রেখেই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
তৃতীয় যে পন্থা নতুন নেতৃত্বের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেয়া এটা বিবেচনা করা যেতে পারতো যদি ১৯৭১ সালের বিষয়টার একটা রাজনৈতিক মীমাংসা বা মিটমাট আমরা করতে পারতাম। জামায়াতের ভাবমর্যাদা যেভাবে ভুলুণ্ঠিত করা হয়েছে, জামায়াত সম্পর্কে যে এলার্জি তৈরি করা হয়েছে, পাঠ্যপুস্তক, মিডিয়ায় এবং রাজনৈতিক প্রচারণায় যেভাবে জামায়াতকে স্বাধীনতা বিরোধী বাংলাদেশ বিরোধী দল হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে তাতে নতুন নেতৃত্ব হলেও দেশের সাধারণ মানুষ, নতুন প্রজন্ম এবং রাজনৈতিক মহল জামায়াতকে সহজে গ্রহণ করে নিতে পারবে না।

দ্বিতীয় যে পন্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আমার মনে হয় সামগ্রিক বিবেচনায় এই বিকল্প পন্থাটির কথা চিন্তা করা যেতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ইসলামী আন্দোলন এই কৌশল অবলম্বন করে ভাল ফল লাভ করেছে। আমাদের সামনে তুরস্ক, মিসর, আলজেরিয়া, সুদান, ইয়ামেন, মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, জর্দানসহ পৃথিবীর প্রায় সকল ইসলামী আন্দোলন পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কৌশল অবলম্বন করেই এগিয়ে চলেছে।

তিনি বলেন-
জামায়াতের সামনে যে তিনটি বিকল্পের কথা আমি উল্লেখ করেছি আমার মতে প্রজ্ঞার পরিচয় হবে যদি দ্বিতীয় বিকল্পটি গ্রহণ করা হয়। জামায়াত যেহেতু ৬০ বছরের অধিককাল থেকে এদেশে কাজ করছে এবং দেশের কমপক্ষে ১০% ভাগ জনগণের একটি সমর্থন জামায়াতের প্রতি আছে তাই এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে জামায়াতের অবমূল্যায়ন করা হয়। কারণ বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির যে একটা অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে তা জামায়াতের আন্দোলনেরই ফসল। জামায়াতের সাথে অনেক মানুষের একটা আবেগের সম্পর্ক রয়েছে এবং জামায়াতের প্রবীণ নেতা-কর্মীরাই জামায়াতকে এই পর্যায়ে আনার ব্যাপারে একটা অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের আন্তরিকতা এবং সততার ফলেই জামায়াত বাংলাদেশের সবচাইতে বড় ইসলামী দলের মর্যাদা লাভ করেছে। জামায়াত যদি একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার পিছনে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োজিত করে এবং সেই সাথে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে যত্নবান হয় তাহলে সেই প্লাটফর্মকে রাজনৈতিকভাবে সরাসরি আক্রমণ করতে পারবে না কেউ।

পরিস্থতি খুব নাজুক। নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। নিজেকে সম্পৃক্ত করে চিন্তা করলে সমস্যার সমাধান হবে না। আপাতঃ দৃষ্টিতে জামায়াতে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে এমনটি মনে হলেও ক্ষতির কিছু নেই। বরং হেকমতের খাতিরে তেমন একটা কিছু করে হলেও নতুন আন্দোলন দাঁড় করানোর ঝুকি গ্রহণ করা উচিত।

তাছাড়া আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচ্য।
পৃথিবীর অন্য কোন দেশের ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিরোধিতা করার মত অতি স্পর্শকাতর কোন অভিযোগ নেই। এটা স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন খুবই সম্ভাবনাময় আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও এই দুর্ভাগ্যজনক ও স্পর্শকাতর অভিযোগ আন্দোলনের রাজনৈতিক সাফল্য ও গ্রহণযোগ্যতার পথে বড় বাধার সৃষ্টি করে আছে। ইসলামী আন্দোলনের দুশমনরা আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারণায় ও কৌশলে আপাতত সফল হয়ে গিয়েছে ।

তিনি লিখেছেন-
রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি মিটমাট করতে না পারার কারণে আজ বাস্তবেই মিথ্যা অভিযোগ মাথায় নিয়ে আমরা বিচারের কাঠগড়ায়। আমরা ১৯৭১ সালে জামায়াতের নেতৃত্ব দেইনি, জামায়াত রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করলেও তখনকার দলীয় নেতারাও যুদ্ধে শরীক ছিলেন না, নেতৃত্ব দেয়া তো দূরের কথা, আমাদের যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে তারা কেউই যুদ্ধ করিনি বা কোন বাহিনীরও সদস্য ছিলাম না। আমাদের দ্বারা যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ বা লুটতরাজের প্রশ্নই উঠে না। আজ রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হবার কারণেই রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার শিকার আমরা বা জামায়াত। আমাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ সাজানো এবং সবৈব মিথ্যা। আমাদেরকে নিয়ে সরকার ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।

শুধু রাজনৈতিক বিকল্পই নয়, ছাত্র অঙ্গনেও পরিবর্তনের চিন্তা করার কথা বলেন কামারুজ্জামান । নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের একটি আধুনিক রুপরেখাও দিয়ে গেছেন মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান ।

শহীদ কামারুজ্জামান লিখেছেন-
আমরা যদি নতুন কর্মকৌশল গ্রহণে ব্যর্থ হই ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না এবং আমরা ইতিহাসের কাছে দায়ী হয়ে যাবো। কারণ এক বিপুল সংখ্যক মানুষের মাঝে আমরা আশাবাদ জাগিয়েছিলাম। আমাদের আন্দোলনের সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। আমাদের ছাত্র তরুণদের বিরাট এক কাফেলা জীবন দিয়েছে, শহীদ হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, অনেকে তাদের জীবন ও যৌবন এই পথে নিঃশেষ করে দিয়েছে।

আজ এই সময়ে এসে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, শহীদ কামারুজ্জামান তাঁর সবটুকু দায়িত্ব পালন করে শহীদ হয়ে গেলেন । চিঠির মাধ্যমে এই সংকট সন্ধিক্ষণের করণীয় সম্পর্কে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনকে মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান যে দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, তার মাধ্যমে তিনি ইতিহাসের দায় মিটিয়ে গেলেন । ইতিহাস মুহাম্মাদ কামারুজ্জামানকে নিয়ে আর কখনোই কোন প্রশ্ন তুলতে পারবে না । বরং নিরপরাধ কামারুজ্জামানকে হত্যা করার কারণে ইতিহাস নিজেই কামারুজ্জামানের নিকট দায়বদ্ধ থেকে গেল ।
সৌজন্যেঃ http://imbdblog.com/?p=4206

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন