বৃহস্পতিবার, ১৪ মে, ২০১৫

বাংলাদেশের রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠিটি একান্তভাবে ভারতের করে নেয়ার প্রচেষ্টা

দুই নেত্রীর সমঝোতা ও মোদির ঢাকা সফর

বাংলাদেশের রাজনীতিতে মাঝে মধ্যে বাঁক পরিবর্তন যেন একটি বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্য নানা উপকরণ ক্রিয়াশীল রয়েছে। তবে রাজনীতি বা ক্ষমতা দিয়ে যতটা কার্যকরভাবে এর নিয়ন্ত্রণ করা যায় ততটা অর্থনীতি বা অন্য কোনো কিছু দিয়ে সম্ভব হয় না। যদিও অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, প্রশাসন, বিচার বা অন্য সব প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনীতিকে আলাদা করা যাবে এমনটিও নয়। যেকোনো দেশের রাজনীতির ওপর বাইরের তথা আন্তর্জাতিক একটি প্রভাব সক্রিয় থাকে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ হলে এই প্রভাব থাকে খানিকটা বেশি। যেসব দেশ রাষ্ট্রের নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থা, অর্থনীতি ও অগ্রগতির টেকসই ভিত্তি দিয়ে এই প্রভাবে ভারসাম্য নিয়ে আসতে সফল হয়, সে দেশের স্থিতি ততটাই নিশ্চিত হয়। আর ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে এর বিপরীতটিই দেখা যায়। রাষ্ট্র হয়ে পড়ে কোনো শক্তির ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীল। বাংলাদেশে এই প্রবণতা এখন প্রবলভাবে দেখা যাচ্ছে।
২০০৭ সালের জানুয়ারির পর থেকে বাংলাদেশের ভারসাম্যে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে নানা পরিবর্তন আসতে থাকে। এই পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রাখে রাষ্ট্রের শক্তিমান নানা অংশ এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রকদের অনেকে। ২০০৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত যেসব ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে। গত দু’টি কলামের একটিতে চলমান রাজনীতি এবং ঘটমান ঘটনার গন্তব্য নিয়ে আলোকপাত করা হয়। অপরটিতে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিতে বিভক্তি আনার একটি প্রচেষ্টা ও এর আন্তর্জাতিক অভিঘাতের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। শেষোল্লিখিত আলোচনাটির ফোকাসে ছিল একটি বিশেষ প্রচারণার কিছু ইস্যু। এ ক্ষেত্রে নয়া দিগন্তের পাঠকদের সাড়াও ছিল আশাতীত। বেশ কয়েকজন পাঠকের অনুরোধে এবারো আমার কলামের বিষয়কে অর্থনীতি ও বিশ্বপরিস্থিতির বিশ্লেষণ থেকে সরিয়ে এনে বাংলাদেশের সম্ভাব্য রাজনৈতিক গতিপথে নিবদ্ধ করা হলো।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আগামী পক্ষ বা মাস বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য হতে পারে বেশ ঘটনাবহুল একটি সময়। জুনের প্রথম সপ্তাহেই বাংলাদেশ সফরে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। তার এই সফরের আগে বাংলাদেশের সাথে সীমান্তচুক্তি সংসদে অনুমোদন করা হয়েছে। তিস্তার পানিবণ্টনের মতো আরো কিছু ইস্যু নিয়ে কাজ হচ্ছে। সফরটিকে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বাঁক পরিবর্তন হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছে নয়াদিল্লি। একই সাথে এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠিটি একান্তভাবে ভারতের করে নেয়ার প্রচেষ্টা থাকার লক্ষণও ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশে দৃশ্যপটের অন্তরালে বা প্রকাশ্যে নানা ঘটনাই ঘটছে। ঢাকায় আমেরিকান উপমন্ত্রী ওয়েন্ডি ও সহকারী মন্ত্রী নিশা দেসাইয়ের সাম্প্রতিক সফরটি আপাতসাদামাটা মনে হলেও আসলে অতটা তাৎপর্যহীন ছিল না এটি। শেখ হাসিনার সরকার ২০১৩-১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে স্বারিত টিফার কিছু শর্তে পরিবর্তন আনতে চাইছে। এসব শর্তে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক স্বার্থে হুমকি এবং মার্কিন নাগরিকদের জীবন হুমকির মধ্যে পড়লে একতরফা সামরিক হস্তপে করার বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমেরিকান পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তাদের সফরে এ নিয়ে কতটা কী আলোচনা হয়েছে, সে সম্পর্কে বিস্তৃত জানার সুযোগ কম। তবে প্রকাশ্য বাদানুবাদ বা বাংলাদেশকে নসিহত করার আগে আমেরিকাকে নিজের চেহারা আয়নায় দেখে নেয়ার আহ্বান জানানো অথবা দেশটিতে পুলিশের গুলিতে প্রতি বছর দেড় হাজার মানুষ নিহত হওয়ার কল্পিত তথ্য উপস্থাপনের দৃশ্যমান বিষয় ছাড়াও অন্তর্বর্তী সম্পর্কেও কিছু টানাপড়েন লক্ষ করার মতো।
বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল আমেরিকায় বসবাসকারী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্লগার অভিজিৎ নিহত হওয়ার ঘটনাটি। বাংলাদেশের পুলিশ কর্তৃপক্ষ ছাড়াও এ ঘটনার তদন্ত করছে এফবিআই। তাদের একটি দল বাংলাদেশ সফর করে গেছে; কিন্তু তাদের কাছে এ ঘটনার সিসিটিভির যে রেকর্ড ঢাকা কর্তৃপক্ষ থেকে হস্তান্তর করা হয়েছে তা নিয়ে রয়েছে অসন্তোষ।
আমেরিকান তদন্তকারীদের কাছে সরবরাহ করা ব্লগার অভিজিৎ হত্যার সিসিটিভি রেকর্ড পরীক্ষা করে তাতে রেকর্ড বিকৃত করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বাংলাদেশকে জানিয়েছে, কিন্তু এর কোনো সন্তোষজনক জবাব তারা পায়নি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আলকায়েদা যে দায়িত্ব স্বীকার করেছে, সেটিকে বিবেচনায় আনতে পরামর্শ দিয়েছে তারা। সিসিটিভি রেকর্ড বিকৃত করার এ ঘটনায় আমেরিকান তদন্তকারীরা সরকারের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যে আলকায়েদার অনুপ্রবেশ ঘটেছে কি না সেটিও খতিয়ে দেখতে বলেছে। বিষয়টির জটিলতা আরো বোঝা যায় গণজাগরণ মঞ্চের নেতা ডা: ইমরান সরকারের এক তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্যে। সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাসের নির্মম খুনের পর ইমরান এইচ সরকার বলেছেন, এর সাথে সরকারের ভেতর লুকিয়ে থাকা ধর্মান্ধরা জড়িত রয়েছে। তার বক্তব্যের সাথে আমেরিকান পরামর্শের যেন কোথাও এক যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে। আলকায়েদার চারণভূমির মধ্যে বাংলাদেশ ঢুকে পড়ার বিপত্তি যে কতটা মারাত্মক হতে পারে তা বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন নেই। আর ব্লগার হত্যার মতো ঘটনায় আলকায়েদার জড়িত থাকার বিষয়টি বাস্তব বা কল্পনা যা-ই ঘটুক না কেন, আমেরিকানরা আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপারে এই স্পর্শকাতর বিষয়টিকে সম্পৃক্ত করে যে বিবেচনা করতে শুরু করেছে তা স্পষ্ট।
বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে পাশ্চাত্যের প্রভাব দুর্বল করে দেয়ার প্রচেষ্টা বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই লক্ষ করা গেছে। এখানকার রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের ব্যাপারে তাদের অবস্থানকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাত্তা দেয়া হয়নি। তারা ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনকে গ্রহণ না করার কথা বারবার বলেছে, কিন্তু সরকার ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার কথা এখনো জোর দিয়েই বলে যাচ্ছে। সর্বশেষ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে জাতিসঙ্ঘের সহকারী মহাসচিব তারানকোর বাংলাদেশে আসার কথা। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তার সফরকে ঠেকানোর জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। তাকে এই বলে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ সফরের জন্য এটি মোটেই উপযুক্ত সময় নয়। হয়তো বা নিকট ভবিষ্যতে তার বাংলাদেশে আসা না-ও হতে পারে। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুনের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফোনে বেশখানিকটা উত্তপ্ত কথাবার্তায়ও তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মহাসচিব চাইছিলেন বাংলাদেশের সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কট বিরোধী নেত্রীর সাথে আলোচনা করে প্রধানমন্ত্রী নিষ্পন্ন করুক।
সম্প্রতি ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতায় যাওয়া নেপাল ও শ্রীলঙ্কার সরকারের কাছ থেকেও বৈরী আক্রমণের মুখে পড়েছে মোদি সরকার। নেপাল ভারতীয় সামরিক বাহিনীর নিয়ে যাওয়া ব্যবহৃত ত্রাণসামগ্রী ফিরিয়ে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা চীনা নৌ উপস্থিতি প্রতিস্থাপন করতে আমেরিকাকে স্বাগত জানাতে কেরিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, কিন্তু কোনো পরিস্থিতিতেই ভারতীয়দের চীনা নৌ প্রতিস্থাপন করার অনুমতি দেয়া হবে না বলে জানিয়েছে।
শ্রীলঙ্কা ও নেপালের বেশখানিকটা প্রতিকূল অবস্থা কাটাতে মোদি বাংলাদেশে তার বড় রকমের মিশন সফল করতে চান। জাতিসঙ্ঘ বা পাশ্চাত্যের উদ্যোগ যেখানে ব্যর্থ, সেখানে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে চান তিনি। মোদি দেখাতে চান, এখানকার রাজনৈতিক সঙ্কট দূর করতে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে মধ্যস্থতা বা বিরোধ নিষ্পত্তি তিনিই করতে পারেন। এটা প্রমাণ করতে আগেই এখানকার রাজনীতিতে পশ্চিমের যে প্রভাব রয়েছে সেটাকে গৌণ করার প্রয়াস চালানো হয়েছে। এখন ভারতীয় প্রভাব এতটাই মুখ্য করার প্রচেষ্টা নেয়া হবে, যা শুধু সরকারি পক্ষ নয়, বিরোধী পক্ষকেও মোহাচ্ছন্ন করে রাখবে।
নরেন্দ্র মোদি তার মিশন বাস্তবায়নে অনেক বড় এজেন্ডা ও প্রস্তাব নিয়ে বাংলাদেশে আসছেন। বাংলাদেশে তার মেগা বিনিয়োগ প্রস্তাবের মধ্যে থাকছে- গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, সেন্টমার্টিনে বিশেষ পর্যটন জোন প্রতিষ্ঠা, ঢাকা হয়ে বেনাপোল থেকে আসাম ও ত্রিপুরা পর্যন্ত মহাসড়ক নির্মাণ ও সম্প্রসারণ আর চট্টগ্রাম গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে ত্রিপুরা-মিজোরাম মহাসড়ক সংযোগ নির্মাণ। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যে ট্রানজিট বা করিডোর ভারত চাইছিল, সেটি পুরোপুরি কার্যকর করা যাবে। বাণিজ্যিক প্রয়োজনের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা প্রয়োজনে এটাকে ব্যবহার করা গেলে এ অঞ্চলে চীন থেকে ভারতের প্রতি কোনো প্রতিরক্ষা হুমকি সৃষ্টি হলে তা সহজে মোকাবেলা করা যাবে। বাংলাদেশে এই মেগা অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সংস্থাগুলোকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করবে নয়াদিল্লি।
এ ধরনের বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতি প্রতিষ্ঠা করার রয়েছে বিশেষ প্রয়োজন। এ জন্য ভারতের নীতিনির্ধারকেরা এত দিন যে অস্থির অবস্থা এখানে রাজনৈতিক সঙ্কটকে কেন্দ্র করে বিরাজ করছিল, তার অবসান ঘটা প্রয়োজন বলে মনে করছেন। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। তিনি চাইছেন বাংলাদেশে ট্রানজিট অবকাঠামো নেটওয়ার্ক বা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপিও সমর্থন দেবে।
এ লক্ষ্যে মোদির সফরের আগেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তাদের নিয়ে বাংলাদেশে আসবেন। তিনি এখানকার সরকার ও বিরোধী পক্ষের সাথে বসবেন এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে সম্মত করতে তার উপস্থিতিতে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে বৈঠকের ব্যবস্থা করার প্রাককাজগুলো সম্পন্ন করবেন। এ জন্য সুষমা প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি-প্রধানের সাথে বৈঠকে মিলিত হবেন। মোদির উদ্যোগে অনুষ্ঠিতব্য দুই নেত্রীর বৈঠকের সম্ভাব্য স্থান হলো হোটেল সোনারগাঁও। নরেন্দ্র মোদি ২০১৬ অথবা ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাবে সম্মত করার চেষ্টা করতে পারেন। বিএনপির পুনরায় সংগঠিত হতে এবং নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা থেকে বেরিয়ে আসতে সময় দরকার হবে এই অজুহাত যুক্তি হিসেবে আসতে পারে। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টিকে উদারভাবে নেয়ার কথা বলে মোদি-সুষমা বিএনপি নেত্রীর বাড়তি সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। বিএনপি নেতৃবৃন্দের একটি বড় অংশ এই ধারণাকে সমর্থন করছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও বলছেন, ক্ষমতায় যেতে না পেরে শক্তিশালী বিরোধী দল হয়ে থাকতে হলেও সমঝোতায় যাওয়া দরকার।
দলের আরেকটি অংশ এমন কোনো নির্বাচন কাক্সিক্ষত মনে করেন না, যেখানে আন্তর্জাতিক বৈধতা নিয়ে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করবে। তারা চাইছেন, পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করতে। আর এই নির্বাচন জাতিসঙ্ঘ অথবা একটি নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং উভয় পক্ষের অনুমোদিত নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে। একই সাথে সব রাজনৈতিক নেতার অবিলম্বে জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করা এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সব মামলার বিচারকার্যক্রম স্থগিত রাখার বিষয়টিও তারা নিশ্চিত করতে চান। তারা বিএনপির এই অবস্থানের কথা মোদির সাথে আলোচনার সময় জোরদারভাবে তুলে ধরতে চান। তারা মনে করছেন, এসব প্রস্তাবের ব্যাপারে যেহেতু পশ্চিমাদের সমর্থন রয়েছে সেহেতু মোদিকেও এ ব্যাপারে সম্মত করানো যেতে পারে। আর ভারতের সমর্থনের ওপর সরকারের একতরফা নির্ভরশীলতার কারণে নয়াদিল্লি চাইলে এ ব্যাপারে তাদের পক্ষে নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ কঠিন হবে।
বিএনপি নেতৃত্বের এই অংশ মনে করছেন, এ কথা সত্যি যে ভারতের মতো একটি বৃহৎ পারমাণবিক প্রতিবেশী দেশের চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে উদাসীন থাকা বা তাদের উপো করা বিএনপির সাধ্যের বাইরে। অবশ্যই ভারতের সাথে যোগাযোগ বা বোঝাপড়ায় যেতে হবে; তবে সেটি দলের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নয়। তারা মনে করেন, বিএনপি ১৯৯০ সালেও একটি সংগঠিত রাজনৈতিক দল ছিল না। এর সাংগঠনিক শক্তিও সুসংহত ছিল না। কিন্তু জনগণের সমর্থনের মধ্যেই ছিল দলের মূল শক্তি। মধ্যপন্থী উদার মুসলিম ভোটারদের প্রতিনিধিত্বমূলক একটি দল হিসেবে বিএনপির ইমেজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই মূল বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো কোনো সমঝোতায় যাওয়া কোনোভাবে যুক্তিসম্মত হবে না।
নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য হয়ে উঠতে পারে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ সফরে বাংলাদেশের রাজনীতির সার্বিক একটি অবয়ব দেয়ার প্রচেষ্টা থাকতে পারে। রাজনীতির সব পক্ষের সম্মতিতে এখানে ভারতের এজেন্ডাগুলোকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা থাকতে পারে। এখানকার যেসব স্পর্শকাতর বা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেশটির রাডারের পুরো নিয়ন্ত্রণে নেই, সেখানে পরিবর্তন এনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থাকতে পারে। সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ভারতে প্রশিক্ষণের পাইকারি ব্যবস্থা নিয়ে সর্বক্ষেত্রে প্রভাববলয় দৃঢ় করার প্রচেষ্টা থাকতে পারে। তবে এখানে এ স্বার্থের বিপক্ষের আন্তর্জাতিক শক্তির সক্রিয়তাও উপেক্ষা করার মতো নয়। হয়তো এ কারণে শ্রীলঙ্কা, নেপাল এমনকি মালদ্বীপেও ভারতের সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বারবার বিফলে যেতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে কী হয় সেটি দেখতে আরো কিছু সময় পরিস্থিতিকে অবলোকন করতে হবে। 
mrkmmb@gmail.com
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/22510#sthash.Zalqmhy0.dpuf

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন